রাষ্ট্রের ত্রিপদী ভারসাম্য- খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তিন পায়ে চলে। ঠিক যেমন মানুষ দু'পায়ে চলে আর চতু্#৬৩৭৪৩;দ পশুরা চার পায়ে চলে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পদচালনা প্রক্রিয়ার সমগোত্রীয় হলো ট্রাইসাইকেল এবং রিকশা।
এক চাকা বার্স্ট হলেই পথচলা বন্ধ। রাষ্ট্রকেও তিন চাকা সতেজ রেখেই চলতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তিন পা হচ্ছে সংসদ বা আইন প্রণয়ক, প্রশাসন বা আইন অনুযায়ী কর্মপরিচালক এবং বিচার বিভাগ বা আইনের রেফারি। এই তিন স্তম্ভ বা পদত্রয়ের সমন্বিত ক্রিয়ার ফল হলো চলমান রাষ্ট্র। সংসদ বা আইনসভার কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। প্রশাসন কোন আইন বানাতে পারবে না। সংসদ প্রণীত আইনের গণ্ডির মধ্যে প্রশাসনিক, উন্নয়ন প্রভৃতি সকল প্রকার কার্যাবলী পরিচালনা করতে হবে। বিচার বিভাগ আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। আইনানুগ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করতে পারবে না। এর কাজ হলো, অন্য বিভাগ দু'টি আইনের মধ্যে চলছে কিনা তা বিচার করা। ফুটবল বা ক্রিকেটের মাঠে রেফারির মতো। খেলার মাঠে দু'দলকেই খেলার নিয়ম মেনে খেলতে হবে। নিয়ম ভঙ্গ হলো কিনা সে বিচার করবে রেফারি। রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগ হলো রাষ্ট্রের রেফারি।খেলার মাঠের তিন প অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী দু'দল ও রেফারির সাথে অবশ্য রাষ্ট্রীয় তিন পরে পার্থক্য রয়েছে। খেলার মাঠে দু'দল প্রতিদ্বন্দি্বতা করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তিন পরে কোন পই প্রতিদ্বন্দি্বতা করে না। তিন প পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করে। তুলনা করা যায়, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বস্তা বাঁধা দৌড়ের মতো। প্রতিযোগীদের প্রত্যেকের পা দু'টি বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দৌড়াতে বলা হয়। পা দু'টি যদি একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, তাহলে ব্যালান্স নষ্ট হয়ে প্রতিযোগী ধপাস করে পড়ে যাবে এবং প্রতিযোগিতায় আউট হয়ে যাবে। সে জন্যে প্রতিযোগীর বস্তাবাঁধা পা দু'টি পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় বন্ধন অটুট রেখে চলার চেষ্টা করবে, পা দু'টি একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে খেলোয়াড়কে পড়ে না যেতে সাহায্য করবে এবং দ্রুততার সাথে পদযুগল চালনার মাধ্যমে বিজয়ী হতে চেষ্টা করবে। রাষ্ট্রের েেত্রও এমনটাই প্রযোজ্য। সংসদ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ আন্তঃপ্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না। বরং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চলতে সাহায্য করবে, তবে যে যার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে।
এটি নতুন কোন বিষয় নয়। তবে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদাক্রম বিষয়ে বিচার বিভাগীয় একটি নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, মুখ্য বিচারিক জজ ও মুখ্য মহানগর জজদের পরবতর্ী ক্রমিকে থাকবেন তিন বাহিনীর প্রধানরা। তাদের পরে অবস্থান হবে সচিবদের।
বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রবীণ নাগরিকদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়ায় নির্দেশনা বিষয়ে প্রশ্ন রাখা হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় পরে যাওয়া যাবে। আগে বোঝার চেষ্টা করা যাক, (ক) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করার এখতিয়ার কার এবং (খ) বর্তমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স কি সংসদ প্রণীত কোন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল? হয়ে থাকলে কোন্ আইনের সাথে?
