রাষ্ট্র ও সমাজ- জাতীয় নিরাপত্তা বনাম নাগরিক নিরাপত্তা by এম সাখাওয়াত হোসেন
আমরা প্রায়ই জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলি বা অনেক সময় বিজ্ঞজনের কাছ থেকে শুনে থাকি। সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি একটি বিশেষ ধারণার (কনসেপ্ট) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধারণাটি হলো, জাতীয় নিরাপত্তা মানে হচ্ছে, সামরিক বাহিনী আর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা।
বিষয়টি আসলে তা নয়। যদিও জাতীয় নিরাপত্তার ধারণাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানী তথা মিলিটারি-কূটনীতিকদের উদ্ভাবনা; তবে ওই ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন হয় শীতল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই। এ ধারণার ব্যাপকতা আরও প্রসারিত হয় শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই।
বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় বা ধারণায় এবং এর ব্যাপকতায় জাতীয় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তার ধারণায় (কনসেপ্ট) সামরিক বাহিনী তথা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টি অনেকটা গৌণ হয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো প্রধান উপাদান বলে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, শুধু বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকেই নয়, একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার উপাদানের জন্য। এর উদাহরণ আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের তথা আফ্রিকার বহু দেশ। এসব দেশের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলেই প্রতীয়মান হবে যে অতীতে দেশগুলোর নীতিনির্ধারক তথা নেতারা জাতীয় নিরাপত্তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের তোয়াক্কাই করেননি। এসব দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সর্বোপরি নাগরিক নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্নিহিত উপাদানগুলোর মূলে রয়েছে নাগরিক নিরাপত্তা। নাগরিক নিরাপত্তার জন্যই রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ। এই নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত খাদ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে ব্যক্তিনিরাপত্তা আর সে কারণেই সার্বভৌম রাষ্ট্র। যা হোক, এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার আজকের লেখা নয়। আমার নিবন্ধে অতি সংক্ষেপে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তার দু-একটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এ আলোচনার ক্ষেত্র সীমিত রাখতে ব্যক্তিনিরাপত্তার চর্চার মধ্যেই থাকতে চাই।
আগেই যেমন বলেছি, শাসনব্যবস্থা (গভর্ন্যান্স) আর নাগরিক নিরাপত্তা (হিউম্যান সিকিউরিটি) দুটো জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে সুশাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতিসংঘের সংজ্ঞানুসারে নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মানবিক বিষয়, অর্থনীতি এবং সামাজিক-আঙ্গিক ইত্যাদি জড়িত, যার মাধ্যমে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে এর কয়েকটি উপাদান চিহ্নিত করেছে। যেগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত সন্ত্রাস থেকে নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপশাসন। রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ; যদিও অপশাসনের তেমন প্রণিধানযোগ্য সংজ্ঞা নেই; তবে নাগরিক নিরাপত্তা সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তা এ বিষয়ে জাতিসংঘের ইউএনডিপির সম্পৃক্ততা থেকেই প্রতীয়মান।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার তেমন চর্চা হতে দেখা যায় না। আলোচনা হয় শুধু দু-একটি প্রতিষ্ঠানে; তবে সেসব প্রতিষ্ঠানেও বেশির ভাগ সময় সার্বভৌমত্ব এবং কিছু অন্যান্য উপাদান নিয়েই আলোচনা হয়। আলোচনায় এখনো মাত্রা পায়নি অপ্রচলিত নিরাপত্তা (নন-ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি—এনটিএস)। অপ্রচলিত নিরাপত্তার গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হলো, জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন বেসামরিক হুমকি (নন মিলিটারি থ্রেট), যেখানে ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়টিও অন্যতম উপাদান। আমাদের দেশে সবেমাত্র কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে এ বিষয়ে চর্চা শুরু হয়েছে মাত্র।
নাগরিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের। নাগরিক নিরাপত্তার অন্যান্য উপাদানের মধ্যে দুটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে চাই। এই দুটি উপাদান হলো ব্যক্তির অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। তবে আমাদের সামনে ব্যক্তিনিরাপত্তার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা সুখকর নয়।
ব্যক্তিনিরাপত্তা নিয়ে যদি মোটা দাগে আলোচনা করা যায়, প্রথমেই উঠে আসবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর ব্যাপক দুর্নীতি। দ্বিতীয়টি ব্যক্তিনিরাপত্তা। এই দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা গত দুই দশকে ব্যক্তিনিরাপত্তা আশানুরূপভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি।
