চৈতন্যের মুক্তবাতায়ন-সভ্যতার সংকট ও পূর্বাচলে নব অরুণোদয় by যতীন সরকার
'দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে'- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এ রকম পরম প্রত্যয়দীপ্ত বাণী উচ্চারণ করেছিলেন ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনের দ্বিতীয় দিনে। এর মাস ছয়েক পরই তিনি মর্ত্যভূমি থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন।
বিদায়বেলায়ও তিনি দুর্যোগের মায়ায় প্রবঞ্চিত হননি, তখনো 'নিত্যের জ্যোতি'কে ধরে রেখেছেন 'আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে'। রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠ নিয়ে আমরাও দৃঢ়চিত্তে সব ধরনের দুর্যোগের মোকাবিলা করতে পারি একান্ত অনায়াসে বা অল্পায়াসে।
দুর্যোগমুক্ত কোনো যুগ পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। দুর্যোগবিহীন যুগ কোনো দিন আসবেও না। আবার প্রতি যুগেই যে মানুষ দুর্যোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, দুর্যোগের কবলমুক্ত হয়েই যে মানুষের বিজয়রথ ছুটে চলেছে যুগ হতে যুগান্তরের অভিমুখে- ইতিহাস তো আমাদের এমন কথাই জানিয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারেই, বর্তমান যুগেও, আমাদের দেশ তথা সমগ্র দুনিয়াই নানা ধরনের দুর্যোগকবলিত। সেসব দুর্যোগের মায়ার আড়ালেও নিত্যের জ্যোতি ঝলমল করছে।
আজকের পৃথিবীতে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে সর্বত্র। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের তাণ্ডব থেকে মুক্ত নয় কোনো দেশই। বিশ্বায়নের নাম করে সাম্রাজ্যবাদ তার হিংস্র নখরে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে পুরো বিশ্বকে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতার চাবিকাঠিটি লুটপাটতন্ত্রীদের করায়ত্ত। নারীর প্রতি সহিংসতা ও জঘন্য অসদাচরণের যে নগ্ন প্রকাশ এখানে-ওখানে ঘটছে, তেমনটি আগেকার কোনোকালেই দেখা যায়নি বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করছেন। ক্রমাগতই এ রকম আরো দুর্যোগের উদ্ভব ঘটে চলেছে। তবু দুর্যোগই যে একান্ত সত্য নয়, দুর্যোগ প্রতিরোধের শক্তিও যে প্রবল প্রতাপে জেগে ওঠে নতুন যুগের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে, সে সত্য থেকেও তো আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না।
বিষয়টি উপলব্ধির জন্যই আবার ফিরে যাই রবীন্দ্র প্রসঙ্গে। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনে কবিগুরু তাঁর জীবনের শেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন। 'সভ্যতার সংকট' শীর্ষক সেই ভাষণটি আজও সব সংকটের অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোকশিখা রূপে দেদীপ্যমান। যে সময়ে ওই ভাষণটি প্রদত্ত হয়েছিল, সে সময়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত এক দানব মহাতাণ্ডব সৃষ্টি করে মানবসভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল সেদিন। অচিরেই মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে- এমন দুর্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মানবপ্রেমিক মনীষী। শঙ্কা রবীন্দ্রনাথের চিত্তকেও স্পর্শ করেছিল বৈকি। কিন্তু তাঁর সত্তা তো ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। সত্যকে তিনি অবলোকন করতেন অখণ্ড দৃষ্টিতে এবং সত্যের প্রতিটি খণ্ডাংশেও সেই অখণ্ডের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতেন। সে কারণেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, নিজের মৃত্যুর প্রায় পূর্বক্ষণে, সভ্যতার অচিন্তনীয় সংকটেরও ভেতরে ক্রিয়াশীল সংকট উত্তরণের শক্তিটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাই তিনি একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন-
'পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই। ... মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।'
আমরাই বা আজকের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একেই চূড়ান্ত মনে করে এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অপরাধী হয়ে উঠব কেন? আমরা তো দেখেছি; অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে, সভ্যতাবিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ঘটেছে, মানুষের সভ্যতা নতুনতর দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর সেসবই করেছে মানুষ- 'অপরাজিত মানুষ'। সেই মানুষ নিশ্চয়ই নিশ্চল হয়ে নেই এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চল হয়ে থাকবে না।
'ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে'- রবীন্দ্রনাথের এই প্রত্যয়দীপ্ত প্রত্যাশার আলোটিকেও তো আমরা জ্বলে উঠতে দেখছি। পূর্বাচল বা প্রাচ্যদেশই আজ অমিত সম্ভাবনায় জেগে উঠেছে। অন্যদিকে পশ্চিম বা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে এর বিপরীত পরিস্থিতি। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে অভূতপূর্ব ও অচিন্তিতপূর্ব বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পরপরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অমিত তেজে জ্বলে ওঠার ব্যাপারটি ছিল নিতান্তই স্ফুলিঙ্গের মতো। সেই স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় ক্ষণকালের ছন্দ পেয়ে অচিরেই উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে। ওদের বিশ্বায়নের বড়ফট্টাই আজ খুব একটা কাজে আসছে না। আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নগ্ন হস্তক্ষেপ (কিংবা ইরানে সে রকম হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি) তাদের মানবতাবিরোধী চরিত্রের স্বরূপই উদ্ঘাটন করছে কেবল, এসবের ভেতর দিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বিপত্তিগুলোর সামান্য অবসানও ঘটছে না। তথাকথিত বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেই গণ-অসন্তোষের ক্রমবিস্তার ঘটে চলছে। অর্থাৎ পূর্বাচলে নব সূর্যোদয়ের বিপরীতে পশ্চিমে সূর্য আজ অস্তাচলে।
পূর্বাচলে নব অরুণোদয়ের কথা বলে বলে আমরাই যে কেবল আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইছি তা কিন্তু নয়। পশ্চিম দেশেরও অনেক বিজ্ঞজনের আজ চোখ পড়েছে পূর্ব দিগন্তে। রবীন্দ্রনাথ 'আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে' যার আসন্ন জন্মদিনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই 'পরিত্রাণকর্তা'র আবির্ভাব সত্য সত্যই ঘটে গেছে- এমনটিই দেখতে পাচ্ছেন পাশ্চাত্যের অনেক নামজাদা অর্থনীতিবিদ। রবীন্দ্রনাথ-কথিত এই পরিত্রাণকর্তা কোনো দৈবাদেশপ্রাপ্ত অতি মানুষ নন। অতি সাধারণ মানুষরাই পরিত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হয়ে এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলছেন যে পশ্চিমের অনেক অর্থনীতিবিদই অবাক হয়ে গেছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই তাঁদের এই অবাক হয়ে যাওয়ার খবর প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁরা পাশ্চাত্যের অর্থনীতিতে দেখছেন স্থবিরতা, আর প্রাচ্যে বিরামহীন গতিময়তা। প্রাচ্য তো পাশ্চাত্যের নয়া সাম্রাজ্যবাদ তথা বিশ্বায়নের জাঁতাকলে পড়ে ক্রমাগতই শোষিত ও বিপর্যস্ত্ত হচ্ছে। তবু কী করে সেই প্রাচ্য প্রতীচ্যকে ছাড়িয়ে যেতে উদ্যত হতে পারছে? এই প্রশ্নই বোধ হয় প্রতীচ্যের বিজ্ঞজনদের তাড়িত করে চলেছে। তাই তাঁদের এমন অবাক বিস্ময়।
