বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠক সফল হোক- রণেশ মৈত্র
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মধ্যে দীর্ঘ প্রত্যাশিত বৈঠকটির ওপর যেমন এই উপমহাদেশের দেশগুলো_ তেমনি আবার সারা বিশ্বও গুরুত্ব দিয়ে ল্য করছে এই বৈঠকের গতি-প্রকৃতি, সাফল্য-ব্যর্থতা প্রভৃতি।
এ কথা ঠিক, ভারতের সাথে তার নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক যতটা ভাল হওয়া উচিত, দুঃখজনক হলেও সত্য_ তা ততটা নয়। কোন কোন েেত্র এই সম্পর্ক একেবারে বৈরিতারই। যেমন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। এই সম্পর্কের সহসা উল্লেখযোগ্য এবং অর্থবহ কোন উন্নতির সম্ভাবনা আজও দেখা যাচ্ছে না। ফলে উভয় পই মারাত্মক তির বোঝা টেনে চলেছে। তেমনি আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কও প্রত্যাশিত পর্যায়ে কখনই তেমন একটা থিতু হতে পারেনি_ এটি আর এক দুঃখজনক সত্য। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যেন অতীতের ধারাতেই কম-বেশি বহমান এবং তার কারণ খুঁজতে গেলে মনে হয়, একদিকে সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রে ভারত-ভাঙ্গা, অপরপ েপাক-মার্কিন বন্ধুত্বের সুবাদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের চরম এবং প্রত্য বিরোধিতার পর বাংলাদেশের অভু্যদয় যখন ঘটেই গেল, তখন আবার ঐ উভয় দেশের শাসক গোষ্ঠী এবং তাদের এ দেশীয় তাঁবেদারদের সচেতন প্রয়াস থাকল যাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক যেন কখনই স্থায়ী মিত্রতার সম্পর্কে পরিণত না হয়। অপশক্তিগুলোর এমনতর প্রয়াস অনেকটাই যে সফল হয়েছে তা রাজনৈতিক পর্যবেকদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট।কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক তো এমনতর হওয়ার কথা ছিল না, তবুও বাস্তবে তা হয়েছে। কেন? এই 'কেন'র উত্তরে প্রথমেই যা আমার মনে আসে তা হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই উভয় রাষ্ট্রেই বারংবার সামরিক হস্তপে ও গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের ফলে বোধ করি উভয় দেশের গণ-আকাঙ্া কদাপি সোচ্চার ও সংহত কোন রূপ নিতে পারেনি। আবার ঐ সামরিক হস্তপে ছাড়াও দেশ দু'টিতে দীর্ঘদিন যাবত দণিপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মতায় বসে ঐ সামরিক শাসকদের পরিচালিত 'ভারত' নীতি বজায় রেখেছে। শীতল করে রেখেছে তৃতীয় কোন শক্তির স্বার্থে। এই তৃতীয় পটি দৃশ্যমান নয়_ নেপথ্যে থেকেই কলকাঠি নেড়ে তারা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে শীতল পর্যায়ে নিয়ে রেখেছে, যাতে দেশ দু'টির বিশাল সীমান্তজুড়ে বিশাল সশস্ত্র বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি করে রাখতে উভয় সরকার বাধ্য হয় এবং রাষ্ট্রীয় বাজেটের বিপুল অংশ সামরিক খাতে ব্যয়িত হয়। আর সে কারণেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন শক্তি সচেতনভাবেই গড়ে তোলা হয়, যে শক্তিগুলো কথায় কথায় ভারতকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধী বলে দিবারাত্র জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
অথচ কী গৌরবোজ্জ্বলই না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাস রচনায় ভারতের সরকার ও কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিকের কী বিপুল অবদানই না ছিল_ যে ঋণ বাঙালী জাতির প েপরিশোধ করা হয়ত বা কখনই সম্ভব হবে না। ঐ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীরই কি কম অবদান ছিল? ভারতীয় সেনাবাহিনী আর আমাদের মুক্তিবাহিনী (যারা সংখ্যায় প্রায় এক লাখ এবং সবাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রশিণপ্রাপ্ত এবং অস্ত্রসজ্জিত) মিলে সৃষ্টি হয়েছিল যৌথবাহিনী এবং নয় মাস প্রাণপণ যুদ্ধ করে যে অগণিত সংখ্যক বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা দেশমাতৃকার মুক্তি কামনায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল_ সেই একই মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীরও দশ সহস্রাধিক অফিসার ও জোয়ান শহীদ হন এবং উভয়ের মিলিত রক্তস্রোতের রক্তাক্ত পথ বেয়েই আসে আমাদের কাঙ্তি বিজয়। তাই এটাই তো স্বাভাবিক ছিল যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্ব হবে দিন দিন অধিকতর শক্তিশালী। কিন্তু পূর্বোক্ত অপশক্তিগুলোর সচেতন প্রয়াসে ঐ সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারেনি, বিশেষ করে ১৫ আগস্টের কালরাতের ভয়াবহ হত্যালীলার পর থেকে। পরিণতিতে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে_ তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত। ভারতও হয়েছে অনুরূপভাবে তিগ্রস্তই।