ধাপে ধাপে জ্বালানি তেলের এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা একধরনের উদাসীনতাই দেখাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সাফাই গাইতে গিয়ে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী যখন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কম, তখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, ওই সব দেশের মাথাপিছু আয় কত? জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি যখন কাঁচাবাজারের দাম স্ফীত করে, তখন এর জবাব রাষ্ট্রের কাছে থাকে না। একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্য। সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা নেই—এমনটাই পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়। সে ক্ষেত্রে সরকারি অপচয় আর দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে তেমন পদক্ষেপ জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না।
ব্যক্তিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে এককথায় বলা যেতে পারে, বিগত দুই দশক থেকে ব্যক্তিনিরাপত্তা এমন স্থানে পৌঁছেছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে রাষ্ট্রের বা সরকারের কোনো কিছু করার নেই। একধরনের অসহায়ত্ববোধ এমনটা আজকের কথা নয়, গত ২২ বছর ধরেই সব সরকার কম-বেশি দোষী। আমরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে সুশাসন খুঁজেছিলাম কিন্তু আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা থেকে হালের সাংবাদিক দম্পতি হত্যা এবং অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বা বিচার না হওয়ার কারণে সমাজে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় গুম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে নাগরিক হত্যা। পুলিশের হ্যান্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় একজন বিরোধীদলীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার লাশ উদ্ধার ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়টিকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তেমনি বহু
ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করে না।
ব্যক্তিনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আরেকটি ভয়াবহ রূপ, যা অনেককেই চিহ্নিত করে তুলেছে; তা হচ্ছে নারী ধর্ষণ। এ ধরনের ঘটনা শুধু ব্যক্তিনিরাপত্তাই নয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অবক্ষয়ের ক্রমবর্ধমান রূপ। এখানেও রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে তেমন তৎপর হতে দেখা যায় না। হালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ঘটনায় যেভাবে সরকারকে নাড়া দেওয়া হয়েছিল, তেমন নাগরিক প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে দেখা যায়নি। এখানেই প্রতীয়মান হয়, বিষয়টি সমাজপতিরা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে এখনো গ্রহণ করেননি। যে ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তার মাধ্যমে ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার হুমকি আর কী হতে পারে?
আমাদের নাগরিকের অব্যাহত সীমান্তে হত্যা আমাদের কতখানি নাড়া দিয়েছে? কতখানি নাড়া দিয়েছে সরকার অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে? দুঃখ হয়, যখন পরিসংখ্যান দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একে অপরকে দোষারোপ করে, দুঃখ হয় যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা এ ধরনের হত্যার তাৎক্ষণিক নিন্দা না জানিয়ে যুক্তি উত্থাপন করেন। হয়তো ভুলে যান, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাদের মৌলিক কর্তব্য। শুধু জাতীয় নিরাপত্তাই নয়, সুশাসন কায়েম করাও তাদের দায়িত্ব।
আমি প্রবন্ধটি শেষ করব জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করে। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা বিপর্যয়ের ভয়াবহ রূপের, যা সাধারণত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার উপাদানগুলো পর্যুদস্ত হওয়ার কারণেই ঘটে। সাধারণত ওই ধরনের পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়। গৃহযুদ্ধ সাধারণত সংঘটিত হয় যখন জাতীয় নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘটে, যার কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও সরকার ভেঙে পড়ে। গৃহযুদ্ধ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বিনষ্ট করতে পারে আর অখণ্ডতা বিনষ্ট না হলেও একটি সার্বভৌম দেশকে ব্যর্থ অথবা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। কাজেই আমরা যখনই গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করি, অতি সহজে উচ্চারণ করি, হয়তো এতখানি গভীরে চিন্তা করি না।
আমি এ প্রসঙ্গ এখানে টানলাম এ কারণে যে অনেকেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধের আলামত হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। যেসব দেশ গৃহযুদ্ধের মধ্যে থেকেছে বা আছে, তাদের সার্বভৌমত্ব ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও খর্ব হয়েছে। আমি মনে করি না, আমাদের দেশে এখনো সে ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তবে যা ঘটে চলেছে, তা অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করছে। দেশের রাজনৈতিক বিভাজন এখন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি এখন জেদাজেদি ও অহংবোধের মধ্যে রয়েছে। যার বলি হচ্ছে ব্যক্তিনিরাপত্তা ও মানবাধিকার।
