বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ ব্যারিস্টার এম. by আমীর-উল ইসলাম
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বলতে যা বুঝি সে বাংলাদেশ এক দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও আদর্শের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উদ্ভাসিত বাংলাদেশ তাই একটি প্রজাতন্ত্র। "প্রজাতন্ত্রের সকল মতার মালিক জনগণ" (অনুচ্ছেদ-৭)।
"প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হইবে" অনুচ্ছেদে (১১)। এই চেতনার উন্মেষ ঘটাতে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আর এদেশের মানুষকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদেশ, এদেশের মাটি ও মানুষ এবং তাদের ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসের বিরাট ক্যানভাসেই ইতিহাসের মহানায়ক, এ দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ-তিতিা, নিষ্ঠা, সাধনা ও সাহসী নেতৃত্বের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব।হিমালয়ের পাদদেশে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এদেশের জনগোষ্ঠী নদী সভ্যতা ও গ্রাম সভ্যতার হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছে বিভিন্ন সময়ে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ_ঝড়, বন্যা এবং অপরদিকে বিদেশী শোষণ ও শাসন, হানাদার-বর্গী, মোঘল ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহ্য। বিদেশী প্রভুত্ব, ভূস্বামীদের অত্যাচার-নিপীড়ন, মহাজনী শোষণ ও অধিকারহীনতায়, শোষণ ও বঞ্চনা হতভাগ্য এ জনগোষ্ঠী তাদের স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য এবং মানবিক মর্যাদা লাভের প্রত্যাশায় অব্যাহত সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। অকাতরে জীবন দিয়েছে তবু কখনও বশ্যতা, দাসত্ব বা পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়নি। ভাষার অধিকার, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং মানবিক মর্যাদাসহ বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এর মধ্য দিয়ে এ জাতির স্বীয় সত্তা ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ দিনের এই আত্মমর্যাদা-সচেতন জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী চেতনা থেকে জন্ম নেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের নামে বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও এক নতুন ঔপনিবেশিকতার শিকারে পরিণত হয়। কৌশলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে করা হয় সংখ্যালঘিষ্ঠ। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় (জনগণের) অংশগ্রহনের সুযোগ থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলো; অথচ জনগণের অবাধ ভোটের মাধ্যমে কোন নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ বা সরকার গঠিত হয়নি। ১৯৪৮ সালে বাঙালীদের ওপর, এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন ও সেই সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এদেশকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি এ দেশের মানুষের মাঝে জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক চেতনাকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তর করেন। ফলে শুরু থেকেই তিনি শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পতিত হন। ১৯৪৮ সালেই তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। কিন্তু জনগণের আন্দোলনকে তারা থামিয়ে রাখতে পারেনি।
১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালী জাতিসত্তার উন্মেষ। এরই বিকাশ ঘটে ছয় দফা আন্দোলনে। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের পর উদর্ুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে বাঙালী সমাজকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে এ অঞ্চলকে পাকিস্তানী শাসকদের একটি বাজারে পরিণত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনের ছাত্রনেতা মুজিব ভাই একথা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি বাঙালীর মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজ রোপণ করেছিলেন, তাঁরই কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল উদর্ুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। পরবতর্ীতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে গণতন্ত্র ও বাঙালীর অধিকার অর্জনের দাবিতে ৬ দফা ও ১১ দফার দাবীতে ৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ ও শাসকগোষ্ঠীর মতা হস্থান্তরে অস্বীকৃতি, সামরিক আমলাতন্ত্রের একগুঁয়েমি একনায়কত্ব, হত্যা নির্যাতন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
১৯৪৮ সাল, যে বছর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ও উদর্ুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সোচ্চার প্রতিবাদ, সেই একই বছরে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে স্বীকৃতি পায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভাষা-ভাষী ুদ্র বা বৃহৎ সকল জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার। অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবার অধিকার উমশণভটর্ভ মভ ডধশধফ টভঢ যমফর্ধধডটফ রধথর্দ্র-এ স্বীকৃত জনগণের এ সকল সর্বজনীন অধিকারের বাস্তবায়ন ও মতায়নের বিষয়টিও ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি মৌলিক দিক।
পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এদেশের জনগণের সংগ্রামকে সাংগঠনিক রূপ দিতে যার অবদান সবচেয়ে উল্লেখের দাবি রাখে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদেশের ছাত্র-যুবক, মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিতে, জনগণকে সকল বিপদে সাহস যোগাতে, একটি ধর্ম নিরপে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মূলধারায় পরিণত করার সবচেয়ে কৃতিত্বের অবদান রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একদিকে স্বৈরাচার-সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা; অপরদিকে গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদা।। জনগণের মৌলিক অধিকার ও রুটি রুজির লড়াই। এই লড়াইয়ের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এক ঐতিহাসিক সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনি একটি চিন্তা-আদর্শের ভিত্তিতে জনগণের ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর সাহসী ও আপোসহীন নেতৃত্বে ছাত্র-যুবক, মধ্যবিত্ত, কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি ও সংগামী মানুষ আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়। তিনি বাঙালী জাতিকে স্বকীয়তায় উজ্জীবিত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। আন্দোলনকে ধাপে ধাপে জনগণের মুক্তি ও মতায়নের ল্যে নিয়ে যান।