বাংলাদেশিরা মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন-লিবিয়া থেকে ঢুকতে দিতে রাজি মিসর by মেহেদী হাসান
গাদ্দাফিবিরোধী সহিংস বিক্ষোভের কারণে লিবিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের মুক্তির ব্যাপারে আশার আলো দেখা দিয়েছে। লিবিয়ার প্রতিবেশী মিসর তাদের দেশে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশিদের ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছে। গতকাল রবিবার কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে লিবিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে শত চেষ্টায়ও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে প্রবাসীদের স্বজনরা অভিযোগ করেছে। গতকাল সকাল পৌনে ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনবরত চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার অভিযোগ করেন শরীয়তপুরের জাজিরার মো. লিটন। কালের কণ্ঠ কার্যালয়ে ফোন করে তিনি বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়ন্ত্রণকক্ষের নম্বরগুলোতে একনাগাড়ে ফোন করে গেছেন। কিন্তু রিং হলেও অপর প্রান্তে কেউ ধরেনি। আবার ওই সময় নিয়ন্ত্রণকক্ষের দুটি নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। লিটনের মতো একই অভিযোগ আরো কয়েকজনের।
নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্র জানিয়েছে, প্রায় সারাক্ষণ ফোন বাজছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের স্বজনদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, একটি ফোনে কথা বলা শেষ হওয়ামাত্র আরেকটি ফোন এসে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে ফোন ব্যস্ত পাচ্ছেন।
মিসরের সম্মতি : কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মিসর সরকার আটকে পড়া বাংলাদেশিদের লিবিয়া থেকে তাদের দেশে ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছে। গতকাল বিকেলে কায়রোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ খবর জানিয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, আজ সোমবার থেকে বাংলাদেশিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিসরে ঢুকতে পারবেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় জড়ো হন।
সর্বশেষ কায়রো দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করে আসা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক হারুন অর রশিদ এরই মধ্যে মিসর পেঁৗছে গেছেন। গতকালই তিনি কায়রো থেকে মিসর-লিবিয়া সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হন। সীমান্তে পেঁৗছে তিনি বাংলাদেশিদের মিসর প্রবেশের প্রক্রিয়া ও পাসপোর্ট নেই এমন ব্যক্তিদের বিনা খরচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে 'আউট পাস' দেওয়ার ব্যবস্থা তদারকি করবেন।
আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক : লিবিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে শ্রম, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে মিসর সীমান্তে ১০টি অস্থায়ী নিরাপদ ক্যাম্পও তৈরি করেছে। যাঁরা সীমান্তে পেঁৗছাতে পেরেছেন তাঁদের আশ্রয় মিলছে।
কর্মসংস্থানমন্ত্রী আরো বলেন, সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। বিমান এবং জাহাজপথে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি জাহাজ লেবাননে আছে বলে তিনি জানান।
বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস, প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. মো. জাফর আহমেদ খানসহ নৌবাহিনী সদর দপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনা প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, একযোগে সব নাগরিককে ফেরত আনার প্রয়োজন নেই। সব এলাকায় সংঘর্ষ নেই। যাঁরা বিপদসংকুল এলাকায় অবস্থান করছেন, তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া বা প্রয়োজনে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেবে সরকার।
মন্ত্রী বলেন, লিবিয়ার যেসব শহরে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিপদের মধ্যে আছেন, তাঁরা যেন বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা সহযোগিতা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যান। পাসপোর্ট ছাড়া যাঁরা বের হতে পারছেন না, তাঁরা নিজ নিজ কম্পানির কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করবেন। পাসপোর্ট নেই এমন বাংলাদেশিদের জন্য আউট পাস বা ট্রাভেল ডকুমেন্টের ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া লিবিয়ায় যেসব এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে, সেসব এলাকার প্রবাসীদের তিনি অযথা ছোটাছুটি করে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার পরামর্শ দেন।
অন্য দেশের নাগরিকরা যেখানে তাদের নিজ নিজ দেশের উদ্যোগে এরই মধ্যে লিবিয়া ছেড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যবস্থা নিতে কেন বিলম্ব ঘটছে_সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, 'লিবিয়ার একটি শহরেই যেখানে ১৫ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে, সেখানে অন্য দেশের লোক থাকে মাত্র দু-তিন শ। শত সংখ্যার নাগরিকদের চেয়ে হাজার সংখ্যার নাগরিকদের একত্রে সরিয়ে নেওয়ার কাজটাও জটিল।'