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের হলেও সমাজ-সচেতন না হলে নিশ্চয়তা সম্ভব নয়। সমাজ-সচেতনতার জন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণের। সামাজিক জাগরণের অভাবে ধর্ষণ, গুম আর হত্যার মধ্যে নাগরিক নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে। সরকার তথা দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব জাতীয় নিরাপত্তা তথা অপ্রচলিত নিরাপত্তা সূদৃঢ় করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা করা। আরও প্রয়োজন অধিকতর সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার।
hhinrlbd@yahoo.com
বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় বা ধারণায় এবং এর ব্যাপকতায় জাতীয় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তার ধারণায় (কনসেপ্ট) সামরিক বাহিনী তথা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টি অনেকটা গৌণ হয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো প্রধান উপাদান বলে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, শুধু বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকেই নয়, একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার উপাদানের জন্য। এর উদাহরণ আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের তথা আফ্রিকার বহু দেশ। এসব দেশের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলেই প্রতীয়মান হবে যে অতীতে দেশগুলোর নীতিনির্ধারক তথা নেতারা জাতীয় নিরাপত্তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের তোয়াক্কাই করেননি। এসব দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সর্বোপরি নাগরিক নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্নিহিত উপাদানগুলোর মূলে রয়েছে নাগরিক নিরাপত্তা। নাগরিক নিরাপত্তার জন্যই রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ। এই নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত খাদ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে ব্যক্তিনিরাপত্তা আর সে কারণেই সার্বভৌম রাষ্ট্র। যা হোক, এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার আজকের লেখা নয়। আমার নিবন্ধে অতি সংক্ষেপে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তার দু-একটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এ আলোচনার ক্ষেত্র সীমিত রাখতে ব্যক্তিনিরাপত্তার চর্চার মধ্যেই থাকতে চাই।
আগেই যেমন বলেছি, শাসনব্যবস্থা (গভর্ন্যান্স) আর নাগরিক নিরাপত্তা (হিউম্যান সিকিউরিটি) দুটো জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে সুশাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতিসংঘের সংজ্ঞানুসারে নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মানবিক বিষয়, অর্থনীতি এবং সামাজিক-আঙ্গিক ইত্যাদি জড়িত, যার মাধ্যমে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে এর কয়েকটি উপাদান চিহ্নিত করেছে। যেগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত সন্ত্রাস থেকে নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপশাসন। রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ; যদিও অপশাসনের তেমন প্রণিধানযোগ্য সংজ্ঞা নেই; তবে নাগরিক নিরাপত্তা সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তা এ বিষয়ে জাতিসংঘের ইউএনডিপির সম্পৃক্ততা থেকেই প্রতীয়মান।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার তেমন চর্চা হতে দেখা যায় না। আলোচনা হয় শুধু দু-একটি প্রতিষ্ঠানে; তবে সেসব প্রতিষ্ঠানেও বেশির ভাগ সময় সার্বভৌমত্ব এবং কিছু অন্যান্য উপাদান নিয়েই আলোচনা হয়। আলোচনায় এখনো মাত্রা পায়নি অপ্রচলিত নিরাপত্তা (নন-ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি—এনটিএস)। অপ্রচলিত নিরাপত্তার গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হলো, জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন বেসামরিক হুমকি (নন মিলিটারি থ্রেট), যেখানে ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়টিও অন্যতম উপাদান। আমাদের দেশে সবেমাত্র কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে এ বিষয়ে চর্চা শুরু হয়েছে মাত্র।
নাগরিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের। নাগরিক নিরাপত্তার অন্যান্য উপাদানের মধ্যে দুটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে চাই। এই দুটি উপাদান হলো ব্যক্তির অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। তবে আমাদের সামনে ব্যক্তিনিরাপত্তার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা সুখকর নয়।
ব্যক্তিনিরাপত্তা নিয়ে যদি মোটা দাগে আলোচনা করা যায়, প্রথমেই উঠে আসবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর ব্যাপক দুর্নীতি। দ্বিতীয়টি ব্যক্তিনিরাপত্তা। এই দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা গত দুই দশকে ব্যক্তিনিরাপত্তা আশানুরূপভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি।
ধাপে ধাপে জ্বালানি তেলের এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা একধরনের উদাসীনতাই দেখাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সাফাই গাইতে গিয়ে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী যখন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কম, তখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, ওই সব দেশের মাথাপিছু আয় কত? জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি যখন কাঁচাবাজারের দাম স্ফীত করে, তখন এর জবাব রাষ্ট্রের কাছে থাকে না। একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্য। সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা নেই—এমনটাই পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়। সে ক্ষেত্রে সরকারি অপচয় আর দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে তেমন পদক্ষেপ জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না।