বিজ্ঞজনদের এ রকম বিস্ময়সূচক প্রত্যক্ষণ খুবই বিচলিত ও শঙ্কিত করে তুলেছে সাম্রাজ্যবাদের ধারক-বাহকদের। তারা এর প্রতিরোধে একেবারে মরিয়া হয়ে নানা কুটিল খেলা খেলতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রাচ্যে চীনের শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি তাদের অন্তরে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। চীন তার চলার পথে অনেক ভুল করেছে অবশ্যই। 'মহা উল্লম্ফনের' হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে একবার সে মহাবিপর্যয়কে আমন্ত্রণ করে এনেছিল। আরেকবার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে সংস্কৃতি ধ্বংসের আয়োজনেই মেতে উঠেছিল। চৈনিক নেতারা প্রায়ই চিন্তা ও কর্মের এক মেরু থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে চলে যান- কখনো কখনো এমনো মনে হয়েছে। এ কালের চীন পুঁজিবাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসেছে- এমনো ভাবছেন কেউ কেউ। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি যে সাধারণ প্রত্যাশার সব সীমা অতিক্রম করে চলছে সে কথাও অস্বীকার করতে পারছেন না কেউ। অস্বীকার করতে না পেরেই সাম্রাজ্যবাদের ভীতিও সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
পুঁজিবাদের পথে চলেই চীনের সমৃদ্ধি ঘটেছে, চীন একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে- কেউ কেউ এমন ভাবলেও সাম্রাজ্যবাদের ধারকদের ভাবনা মোটেই সে রকম নয়। তারা আসল ব্যাপারটি জানে ও বোঝে। চীন যে পুঁজিবাদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্য রকম। এটি বাধাহীন বা অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ নয়, কিংবা পুঁজিপতিরাও এর নিয়ন্তা নয়। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে পুঁজিপতিদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সর্বহারার একনায়কত্বের এটি একটি নতুন ধরনের নিরীক্ষা। এ নিরীক্ষা হয়তো খুবই বিপজ্জনক। বিপদের কিছু কিছু আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতিসহ পুঁজিবাদের সব অনিবার্য অনুষঙ্গীগুলোই চীনের সমাজে ইতিমধ্যেই কালিমা লেপন করে ফেলেছে। তবু যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই এ পুঁজিবাদের হালটি ধরা আছে, তাই সংগত রূপেই প্রত্যাশা করা যায় যে সব বিপদ কেটে যাবে, একটি বিশেষ সীমায় পৌঁছেই চীন পুঁজিবাদী পদ্ধতির নির্মোক খুলে ফেলবে ও সব কালিমা দূর হয়ে যাবে। অচিরেই পূর্বাচলের চীন সারা পৃথিবীতে সাম্যবাদী সমাজের অকলঙ্ক জ্যোতির বিস্তার ঘটিয়ে চলবে- আমাদের এমন প্রত্যাশা মোটেই অসম্ভবের প্রত্যাশা নয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য তো চীনের এ রকম অবস্থান্তর হবে একান্তই উদ্বেগজনক। আসলে চীন পুঁজিবাদী হলে সাম্রাজ্যবাদের জন্য তা মোটেই উদ্বেগ বা ভীতির কারণ হতে পারে না। তার উদ্বেগ ও ভয় পুঁজিবাদবিরোধী কমিউনিস্ট চীনকেই। এখনই এই উদ্বেগে ও ভয়ে আক্রান্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা অন্তর্ঘাতকের ভূমিকায় নেমে পড়েছে। চীনে যে মাঝেমধ্যে তথাকথিত মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা শোনা যায়, সেগুলো আসলে ওদেশে পুঁজিবাদকে চাঙ্গা করে তোলার লক্ষ্যে মার্কিন প্ররোচনাজাত অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ খানেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের গুরুত্ব। গণমনে সে গুরুত্বের বোধ যে সঞ্চারিত হচ্ছে, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। বিগত শতকের চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সভ্যতার সংকট থেকে যেভাবে মুক্তি ঘটেছিল, সে রকম সংগ্রাম করেই একালের নয়া সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সংকট থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই সংকটমুক্তির সূর্যটিকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েই আবার বলি : রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে রূপ দিয়েই ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ আরম্ভ হয়েছে 'পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।' নিঃসংশয় প্রত্যয়ে ঘোষণা করা যায় : সন্ত্রাস, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ, নারীর প্রতি অসদাচরণসহ আরো যেসব সংকট বর্তমানে মানবসভ্যতার ওপর অন্ধকারের বিস্তার ঘটিয়েছে, সে অন্ধকারও দূর হবে পূর্বাচলের অরুণ-আলোকেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