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদর্ী, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে যৌথ নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। যেমনটি বিজয় হয়েছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে। সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক ছত্রছায়ায় গড়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জনগণের এ বিজয়কে যেমন মেনে নেয়নি ১৯৫৪ সালে, তেমনি মেনে নেয়নি ১৯৭১এ। তৎকালীন পূর্ব পকিস্তানে ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কয়েক মাস যেতে না যেতেই কেন্দ্র থেকে গবর্নরের শাসন জারি করে প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। সেই সাথে ভেঙ্গে দেয়া হয় মন্ত্রিসভা। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে করা হয় বন্দী। নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও এদেশের জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশ শাসনের সুযোগ থেকে হয় বঞ্চিত। একচেটিয়া শোষণের মাধ্যমে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের বিকাশ ঘটে; অথচ পূর্ব বাংলাকে করা হয় সম্পূর্ণ দেউলিয়া। এদেশের অর্থনীতির প্রতি দেখানো হয় চরম অবজ্ঞা। শিা, শিল্প-কলকারখানা, চাকরি, সামরিক বাহিনী, সর্বেেত্র বাঙালীদের প্রতি চরম বৈষম্য এদেশের জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে। অধিকারহারা বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর উদর্ুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এ জাতিকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক েেত্রও স্থায়ীভাবে পঙ্গু রাখার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এভাবে বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির উপর চরম আঘাত হানা হয়। একটি সামরিক আমলাতন্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে যায় জনগণের অধিকার। রাজনৈতক প্রক্রিয়াকে আজ্ঞাবহ করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অঙ্গুলী হেলনে পাকিস্তান গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হল। সেই সাথে নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভার পরিবর্তে গঠিত হয় পাকিস্তানের আমলা গোলাম মোহাম্মদের নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র। ফলে পাকিস্তানের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় একটি গুরুতর সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এর ফলে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিকতার ইতহাসে এক প্রচণ্ড বিপর্যয় নেমে আসে। বিভিন্ন প্রাদেশিক এ্যাসেম্বলি থেকে প্রতিনিধি নিয়ে পুনরায় যদিও নতুন গণরিষদ গঠিত হয়, কিন্তু সেই গণপরিষদে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানকে সমান ইউনিটে বিভক্ত করে পার্লামেন্টে সমান সংখ্যক আসনের ব্যবস্থা করা হয়। রাজনৈতিক অধিকারের েেত্র অসম ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক েেত্র বৈষম্য এমনকি সামরিক বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনের সকল স্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিতে একচেটিয়া পাঞ্জাবী আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে এদেশের জনগণকে স্থায়ীভাবে পদানত রাখার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যদিও ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করা হলো, কিন্তু সেই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ নানা অজুহাতে পিছিয়ে দেয়া হয়। বহু টালবাহানার পর সর্বশেষে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয় কিন্তু তার পূর্বেই ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে মতার পালাবদল শুরু হয়। সামরিক শাসন জারি করে প্রথমে ইসকান্দার মির্জা এবং কয়েকদিন পর আইয়ুব খান মতা দখল করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান তার এনায়কত্বকে পাকাপোক্ত রাখার জন্য মর্জি মাফিক এক ফরমানের মাধ্যমে একটি সংবিধান জারি করেন। সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করলেন। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সৃষ্টি হলো। শুধু ঐ সব মৌলক গণতন্ত্রীর ভোটে একটি পার্লামেন্ট তৈর হয়। নিজের মতা ভোগের মাপে তৈরি শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় একটি প্রশাসন সৃষ্টি হলো। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সরকার বা সংসদ নির্বাচনের অধিকার থেকে জনগণ হলো বিতাড়িত। আইয়ুব-মোনেম শাসনামলের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। জেল জুলুম ও অত্যাচারের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পূর্ব বাংলার মানুষের বঞ্চনা-বিড়ম্বনার সাথে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধকালে বিচ্ছিন্ন এ ভূখণ্ডে এক অবহেলাজনিত অসহায়ত্ব বোধটি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। স্বাধিকার ও আত্ননিয়ন্ত্রণের দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৬ সাল থেকে এ দেশের জনগণকে সংঘবদ্ধ করতে শুরু করলো। ৬ দফা ও ছাত্র-জনতার ১১ দফা দাবি এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রচার করা হলো যে, স্বাধিকার আন্দোলনে ভারতের উস্কানি আছে। ভারতবিরোধী জুজুর ভয় দেখিয়ে বাঙালীদের বিভ্রান্ত করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নং আসামী করে শুরু হলো'আগরতলা' ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু এর ফল হলো উল্টো। জনগণ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের সামরিক আমলা চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে জনগনের জয় হলো। ঢাকা শহর গণঅভু্যত্থানের শহরে পরিণত হলো। জনগণের দাবির মুখে শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলো। দীর্ঘ দশ বছর একনায়কের শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসন্তোষ ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। গণরোষের