বিভিন্ন সময়ে অপহরণ মামলাটির তদন্ত করেছেন ৩৫ কর্মকর্তা- ১৬ বছর পর পুলিশ বলছে কল্পনাকে উদ্ধার করা যায়নি
‘আমার তদন্তকালে উপযুক্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণের অভাবে কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। এমনকি তাহার সঠিক অবস্থানও নির্ণয় করা সম্ভব হয় নাই।...অদূর ভবিষ্যতেও যে উদ্ধার হইবে—তাহার কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না।
ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে বা উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির পুনরায় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’এভাবেই ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি শেষ করে দিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ মামলার ৩৫তম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. শহীদুল্লাহ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি রাঙামাটির মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে জমা দেন। ১৩ জানুয়ারি ওই আদালতে এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
মামলাটির বাদী ও কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী চাকমা সিআইডির এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধীদের শনাক্ত করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান মনে করেন, সিআইডির এ প্রতিবেদন ‘সাজানো’।
১৯৯৬ সালের ১১ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহূত হন।
কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ওই রাতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল কল্পনা চাকমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই সশস্ত্র দলের সঙ্গে থাকা তিনজনকে কল্পনার দুই ভাই কালিন্দী ও লাল বিহারী চাকমা চিনতে পারেন। এ তিনজন হলেন: তাঁদের বাড়ির কাছের কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের (ভিডিপি) প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদ।
এ কথা সিআইডির দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে এ তিনজনের নাম কল্পনার ভাই ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লাল বিহারী চাকমা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া সাক্ষ্যেও বলেছেন। কিন্তু সিআইডির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেননি। তাই লাল বিহারী চাকমার প্রদত্ত বক্তব্যটি রহস্যপূর্ণ। তবু তাঁহার দেওয়া তথ্য তদন্তকালে যাচাই করা হয়। কিন্তু এর সমর্থনে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।’
এজাহারে এ তথ্য না লেখার কারণ জানতে চাইলে মামলার বাদী কালিন্দী চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পরদিন আমি থানায় অভিযোগ করতে গেলে সারা দিন আমাকে থানায় আটকে রাখা হয়। এরপর ওসি সাহেব নিজেই এজাহার লিখে তাতে আমার সই নেন। রাতে আমাকে ছেড়ে দেন। এরপর এ নিয়ে পুলিশের কোনো তৎপরতাই ছিল না।’ তিনি দাবি করেন, তিনি তখনই এ তিনজনের নাম বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও থানা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (টিএনও) বলেছিলেন। এমনকি সব তদন্ত কর্মকর্তাকেও তিনি একই কথা বলেছেন।
সালেহ আহম্মেদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস আমাকে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতাম মাঝেমধ্যে। কিন্তু কল্পনা অপহরণের রাতে আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম না।’
১৯৯৬ সালের ১২ জুন বাঘাইছড়ি থানায় এ ঘটনায় মামলা হয়। থানার তৎকালীন ওসি শহিদউল্ল্যা নিজেই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এরপর একে একে ৩৩ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হন। এভাবে ১৪ বছর পার হয়। কিন্তু তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপর ৩৪তম তদন্ত কর্মকর্তা, ওই থানার উপপরিদর্শক ফারুক আহম্মদ ‘পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না’ বলে দাবি করে ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাঙামাটির মুখ্য বিচারিক হাকিম মামলাটি সিআইডির মাধ্যমে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর দুই বছর তদন্তের পর ৩৫তম তদন্ত কর্মকর্তাও পূর্ববর্তী কর্মকর্তার আদলেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
কল্পনার ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে, তা ১৬ বছরেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোনো সংস্থা উদ্ঘাটন করতে পারেনি। উপরন্তু অভিযোগ রয়েছে, কোনো তদন্ত কর্মকর্তাই সত্য উদ্ঘাটনে আন্তরিক ছিলেন না।
অবশ্য সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মো. শহীদুল্লাহ এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তদন্তের স্বার্থে তিনি অভিযোগকারী, এলাকার লোকজন ও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাঁদের সবার বক্তব্য নিয়েছেন। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তা ফেরদৌসকে তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করতে সক্ষম হননি। তাঁর সঙ্গে একবার এ ঘটনা নিয়ে ফোনে কথা বলেছিলেন বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানান।
যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তাঁকে আইন অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ না করে, একবার ফোনে কথা বলেই তদন্ত শেষ করাকে ‘চূড়ান্ত দায়িত্বহীন’ কাজ বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। এ কারণে তদন্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এএসএম শাহজাহান মনে করেন, ১৬ বছর ধরে তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময়ের পরও অপহূতের বিষয়ে কোনো তথ্য না দেওয়া এবং কোনো অপরাধী শনাক্ত না করা তদন্ত কর্মকর্তাদের অযোগ্যতাই প্রমাণ করে। তিনি মামলাটির নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সজাগ হওয়ার পরামর্শ দেন।
No comments