দুর্যোগমুক্ত কোনো যুগ পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। দুর্যোগবিহীন যুগ কোনো দিন আসবেও না। আবার প্রতি যুগেই যে মানুষ দুর্যোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, দুর্যোগের কবলমুক্ত হয়েই যে মানুষের বিজয়রথ ছুটে চলেছে যুগ হতে যুগান্তরের অভিমুখে- ইতিহাস তো আমাদের এমন কথাই জানিয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারেই, বর্তমান যুগেও, আমাদের দেশ তথা সমগ্র দুনিয়াই নানা ধরনের দুর্যোগকবলিত। সেসব দুর্যোগের মায়ার আড়ালেও নিত্যের জ্যোতি ঝলমল করছে।
আজকের পৃথিবীতে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে সর্বত্র। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের তাণ্ডব থেকে মুক্ত নয় কোনো দেশই। বিশ্বায়নের নাম করে সাম্রাজ্যবাদ তার হিংস্র নখরে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে পুরো বিশ্বকে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতার চাবিকাঠিটি লুটপাটতন্ত্রীদের করায়ত্ত। নারীর প্রতি সহিংসতা ও জঘন্য অসদাচরণের যে নগ্ন প্রকাশ এখানে-ওখানে ঘটছে, তেমনটি আগেকার কোনোকালেই দেখা যায়নি বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করছেন। ক্রমাগতই এ রকম আরো দুর্যোগের উদ্ভব ঘটে চলেছে। তবু দুর্যোগই যে একান্ত সত্য নয়, দুর্যোগ প্রতিরোধের শক্তিও যে প্রবল প্রতাপে জেগে ওঠে নতুন যুগের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে, সে সত্য থেকেও তো আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না।
বিষয়টি উপলব্ধির জন্যই আবার ফিরে যাই রবীন্দ্র প্রসঙ্গে। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনে কবিগুরু তাঁর জীবনের শেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন। 'সভ্যতার সংকট' শীর্ষক সেই ভাষণটি আজও সব সংকটের অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোকশিখা রূপে দেদীপ্যমান। যে সময়ে ওই ভাষণটি প্রদত্ত হয়েছিল, সে সময়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত এক দানব মহাতাণ্ডব সৃষ্টি করে মানবসভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল সেদিন। অচিরেই মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে- এমন দুর্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মানবপ্রেমিক মনীষী। শঙ্কা রবীন্দ্রনাথের চিত্তকেও স্পর্শ করেছিল বৈকি। কিন্তু তাঁর সত্তা তো ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। সত্যকে তিনি অবলোকন করতেন অখণ্ড দৃষ্টিতে এবং সত্যের প্রতিটি খণ্ডাংশেও সেই অখণ্ডের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতেন। সে কারণেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, নিজের মৃত্যুর প্রায় পূর্বক্ষণে, সভ্যতার অচিন্তনীয় সংকটেরও ভেতরে ক্রিয়াশীল সংকট উত্তরণের শক্তিটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাই তিনি একান্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন-
'পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই। ... মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।'