ফলে আইয়ুব খান সামরিক বাহিনীর কাছে মতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করলেন। পরে ইয়াহিয়া খান নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করে ৬২'র সাংবধান বাতিল করলেন। আর সেই সাথে সরাসরি নির্বাচন অর্থাৎ ৬ দফার প্রথম দফা: 'এক ব্যক্তি এক ভোট' মেনে নিলেন। নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচনা ও সরকার গঠনের প্রতশ্রুতি দিলেন। জারি হলো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে সংবিধান রচনার মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। অ-বিভক্ত পাকিস্তানে জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই প্রথম এবং শেষ নির্বাচন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় হতচকিত সামরিক জান্তা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে দিল না। ১লা মার্চে পূর্ব নির্ধারিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক বসল পূর্বাণী হোটলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই পরিবর্তর্িত অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেবার নিরঙ্কুশ মতা দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং তাঁর নির্দেশে হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসন, সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থল বন্দর, নৌবন্দর, বিমানবন্দর, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, আমদানি রফতানি, বৈদেশিক বাণিজ্য-টেলিভিশন রেডিও-টেলিফোন-টেলেক্স নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল। অপরদিকে জণগণের ওপর সামরিক উৎপীড়ন বেড়ে চলল। নির্বিচারে গুলি চালানো হলো। মানুষ অকাতরে জীবন দিল কিন্তু মাথা নত করল না। আন্দোলন বরং নতুন রূপ নিল। ৬ দফা-১১ দফা অর্থাৎ স্বাধিকার আন্দোলন এখন এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হলো। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আহ্বানে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে সমগ্র জাতি সংকল্পবদ্ধ হয়। অসহযোগ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। । ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি হয়ে উঠল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গবন্ধুর নেতেৃত্বে গড়ে উঠল একটি ডিফেক্টো সরকার। তাঁর নির্দেশে দেশের সার্বিক শাসন পরিচালিত হতে থাকল। অসহযোগ আন্দোলন এমন তীব্র ও সার্বিকভাবে পালিত হতে থাকে যে ঢাকা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানকে গবর্নর হিসাবে শপথ পাঠ করাতে অস্বীকার করেন। এমনকি তৎকালীন প্রেসিডেন্টের ঢাকার আবাসনে (এখন সুগন্ধা নামে পরিচিত) তার বাবুচর্ী পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া চুলা জ্বালাতে রাজি হয়নি। যে কারণে ইয়াহিয়া খানের তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ/অনুমতি নিতে বাধ্য হন। এমন একটি অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধুকে এদেশের ঢণতটর্ডম সরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার জন্য সুগন্ধায় যেতেন।
সামরিক জান্তা চাতুরীর আশ্রয় নিল। একদিকে লোক দেখানো আলোচনা, অপরদিকে বাঙালী নিধন ও গণহত্যার নীল নক্সা। এমনি করে এ দেশের জণগণের ওপর হানাদার বাহিনী একটা বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। পাশাপাশি গড়ে ওঠে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চের মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালী জাতির ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী শত্রুকে মোকাবেলা করার নির্দেশ দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এ ঘোষণা বিভিন্ন উপায়ে ও মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। বিডিআর ঘধরফণ্র্র-এও এ বণ্র্রটথণ টি পেঁৗছে যায়। সে ঘোষণাটি জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে তাঁরই নির্দেশে স্বাধীনতার দলিল সংরণের উদ্দেশ্যে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতার দলিলে সংরতি আছে। বিডিআর কতর্ৃক প্রকাশিত স্বাধীনতার ইতিহাস সংবলিত বইয়েও এর উদ্বৃতি ও উল্লেখ আছে। ৭৫-এর পরে এ বইটির সকল খণ্ড পুড়িয়ে দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করো ওরা ভাবল বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করলে বাঙালী নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। তারপর হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু এবারেও ফল হলো উল্টো। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী তৈরি করা হয় ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্র। আর তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নির্দেশকে সামনে রেখে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত হলো। সেই থেকে বৈদ্যনাথতলা ইতিহাসে মুজিবনগর নামে খ্যাত।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আহ্বানে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পরে ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রতিস্থাপিত হয়। স্বাধীনতার এই ঘোষনা পত্র পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত হলো ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরের আম্রকাননে। এই সকল সাংবিধানিক দলিলের ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়ে মুজিবনগর সরকার পত্রালাপ শুরু করে এবং বিভিন্ন দেশে দূত পাঠায়। জনগণের এক রক্তয়ী সংগ্রাম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ তিতিার মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভ করল; বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিল। এই মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ তার স্বাধীন সত্তায় একটি জাতি, একটি রাষ্ট্র, একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের এই অভু্যদয় একটি দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার যে সংগ্রাম তা (আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানবাধিকারেরই অংশ )১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদে এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে মানব জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরই ফলে শ্রুতিতে রচিত হয় ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক দু'টি অঙ্গীকারনামা। (চলবে)
No comments