পেরিয়ে গেল জহির রায়হানের অনত্মর্ধান দিবস
প্রায় নীরবেই পেরিয়ে গেল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতীম তারম্নণ্যম-িত নির্মাতা লেখক জহির রায়হানের অনর্ত্মধান দিবসটি। মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশে অগ্রজ কথাশিল্পী শহীদুলস্নাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে সেই ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারিতে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৫ এর ১৯ আগস্ট এদেশের প্রবাদপ্রতীম চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জহির রায়হান জন্মেছিলেন বর্তমান ফেনির মাজুপুর গ্রামে। দেশ বিভাগের পরে বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে জহির রায়হান ফিরে এসেছিলেন তার পৈত্রিক ভিটিতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স জহির রায়হান প্রথমে সুমিতা দেবী এবং পরবর্তীতে অভিনেত্রী সুচন্দার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে এই অসামান্য নির্মাতা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ের পত্রিকা 'যুগের আলো'তে। পরবর্তীতে অবশ্য জহির রায়হান 'খাপছাড়া', 'যান্ত্রিক', 'সিনেমা' প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৫৬ সালে 'প্রবাহ' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন তিনি। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'সূর্যগ্রহণ' যা সেসময় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল, প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। জহির রায়হান চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৫৭ সালে জাগো হুয়া সাভেরার মাধ্যমে। সালাহউদ্দীনের ছবি 'যে নদী মরম্নপথে'ও তিনি কাজ করেছিলেন। প্রখ্যাত পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে 'এ দেশ তোমার আমার' ছবিতে জহির রায়হান শুধু কাজই করেননি, এর টাইটেল সংগীতটিও তিনিই করেছিলেন।১৯৬০ সালে তিনি নির্মাতা হিসেবে 'কখনও আসেনি' ছবিটি নির্মাণ করেন। তার নির্মিত 'সঙ্গম' ছবিটি তৎকালীন পাকিসত্মানের প্রথম রঙিন ছবি। ১৯৬৫ সালে সে সময়ের পাকিসত্মানের প্রথম সিনেমাস্কোপিক ছবি 'বাহানা'ও বানিয়েছিলেন তিনিই।
জহির রায়হান '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব তার ভেতরে এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি তার বিখ্যাত ছবি 'জীবন থেকে নেয়া' বানিয়েছিলেন বাঙালী জীবনের অবিচ্ছেদ্য গৌরবের এই বিষয়টিকে নিয়েই।
'৬৯-এর গণঅভু্যত্থানে সক্রিয় থেকেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণই কেবল করেননি তার নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড' পৃথিবীর মানুষের কাছে শতাব্দীর এই নির্মম গণহত্যা আর নিপীড়নকে তুলে ধরেছিল। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুনে, বরফ গলা নদী, আর কতদিন, কয়েকটি মৃতু্য, তৃষ্ণা। জহির রায়হান ১৯৬২ সালে কলিম শরাফীর সঙ্গে যুগ্মভাবে নির্মাণ করেছিলেন সোনার কাজল। এছাড়া ১৯৬৩ সালে কাঁচের দেয়াল, ১৯৬৬ সালে বেহুলা, আনোয়ারা, দুইভাই, লেট দেয়ার বি লাইট তার উলেস্নখযোগ্য নির্মাণ। স্টপ জেনোসাইড ছাড়াও তিনি বানিয়েছিলেন বার্থ অফ এ নেশন। এছাড়া লিবারেশন ফাইটার্স, ইনোসেন্ট মিলিয়নসহ আরও কয়েকটি কাজ তার নির্মাণাধীন ছিল। আদমজী পুরস্কার ছাড়াও জহির রায়হান ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, ঋত্তিক ঘটক সবাই এই কিংবদনত্মি্ত্রতীম তরম্নণ নির্মাতার ছবির প্রশংসা করতেন।
'স্টপ জেনোসাইড' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালে ১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। পাকিসত্মানী শাসকদের নির্যাতনে বিতাড়িত আশ্রয়হীন অগণন বাঙালী যারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন; তাদের দুঃখ-দুর্দশা, হানাদার পাকিসত্মানী সামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকাল প্রভৃতি বিষয় এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল। জহির রায়হান ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, চলমান গণহত্যা ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরম্নদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার জন্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সহকারী আলমগীর কবিরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি স্টপ জেনোসাইড-এর কাজ শুরম্ন করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও চলচ্চিত্র বিভাগ আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছিল। দেশের মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার চেতনায় সমৃদ্ধ 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিটি অমর করেছে জহির রায়হানকে। ১৯৭০ সালে মুক্তির আগেই ছবিটি রাজরোষের শিকার হয়। পশ্চিম পাকিসত্মান সরকার এটি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তবে প্রবল জনমতের কাছে অসহায় ইয়াহিয়া সরকার শেষ পর্যনত্ম ছবিটি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। মহান ভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের প্রাণ-রসায়ন ছিল 'জীবন থেকে নেয়া'। সেই রসায়ন বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামে তীব্র গতিবেগ সঞ্চার করেছিল।
No comments