আমরাই বা আজকের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একেই চূড়ান্ত মনে করে এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অপরাধী হয়ে উঠব কেন? আমরা তো দেখেছি; অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে, সভ্যতাবিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ঘটেছে, মানুষের সভ্যতা নতুনতর দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর সেসবই করেছে মানুষ- 'অপরাজিত মানুষ'। সেই মানুষ নিশ্চয়ই নিশ্চল হয়ে নেই এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চল হয়ে থাকবে না।
'ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে'- রবীন্দ্রনাথের এই প্রত্যয়দীপ্ত প্রত্যাশার আলোটিকেও তো আমরা জ্বলে উঠতে দেখছি। পূর্বাচল বা প্রাচ্যদেশই আজ অমিত সম্ভাবনায় জেগে উঠেছে। অন্যদিকে পশ্চিম বা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে এর বিপরীত পরিস্থিতি। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে অভূতপূর্ব ও অচিন্তিতপূর্ব বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পরপরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অমিত তেজে জ্বলে ওঠার ব্যাপারটি ছিল নিতান্তই স্ফুলিঙ্গের মতো। সেই স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় ক্ষণকালের ছন্দ পেয়ে অচিরেই উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে। ওদের বিশ্বায়নের বড়ফট্টাই আজ খুব একটা কাজে আসছে না। আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নগ্ন হস্তক্ষেপ (কিংবা ইরানে সে রকম হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি) তাদের মানবতাবিরোধী চরিত্রের স্বরূপই উদ্ঘাটন করছে কেবল, এসবের ভেতর দিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বিপত্তিগুলোর সামান্য অবসানও ঘটছে না। তথাকথিত বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেই গণ-অসন্তোষের ক্রমবিস্তার ঘটে চলছে। অর্থাৎ পূর্বাচলে নব সূর্যোদয়ের বিপরীতে পশ্চিমে সূর্য আজ অস্তাচলে।
পূর্বাচলে নব অরুণোদয়ের কথা বলে বলে আমরাই যে কেবল আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইছি তা কিন্তু নয়। পশ্চিম দেশেরও অনেক বিজ্ঞজনের আজ চোখ পড়েছে পূর্ব দিগন্তে। রবীন্দ্রনাথ 'আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে' যার আসন্ন জন্মদিনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই 'পরিত্রাণকর্তা'র আবির্ভাব সত্য সত্যই ঘটে গেছে- এমনটিই দেখতে পাচ্ছেন পাশ্চাত্যের অনেক নামজাদা অর্থনীতিবিদ। রবীন্দ্রনাথ-কথিত এই পরিত্রাণকর্তা কোনো দৈবাদেশপ্রাপ্ত অতি মানুষ নন। অতি সাধারণ মানুষরাই পরিত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হয়ে এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলছেন যে পশ্চিমের অনেক অর্থনীতিবিদই অবাক হয়ে গেছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই তাঁদের এই অবাক হয়ে যাওয়ার খবর প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁরা পাশ্চাত্যের অর্থনীতিতে দেখছেন স্থবিরতা, আর প্রাচ্যে বিরামহীন গতিময়তা। প্রাচ্য তো পাশ্চাত্যের নয়া সাম্রাজ্যবাদ তথা বিশ্বায়নের জাঁতাকলে পড়ে ক্রমাগতই শোষিত ও বিপর্যস্ত্ত হচ্ছে। তবু কী করে সেই প্রাচ্য প্রতীচ্যকে ছাড়িয়ে যেতে উদ্যত হতে পারছে? এই প্রশ্নই বোধ হয় প্রতীচ্যের বিজ্ঞজনদের তাড়িত করে চলেছে। তাই তাঁদের এমন অবাক বিস্ময়।
বিজ্ঞজনদের এ রকম বিস্ময়সূচক প্রত্যক্ষণ খুবই বিচলিত ও শঙ্কিত করে তুলেছে সাম্রাজ্যবাদের ধারক-বাহকদের। তারা এর প্রতিরোধে একেবারে মরিয়া হয়ে নানা কুটিল খেলা খেলতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রাচ্যে চীনের শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি তাদের অন্তরে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। চীন তার চলার পথে অনেক ভুল করেছে অবশ্যই। 