ব্যক্তিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে এককথায় বলা যেতে পারে, বিগত দুই দশক থেকে ব্যক্তিনিরাপত্তা এমন স্থানে পৌঁছেছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে রাষ্ট্রের বা সরকারের কোনো কিছু করার নেই। একধরনের অসহায়ত্ববোধ এমনটা আজকের কথা নয়, গত ২২ বছর ধরেই সব সরকার কম-বেশি দোষী। আমরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে সুশাসন খুঁজেছিলাম কিন্তু আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা থেকে হালের সাংবাদিক দম্পতি হত্যা এবং অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বা বিচার না হওয়ার কারণে সমাজে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় গুম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে নাগরিক হত্যা। পুলিশের হ্যান্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় একজন বিরোধীদলীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার লাশ উদ্ধার ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়টিকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তেমনি বহু
ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করে না।
ব্যক্তিনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আরেকটি ভয়াবহ রূপ, যা অনেককেই চিহ্নিত করে তুলেছে; তা হচ্ছে নারী ধর্ষণ। এ ধরনের ঘটনা শুধু ব্যক্তিনিরাপত্তাই নয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অবক্ষয়ের ক্রমবর্ধমান রূপ। এখানেও রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে তেমন তৎপর হতে দেখা যায় না। হালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ঘটনায় যেভাবে সরকারকে নাড়া দেওয়া হয়েছিল, তেমন নাগরিক প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে দেখা যায়নি। এখানেই প্রতীয়মান হয়, বিষয়টি সমাজপতিরা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে এখনো গ্রহণ করেননি। যে ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তার মাধ্যমে ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার হুমকি আর কী হতে পারে?
আমাদের নাগরিকের অব্যাহত সীমান্তে হত্যা আমাদের কতখানি নাড়া দিয়েছে? কতখানি নাড়া দিয়েছে সরকার অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে? দুঃখ হয়, যখন পরিসংখ্যান দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একে অপরকে দোষারোপ করে, দুঃখ হয় যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা এ ধরনের হত্যার তাৎক্ষণিক নিন্দা না জানিয়ে যুক্তি উত্থাপন করেন। হয়তো ভুলে যান, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাদের মৌলিক কর্তব্য। শুধু জাতীয় নিরাপত্তাই নয়, সুশাসন কায়েম করাও তাদের দায়িত্ব।
আমি প্রবন্ধটি শেষ করব জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করে। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা বিপর্যয়ের ভয়াবহ রূপের, যা সাধারণত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার উপাদানগুলো পর্যুদস্ত হওয়ার কারণেই ঘটে। সাধারণত ওই ধরনের পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়। গৃহযুদ্ধ সাধারণত সংঘটিত হয় যখন জাতীয় নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘটে, যার কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও সরকার ভেঙে পড়ে। গৃহযুদ্ধ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বিনষ্ট করতে পারে আর অখণ্ডতা বিনষ্ট না হলেও একটি সার্বভৌম দেশকে ব্যর্থ অথবা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। কাজেই আমরা যখনই গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করি, অতি সহজে উচ্চারণ করি, হয়তো এতখানি গভীরে চিন্তা করি না।
আমি এ প্রসঙ্গ এখানে টানলাম এ কারণে যে অনেকেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধের আলামত হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। যেসব দেশ গৃহযুদ্ধের মধ্যে থেকেছে বা আছে, তাদের সার্বভৌমত্ব ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও খর্ব হয়েছে। আমি মনে করি না, আমাদের দেশে এখনো সে ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তবে যা ঘটে চলেছে, তা অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করছে। দেশের রাজনৈতিক বিভাজন এখন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি এখন জেদাজেদি ও অহংবোধের মধ্যে রয়েছে। যার বলি হচ্ছে ব্যক্তিনিরাপত্তা ও মানবাধিকার।
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের হলেও সমাজ-সচেতন না হলে নিশ্চয়তা সম্ভব নয়। সমাজ-সচেতনতার জন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণের। সামাজিক জাগরণের অভাবে ধর্ষণ, গুম আর হত্যার মধ্যে নাগরিক নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে। সরকার তথা দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব জাতীয় নিরাপত্তা তথা অপ্রচলিত নিরাপত্তা সূদৃঢ় করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা করা। আরও প্রয়োজন অধিকতর সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার।
hhinrlbd@yahoo.com
No comments