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এক ধরনের প্রশাসনিক বিধি। যেহেতু আইন, বিধি, নিয়মাচার একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত এবং যেহেতু আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সংসদের, অতএব ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংসদে প্রণীত হওয়াই তো বাঞ্ছনীয় মনে হয়। পরিপালনের দায়িত্ব প্রশাসনের।
রেফারির ভূমিকায় আইন বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখতে পারে যে বিধিটি সংসদে গৃহীত কোন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে কিনা। সাংঘর্ষিক হলেই মাত্র কিভাবে সাংঘর্ষিক তা ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ শুধু বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উর্ধারোহণের নির্দেশনা দিয়ে অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারণে রেফারির ভূমিকা পালন না করলে বিষয়টির সামগ্রিকতায় প্রশ্ন থেকে যায়। কেউ এটাকে বিচার বিভাগীয় 'এ্যাক্টিভিজম' বলেছেন। কেউ অন্যভাবেও প্রকাশ করেছেন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ হলে এ নিয়ে অনেক অনেক মন্তব্য এমনকি সমলোচনাও হতো।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স আগেও পরিবর্তিত হয়েছে। যখন যে মতাশালী গোষ্ঠী মতারোহণ করেছে তখন তাদের কর্মকর্তারাই উর্ধারোহণ করেছেন। যেমন, তিন বাহিনীর প্রধানদের অবস্থান সামরিক জান্তারাই ওপরে নিয়ে এসেছিল। কাজেই সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বোধ করি অনেকেই একমত। কিন্তু কোথায় কিভাবে সংশোধন হবে, এ নিয়ে সমমত প্রতিষ্ঠা সুকঠিন।
হাইকোর্টের রায়টির বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টে আপীল হওয়া উচিত। সুপ্রীমকোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির বিচারকদের নিয়ে গঠিত। তাঁরা তাঁদের ডিসপ্যাশনেট উইজডম দিয়ে বিষয়টির সর্বজনগ্রাহ্য, ন্যায্য এবং আইনসম্মত একটি সমাধান দিতে পারেন।
রেফারি হিসেবে আইন বিভাগ কোন শ্রেণীর কর্মকর্তার জন্য স্থান নির্দেশ না করে কিছু 'র্যাশনেল' বা যৌক্তিক মানদণ্ড তৈরি করে দিতে পারে। বিষয়টি যেহেতু রাষ্ট্রের সকল ধরনের নিয়োজিত পদের ক্রমনির্ধারণ সম্পর্কিত, সেহেতু আইনের সম্প্রসারিত আওতার মধ্যে সমন্বয়ের দিকটি থাকবে। এটি হবে আইনের মধ্যে আপোস। সংশোধিত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের চূড়ান্ত প্রণয়নের কাজটি সম্ভবত সংসদেই হওয়া সুবিধাজনক।
কথায় কথায় ক্রমনির্ধারণের বিষয়টি এসে গেল। মূল আলোচনা ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ত্রিপদী ভারসাম্য রা করা নিয়ে। রাষ্ট্র একটি অর্গানাইজেশন বা সংগঠন। রাষ্ট্রের তিনটি মূল স্তম্ভের প্রত্যেকটি এক একটি স্বয়ংক্রিয় সংগঠন। সংগঠনের চরিত্র হলো নিজেকে শক্তিশালী করা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মার্শাল ল দিয়ে মতায় এসে সামরিক জান্তা স্বগোত্রীয়দের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ওপরে টেনে নেয়, জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্র প্রভৃতি বিভাগে পদায়ন করে, নিজেদের সুবিধাদি বৃদ্ধি করে। ভাল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলন্ত থাকার পর কেয়ারটেকার সরকারের আমলে সংহত হয়, কারণ প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি তখন দায়িত্বে ছিলেন। সংসদীয় সরকারের সময় সরকারী ও বিরোধী দলের যতই মতদ্বৈধতা থাকুক, সংসদ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে তাঁরা দ্বিমত পোষণ করেন না।
সংসদ, জনপ্রশাসন, বিচার_ এই তিনটি স্তম্ভ (সংগঠন)কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে স্বীয় সংগঠনের ুদ্রস্বার্থ সীমার উর্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে এবং তিন অঙ্গের প্রত্যেকটি প্রত্যেকটির জন্য সাপোর্টিভ ভূমিকা গ্রহণ করতে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ অনুশীলন। তারপরই পরিশীলিত সমন্বিত আচরণ আশা করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে দীর্ঘকাল তো নয়ই, এমনকি নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চাই হয়নি। গণতন্ত্র, রাজনীতি এসবের ওপর দোষ চাপিয়ে স্বৈরশক্তি এসেছে। এতে করে গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ ঠিকমতো গড়েই ওঠেনি, সংহত হওয়া দূরের কথা। এ জন্যে তিন স্তম্ভেরই বিচু্যতি ঘটবে এবং ঘটাই স্বাভাবিক। এতে নিরাশ হবার কিছু নেই। অসন্তোষেরও কারণ নেই। প্রয়োজন ধৈর্যসহকারে ত্রুটি চিহ্নিত করা, সেগুলো সারিয়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক শিণ প্রক্রিয়াটিকে চালু রাখা।
উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বিলেত হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশঘর। কয়েক শ' বছর যাবত নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চা করছে সে দেশ। সেখানে সবকিছু আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী চলা উচিত। ভুলভ্রান্তি না থাকাই উচিত। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, বিলেতের হাউস অব লর্ডসের একজন এবং হাউস অব কমন্সের চারজন আইন প্রণেতা সদস্য সরকারী অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং আদালতে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। অথচ এ নিয়ে সরকারী ও বিরোধীদলের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়নি। আবার রাজনীতিকদের নিকুচি করে কোন স্বৈরশাসনের সুযোগ গ্রহণের প্রচেষ্টাও নেই, সুযোগ ও নেই। এর অর্থ হলো, দোষ মানুষের ব্যক্তিগত, দলগত নয়, পেশাগত নয়, রাষ্ট্রীয়ও নয়।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো অন্যায়কারী ব্যক্তি যত মতাশালীই হোক, তাকে আইনের আওতায় ঠেলে দেয়া। বিলেতে সেটাই ঘটেছে। তদন্তকারী সংস্থা আইনানুযায়ী অভিযুক্ত সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে। হয়তো নিম্ন বা মধ্য পর্যায়ের কোন বিচারক অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি (অনুর্ধ ছয় বছর কারাদণ্ড) দিয়ে দেবেন। সে দেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ঐ বিচারকের অবস্থান সংসদ সদস্যের অনেক নিচে। কিন্তু শাস্তি তো বিচারক দিচ্ছেন না, শাস্তি দিচ্ছে আইন। তাই এ নিয়ে কোন অন্তর্জ্বালা নেই কারও।
এ দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, মতাসীনদের দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তিকে গণতন্ত্রহীনতা বলা যায় না। বরং ভুলত্রুটি চিহ্নিতকরণে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠনের সমতাই হলো গণতন্ত্র চর্চার লণ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার
No comments