'মহা উল্লম্ফনের' হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে একবার সে মহাবিপর্যয়কে আমন্ত্রণ করে এনেছিল। আরেকবার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে সংস্কৃতি ধ্বংসের আয়োজনেই মেতে উঠেছিল। চৈনিক নেতারা প্রায়ই চিন্তা ও কর্মের এক মেরু থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে চলে যান- কখনো কখনো এমনো মনে হয়েছে। এ কালের চীন পুঁজিবাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসেছে- এমনো ভাবছেন কেউ কেউ। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি যে সাধারণ প্রত্যাশার সব সীমা অতিক্রম করে চলছে সে কথাও অস্বীকার করতে পারছেন না কেউ। অস্বীকার করতে না পেরেই সাম্রাজ্যবাদের ভীতিও সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
পুঁজিবাদের পথে চলেই চীনের সমৃদ্ধি ঘটেছে, চীন একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে- কেউ কেউ এমন ভাবলেও সাম্রাজ্যবাদের ধারকদের ভাবনা মোটেই সে রকম নয়। তারা আসল ব্যাপারটি জানে ও বোঝে। চীন যে পুঁজিবাদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্য রকম। এটি বাধাহীন বা অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ নয়, কিংবা পুঁজিপতিরাও এর নিয়ন্তা নয়। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে পুঁজিপতিদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সর্বহারার একনায়কত্বের এটি একটি নতুন ধরনের নিরীক্ষা। এ নিরীক্ষা হয়তো খুবই বিপজ্জনক। বিপদের কিছু কিছু আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতিসহ পুঁজিবাদের সব অনিবার্য অনুষঙ্গীগুলোই চীনের সমাজে ইতিমধ্যেই কালিমা লেপন করে ফেলেছে। তবু যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই এ পুঁজিবাদের হালটি ধরা আছে, তাই সংগত রূপেই প্রত্যাশা করা যায় যে সব বিপদ কেটে যাবে, একটি বিশেষ সীমায় পৌঁছেই চীন পুঁজিবাদী পদ্ধতির নির্মোক খুলে ফেলবে ও সব কালিমা দূর হয়ে যাবে। অচিরেই পূর্বাচলের চীন সারা পৃথিবীতে সাম্যবাদী সমাজের অকলঙ্ক জ্যোতির বিস্তার ঘটিয়ে চলবে- আমাদের এমন প্রত্যাশা মোটেই অসম্ভবের প্রত্যাশা নয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য তো চীনের এ রকম অবস্থান্তর হবে একান্তই উদ্বেগজনক। আসলে চীন পুঁজিবাদী হলে সাম্রাজ্যবাদের জন্য তা মোটেই উদ্বেগ বা ভীতির কারণ হতে পারে না। তার উদ্বেগ ও ভয় পুঁজিবাদবিরোধী কমিউনিস্ট চীনকেই। এখনই এই উদ্বেগে ও ভয়ে আক্রান্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা অন্তর্ঘাতকের ভূমিকায় নেমে পড়েছে। চীনে যে মাঝেমধ্যে তথাকথিত মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা শোনা যায়, সেগুলো আসলে ওদেশে পুঁজিবাদকে চাঙ্গা করে তোলার লক্ষ্যে মার্কিন প্ররোচনাজাত অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ খানেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের গুরুত্ব। গণমনে সে গুরুত্বের বোধ যে সঞ্চারিত হচ্ছে, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। বিগত শতকের চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সভ্যতার সংকট থেকে যেভাবে মুক্তি ঘটেছিল, সে রকম সংগ্রাম করেই একালের নয়া সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সংকট থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই সংকটমুক্তির সূর্যটিকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েই আবার বলি : রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে রূপ দিয়েই ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ আরম্ভ হয়েছে 'পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।' নিঃসংশয় প্রত্যয়ে ঘোষণা করা যায় : সন্ত্রাস, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ, নারীর প্রতি অসদাচরণসহ আরো যেসব সংকট বর্তমানে মানবসভ্যতার ওপর অন্ধকারের বিস্তার ঘটিয়েছে, সে অন্ধকারও দূর হবে পূর্বাচলের অরুণ-আলোকেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
No comments