এহেন পটভূমিতে দীর্ঘ প্রতীতি হাসিনা-মনমোহন বৈঠক বাঙালী জাতির জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ। এর সাফল্য বাংলাদেশের জন্য হবে যেমন কল্যাণকর_ ব্যর্থতাও (যদি ঘটে) হবে তেমনই অকল্যাণের। ততোধিক তিকর। এ কারণে উভয় দেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী উভয় দেশের সরকারই অত্যন্ত সচেতনতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে_ যাতে কিছুতেই বৈঠকটি অসফল না হয়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত থেকে বিদু্যত আমদানির। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয় থাকার কোন অবকাশই নেই কোন দেশপ্রেমিক বাঙালীর। নিত্যদিনের বিদু্যত বিভ্রাট এবং বিদু্যত উৎপাদনে ঘাটতির ফলে বাংলাদেশের যে হাজার হাজার কোটি টাকার তিসাধিত হয়ে চলেছে, বিশেষ করে আমাদের শিল্প ও কৃষি খাতে, তা সবারই জানা। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত বাস্তবায়িত হয় ততই বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বার্থে বিশেষ মঙ্গল বয়ে আনবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তার পণ্য চলাচলের জন্য ট্রানজিট চেয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। কিন্তু বাংলাদেশের কোন সরকারই ভারতের এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো এই ট্রানজিটের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণের গন্ধ খুঁজে পায়। তাই তারা এর বিরুদ্ধে চারদিক থেকে 'রা' তোলে, যাতে সরকার ট্রানজিট দিতে সাহসী না হয়। এ খাতে দণিপন্থী শক্তিগুলোর এই অপচেষ্টাই সফল হয়েছে। কিন্তু এবার? এবারও কি তেমনটা ঘটবে? যদি ট্রানজিট প্রসঙ্গটি ভারত সরকার আলোচনার টেবিলে উত্থাপন করতে চায় তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেন দ্বিধাহীনভাবে তাতে সম্মতি দেন। কারণ পরস্পর পরস্পরের স্বার্থে ট্রানজিট দিলে উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হবে, খুলে যাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনের পথ। বস্তুত আমরা কি অপর কোন দেশের সাথে এমন কোন চুক্তির কথা ভাবতে পারি, যাতে শুধুই বাংলাদেশের স্বার্থ রতি হবে_ অপর দেশটির স্বার্থকে বিবেচনাতেই আনা হবে না? বস্তুত দেয়া-নেয়া এবং পরস্পর পরস্পরের যৌক্তিক স্বার্থ রা করে চলবে_ এই ভিত্তিতেই তো পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি সাধিত হতে পারে, উভয় পরেই স্বার্থ রতি হতে পারে। ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে, এশিয়ান হাইওয়ে_ এগুলো আজ বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের স্বার্থে প্রয়োজন। আমরা একটি অবরুদ্ধ বাংলাদেশ চাইতে পারি না। কারণ অবরুদ্ধ বাংলাদেশ বাংলাদেশের স্বার্থও রা করে না_ ভারতের স্বার্থেও নয়। সকল দুয়ার খোলা রাখার নীতি আমরা পারস্পরিক স্বার্থে গ্রহণ করতে চাই। গোটা বিশ্ব তাই করছে এবং লাভবানও হচ্ছে।
হঁ্যা, ভারতের সঙ্গে যে সকল প্রশ্নে বিরোধের আশঙ্কা_ তার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের করিডর (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী) সমস্যার সমাধান। এেেত্র ভারত তা কার্যকর না করায় সঙ্গত কারণেই ােভ রয়েছে। বাংলাদেশ বহু আগেই কার্যকর করেছে। অবিলম্বে ভারতের তা কার্যকর করা উচিত। বিষয়টি বাংলাদেশ জোরেশোরে উত্থাপন করুক। অপর সমস্যা গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে। এ সমস্যার সমাধানে যে চুক্তি হয়েছিল তা পুরোপুরি কার্যকর করতেও ভারতকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ভারত এ ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ। আর যদি কোন কারণে চুক্তির কোন সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়ে থাকে_ তবে উভয় প সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করুক। ফারাক্কা যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা বস্তুতই ভয়াবহ। পারস্পরিক আলোচনা_ আন্তরিকতা পূর্ণ আলোচনা অবশ্যই সব সমস্যার সমাধান বয়ে আনবে। এই বৈঠকে অপরাপর বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের ভারতীয় ভিসা পাবার েেত্র অহেতুক সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হোক। ভারত গমনেচ্ছুক প্রত্যেককে ১৫০ মার্কিন ডলার পাসপোর্টে এনডোর্স করানো, অন্যান্য কাগজপত্র যথা আইডি কার্ডের কপি আবেদনপত্রের সঙ্গে জমাদানের যে বিধান করা হয়েছে তার দ্বারা ভারতে অবৈধ গমনেচ্ছুদেরই সুবিধা করে দেয়া হয়েছে এবং বস্তুত বর্ডার এলাকায় নাকি তাই ঘটছে। কাজেই অন্তত প েডলার এনডোর্সমেন্টের বিধান রহিত এবং ভিসার আবেদনপত্র জমা দেয়া ও ফেরত নেয়া সহজ করার ব্যবস্থা ভারত সরকার করলে যাত্রীদের সুবিধা হয়। তদুপরি, বছরে ক'বার বাংলাদেশীরা ভারতে যেতে পারবে_ ক'বার এবং কত দিনের ব্যবধানে ভিসা দেয়া হবে এ সংক্রান্ত কড়াকড়ি তুলে দেয়া প্রয়োজন। সর্বশেষ কথাটি হলো শান্তির স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে, সামরিক ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে সেই অর্থ নানাবিধ উন্নয়নের কাজে ব্যবহার ও পরনির্ভরতা কমানোর স্বার্থে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করার কোন বিকল্প নেই।
ঋ-বটধফ : রটভণ্রদবটর্ধরটআহটদমম.ডমব
No comments