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। অন্যদিকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে এই সংখ্যা ৮৯ হাজার। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলেছেন, বৈধ-অবৈধ মিলে সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির অবস্থান শনাক্ত করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যেকোনো পরিস্থিতিতেই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের বিমান বা জাহাজযোগে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তাদের কারোই লিবিয়ায় এত বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী ছিল না। ৬০ হাজার বাংলাদেশির একটি বড় অংশকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হলে বিপুল অর্থ ও জনবল থাকাও প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের খাদ্য, নিরাপত্তাসহ সব ধরনের দায়ও বাংলাদেশকে নিতে হবে। এসব বিবেচনায় রেখেই সরকার লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য অর্থ ব্যয়ে সরকার কোনো কার্পণ্য করবে না বলেও জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণসচিব ড. জাফর আহমেদ। এ ছাড়া ঢাকায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষে প্রয়োজনে আরো ফোন নম্বর সংযোজনসহ কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
সরকার জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রাকে বলেছে, বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে তারা যেন লিবিয়ায় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করে। বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ-উল-ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশিরা কাজ করতেন এমন কম্পানিগুলোকে তাঁরা বায়রার পক্ষ থেকে খাদ্য, নিরাপত্তা প্রদান ছাড়াও অন্যত্র সরিয়ে নিতে অনুরোধ করছেন।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে সরকারের সর্বাত্মক পরিকল্পনা আছে কি না_এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ক্ষেত্রে যে ধরনের 'লজিস্টিক ইকুইপমেন্ট' প্রয়োজন তা পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার সুযোগ এখনো বাংলাদেশের নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লজিস্টিক-এর দিক বিবেচনা করলে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এটাকে অজুহাত হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তবে লিবিয়ার পরিস্থিতি যেভাবে অত্যন্ত দ্রুত পাল্টে গেছে, তা হয়তো বাংলাদেশে থেকে পুরোপুরি অনুধাবন করার সুযোগ ছিল না। পশ্চিমা গণমাধ্যম লিবিয়ার আন্দোলনকে বড় করে ও গাদ্দাফিবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে চেয়েছে। যে কারণে হয়তো কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের তথ্য পাওয়ার সূত্র তো কেবল পশ্চিমা গণমাধ্যম হতে পারে না।'
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আমি জানি না লিবিয়ার পরিস্থিতি ও সেখানে বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শুরুতে সরকার কতটা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেছিল। তবে মনে করি, সরকারের আরো সক্রিয় বিবেচনা করা উচিত। বন্ধুপ্রতিম দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশিদের নিরাপদে স্থানান্তরের কাজে সহযোগিতার আহ্বান জানানো উচিত।'
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'লিবিয়ায় হঠাৎ করেই এমন দুর্যোগ নেমে এসেছে। এর জন্য কোনো সরকারই প্রস্তুত ছিল না। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের উদ্যোগ অত্যন্ত ইতিবাচক। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা মনে করি, এ পর্যন্ত সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ভালো। তবে সরকারের পক্ষে একা এত বড় সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সোমবার (আজ) লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইব। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, আইওএম ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্টের প্রধানের কাছে আমরা চিঠি পাঠাব।'
দুর্ভোগের নানা চিত্র : লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিরা গতকালও টেলিফোন করে তাদের স্বজনদের কাছে মরুভূমিতে প্রচণ্ড শীত ও বৃষ্টির পাশাপাশি খাদ্যাভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে বেনগাজিতে মুষলধারে বৃষ্টি ও শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা আটকে পড়া মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
লিবিয়া থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসে আটকে পড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. শামীম কালের কণ্ঠকে জানান, লিবিয়ায় বাংলাদেশি সহকর্মী ও স্বজনদের কাছ থেকে তিনি যে খবর পাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে দেশের সর্বত্র হাহাকার চলছে। যাঁদের কাছে পাসপোর্ট ও লিবিয়ার বৈধ ভিসা আছে, তাঁরাই কেবল আশপাশের দেশে ঢুকতে পারছেন। বাকিদের সীমান্তে গিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাঁর ভাই নবীর হোসেন ফোনে (২১৮৯১৭১৭৬১০১) জানিয়েছেন, তিনি লিবিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর রাসলানুফে আছেন। নিয়োগকারী কম্পানি কর্মীদের আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। নবীর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন, একদম নিরুপায় না হলে যেন লিবিয়া থেকে দেশে না ফেরেন। শামীম জানান, শেষ জমিটুকু বিক্রি করে দুই লাখেরও বেশি টাকা খরচ করে লিবিয়া গেছেন নবীর। দেশে ফিরলে পরিবার নিয়ে তিনি বিপদে পড়বেন।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে বুলবুল হোসেন টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর ভাতিজা আক্তারুজ্জামান ইয়াসিনসহ প্রায় ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় একটি বাড়িতে আছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাঁরা বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না, খাদ্যাভাবে আছেন।
বেনগাজির আল বাইজা সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে কর্মরত একজন বাংলাদেশি নার্স গতকাল সকালে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের বাইরে তাঁরা যেতে পারছেন না। শনিবার বিকেলেও গুলির শব্দ শুনেছেন। সেখানে ক্লিনার, সিস্টার, ব্রাদার মিলিয়ে ৩০-৪০ জন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেছে।
লিবিয়ায় জাতিসংঘের অবরোধ আরোপ
নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্র জানিয়েছে, প্রায় সারাক্ষণ ফোন বাজছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের স্বজনদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, একটি ফোনে কথা বলা শেষ হওয়ামাত্র আরেকটি ফোন এসে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে ফোন ব্যস্ত পাচ্ছেন।
মিসরের সম্মতি : কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মিসর সরকার আটকে পড়া বাংলাদেশিদের লিবিয়া থেকে তাদের দেশে ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছে। গতকাল বিকেলে কায়রোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ খবর জানিয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, আজ সোমবার থেকে বাংলাদেশিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিসরে ঢুকতে পারবেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় জড়ো হন।
সর্বশেষ কায়রো দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করে আসা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক হারুন অর রশিদ এরই মধ্যে মিসর পেঁৗছে গেছেন। গতকালই তিনি কায়রো থেকে মিসর-লিবিয়া সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হন। সীমান্তে পেঁৗছে তিনি বাংলাদেশিদের মিসর প্রবেশের প্রক্রিয়া ও পাসপোর্ট নেই এমন ব্যক্তিদের বিনা খরচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে 'আউট পাস' দেওয়ার ব্যবস্থা তদারকি করবেন।
আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক : লিবিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে শ্রম, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে মিসর সীমান্তে ১০টি অস্থায়ী নিরাপদ ক্যাম্পও তৈরি করেছে। যাঁরা সীমান্তে পেঁৗছাতে পেরেছেন তাঁদের আশ্রয় মিলছে।
কর্মসংস্থানমন্ত্রী আরো বলেন, সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। বিমান এবং জাহাজপথে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি জাহাজ লেবাননে আছে বলে তিনি জানান।
বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস, প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. মো. জাফর আহমেদ খানসহ নৌবাহিনী সদর দপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনা প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, একযোগে সব নাগরিককে ফেরত আনার প্রয়োজন নেই। সব এলাকায় সংঘর্ষ নেই। যাঁরা বিপদসংকুল এলাকায় অবস্থান করছেন, তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া বা প্রয়োজনে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেবে সরকার।
মন্ত্রী বলেন, লিবিয়ার যেসব শহরে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিপদের মধ্যে আছেন, তাঁরা যেন বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা সহযোগিতা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যান। পাসপোর্ট ছাড়া যাঁরা বের হতে পারছেন না, তাঁরা নিজ নিজ কম্পানির কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করবেন। পাসপোর্ট নেই এমন বাংলাদেশিদের জন্য আউট পাস বা ট্রাভেল ডকুমেন্টের ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া লিবিয়ায় যেসব এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে, সেসব এলাকার প্রবাসীদের তিনি অযথা ছোটাছুটি করে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার পরামর্শ দেন।
অন্য দেশের নাগরিকরা যেখানে তাদের নিজ নিজ দেশের উদ্যোগে এরই মধ্যে লিবিয়া ছেড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যবস্থা নিতে কেন বিলম্ব ঘটছে_সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, 'লিবিয়ার একটি শহরেই যেখানে ১৫ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে, সেখানে অন্য দেশের লোক থাকে মাত্র দু-তিন শ। শত সংখ্যার নাগরিকদের চেয়ে হাজার সংখ্যার নাগরিকদের একত্রে সরিয়ে নেওয়ার কাজটাও জটিল।'
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। অন্যদিকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে এই সংখ্যা ৮৯ হাজার। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলেছেন, বৈধ-অবৈধ মিলে সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির অবস্থান শনাক্ত করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যেকোনো পরিস্থিতিতেই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের বিমান বা জাহাজযোগে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তাদের কারোই লিবিয়ায় এত বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী ছিল না। ৬০ হাজার বাংলাদেশির একটি বড় অংশকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হলে বিপুল অর্থ ও জনবল থাকাও প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের খাদ্য, নিরাপত্তাসহ সব ধরনের দায়ও বাংলাদেশকে নিতে হবে। এসব বিবেচনায় রেখেই সরকার লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য অর্থ ব্যয়ে সরকার কোনো কার্পণ্য করবে না বলেও জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণসচিব ড. জাফর আহমেদ। এ ছাড়া ঢাকায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষে প্রয়োজনে আরো ফোন নম্বর সংযোজনসহ কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
সরকার জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রাকে বলেছে, বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে তারা যেন লিবিয়ায় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করে। বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ-উল-ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশিরা কাজ করতেন এমন কম্পানিগুলোকে তাঁরা বায়রার পক্ষ থেকে খাদ্য, নিরাপত্তা প্রদান ছাড়াও অন্যত্র সরিয়ে নিতে অনুরোধ করছেন।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে সরকারের সর্বাত্মক পরিকল্পনা আছে কি না_এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ক্ষেত্রে যে ধরনের 'লজিস্টিক ইকুইপমেন্ট' প্রয়োজন তা পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার সুযোগ এখনো বাংলাদেশের নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লজিস্টিক-এর দিক বিবেচনা করলে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এটাকে অজুহাত হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তবে লিবিয়ার পরিস্থিতি যেভাবে অত্যন্ত দ্রুত পাল্টে গেছে, তা হয়তো বাংলাদেশে থেকে পুরোপুরি অনুধাবন করার সুযোগ ছিল না। পশ্চিমা গণমাধ্যম লিবিয়ার আন্দোলনকে বড় করে ও গাদ্দাফিবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে চেয়েছে। যে কারণে হয়তো কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের তথ্য পাওয়ার সূত্র তো কেবল পশ্চিমা গণমাধ্যম হতে পারে না।'
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আমি জানি না লিবিয়ার পরিস্থিতি ও সেখানে বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শুরুতে সরকার কতটা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেছিল। তবে মনে করি, সরকারের আরো সক্রিয় বিবেচনা করা উচিত। বন্ধুপ্রতিম দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশিদের নিরাপদে স্থানান্তরের কাজে সহযোগিতার আহ্বান জানানো উচিত।'
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'লিবিয়ায় হঠাৎ করেই এমন দুর্যোগ নেমে এসেছে। এর জন্য কোনো সরকারই প্রস্তুত ছিল না। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের উদ্যোগ অত্যন্ত ইতিবাচক। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা মনে করি, এ পর্যন্ত সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ভালো। তবে সরকারের পক্ষে একা এত বড় সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সোমবার (আজ) লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইব। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, আইওএম ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্টের প্রধানের কাছে আমরা চিঠি পাঠাব।'
দুর্ভোগের নানা চিত্র : লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিরা গতকালও টেলিফোন করে তাদের স্বজনদের কাছে মরুভূমিতে প্রচণ্ড শীত ও বৃষ্টির পাশাপাশি খাদ্যাভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে বেনগাজিতে মুষলধারে বৃষ্টি ও শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা আটকে পড়া মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
লিবিয়া থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসে আটকে পড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. শামীম কালের কণ্ঠকে জানান, লিবিয়ায় বাংলাদেশি সহকর্মী ও স্বজনদের কাছ থেকে তিনি যে খবর পাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে দেশের সর্বত্র হাহাকার চলছে। যাঁদের কাছে পাসপোর্ট ও লিবিয়ার বৈধ ভিসা আছে, তাঁরাই কেবল আশপাশের দেশে ঢুকতে পারছেন। বাকিদের সীমান্তে গিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাঁর ভাই নবীর হোসেন ফোনে (২১৮৯১৭১৭৬১০১) জানিয়েছেন, তিনি লিবিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর রাসলানুফে আছেন। নিয়োগকারী কম্পানি কর্মীদের আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। নবীর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন, একদম নিরুপায় না হলে যেন লিবিয়া থেকে দেশে না ফেরেন। শামীম জানান, শেষ জমিটুকু বিক্রি করে দুই লাখেরও বেশি টাকা খরচ করে লিবিয়া গেছেন নবীর। দেশে ফিরলে পরিবার নিয়ে তিনি বিপদে পড়বেন।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে বুলবুল হোসেন টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর ভাতিজা আক্তারুজ্জামান ইয়াসিনসহ প্রায় ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় একটি বাড়িতে আছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাঁরা বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না, খাদ্যাভাবে আছেন।
বেনগাজির আল বাইজা সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে কর্মরত একজন বাংলাদেশি নার্স গতকাল সকালে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের বাইরে তাঁরা যেতে পারছেন না। শনিবার বিকেলেও গুলির শব্দ শুনেছেন। সেখানে ক্লিনার, সিস্টার, ব্রাদার মিলিয়ে ৩০-৪০ জন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেছে।
লিবিয়ায় জাতিসংঘের অবরোধ আরোপ
No comments