শ্রদ্ধাঞ্জলি- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জাহানারা ইমাম by শাহরিয়ার কবির
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয় নিয়ে আলোচনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারণের আগেই।
১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তাঞ্চলের জেলা প্রশাসকদের চিঠি লিখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারা হানাদারমুক্ত রাজধানীতে ফিরে এসে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম জনসভায় মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের কথা বলেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকার রাজপথে প্রথম মিছিলটি হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবিতে। ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মারকপত্র দিয়েছিলেন। সেই মিছিলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিধবা স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম, মুক্তিযুদ্ধে যিনি হারিয়েছিলেন তাঁর পুত্র ও স্বামীকে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, যখন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে থেকে গিয়েছিলেন ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় আসন্ন জেনে নভেম্বরেই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়েও গণহত্যায় প্ররোচিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অপরাধে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় গোলাম আযম ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইউরোপে ঘুরে ঘুরে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। ১৯৮১ সালে আত্মগোপনে থাকাকালে গোলাম আযম বায়তুল মোকাররমে এক জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। উপস্থিত মুসল্লিরা তাঁকে চিনতে পেরে জুতা ছুড়ে মারেন, যার ছবি সে সময়ের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
এহেন গোলাম আযমকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরউজ্জামান
১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ফল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। জিয়ার আমলে আত্মপ্রকাশ করলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে জামায়াত গোলাম আযমকে আমির ঘোষণা করেনি, ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে আব্বাস আলী খান দল পরিচালনা করতেন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে দলের প্রধান ঘোষণা করায় সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সংসদের ভেতর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। রাজপথে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিক্ষোভ মিছিল করে গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার ফল হচ্ছে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত এক অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন, যার যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে গোলাম আযমসহ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান প্রক্রিয়া।
১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি দেশের ১০১ জন বরেণ্য নাগরিক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করে গঠন করেছিলেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নৃশংসতম গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণ দিয়ে এই ঘোষণার শেষে বলা হয়েছিল—
আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয়, তাহলে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছে এ দেশের সমগ্র জনগণের কাছে, সেহেতু গণ-আদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান। এই গণ-আদালতেই পর্যায়ক্রমে বিচার করা হবে ’৭১-এর সব ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীর। একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছি একাত্তরের ঘাতকদের দল, যারা এখনো স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, সেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মব্যবসায়ীদের সব রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীদের, চিহ্নিত ঘাতকদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দোসরদের আজও খোঁজা হচ্ছে বিচারের জন্য, তাদের কোথাও ভোটাধিকার পর্যন্ত নেই। ঘাতকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। আমরা মনে করি, স্বাধীনতার শত্রুরা যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে বিচরণ করবে, তত দিন পর্যন্ত একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। আমাদের কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমই সফল হবে না। এ কারণেই স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
নির্মূল কমিটি গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগেই ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণ-আদালতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জাহানারা ইমাম গণ-আদালতের বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও বরেণ্য নাগরিকেরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের জন্য আয়োজিত গণ-আদালত বিশ্বব্যাপী গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে এক অনন্য সাধারণ সংযোজন দেশে ও বিদেশে শহীদজননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক সূচিত এই আন্দোলনের ২১তম বার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে ২০১৩-এর ১৯ জানুয়ারি।
গত ২১ বছরে নির্মূল কমিটিকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা, পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে প্রতিপক্ষের বহু প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাব দিতে হয়েছে জাহানারা ইমাম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের। বহুধা বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকে এই আন্দোলনের দাবি এক মঞ্চে সমবেত করেছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে নির্মূল কমিটির নেতা ও কর্মীদের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আন্দোলনের ওপর বাইরে থেকে যেমন আঘাত এসেছে, ভেতর থেকে অন্তর্ঘাতেরও বহু ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এই আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমরা আশা করছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের লোকবল ও রসদের যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ হলে ২০১৩ সালের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ১০ জনের বিচার সম্পন্ন হবে।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বানচাল করার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে ও বিদেশে যে বহুমাত্রিক তৎপরতা শুরু করেছিল, বিচারের রায়ের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, সেসব কর্মকাণ্ড ক্রমেই উগ্র ও সহিংস হচ্ছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের ওপর অতর্কিত চোরাগোপ্তা হামলার যেসব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ধারায় তা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন ষোলো আনা আত্মসাৎ করেছে জামায়াত। ১৫ জানুয়ারি ২০১৩ ঢাকা অচল করে দেওয়া বিএনপির মানবপ্রাচীর এবং এর আগের অন্যান্য কর্মসূচির সম্পূর্ণ শোডাউন ছিল জামায়াতের। সর্বত্র ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগান ছিল ট্রাইব্যুনাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে দলের নেতাদের মুক্ত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা-সংক্রান্ত। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তলিয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিরোধী স্লোগানের নিচে।
পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও আমেরিকার প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা জামায়াতের সহিংসতার অন্যতম উৎস। জামায়াতের বিশাল তহবিল, আগ্রাসী অপপ্রচার এবং প্রশাসনের জামায়াতীকরণের মোকাবিলায় সরকারের কোনো কার্যকর প্রতিরোধ দৃশ্যমান নয়। ২০১৩ সালের শুরুতে যদি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ‘জামায়াতে ইসলামী’ এবং ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড় না করানো হয়; জঙ্গি-সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য জামায়াতের রাজনীতি যদি নিষিদ্ধ না হয়, এর মাশুল শুধু মহাজোটকে নয়, সমগ্র জাতিকে দিতে হবে।
২১ বছর আগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূচনাপর্বে আমরা যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম, জামায়াত সম্পর্কে বর্তমান সরকারের দোদুল্যমানতা ও নমনীয়তা এই আশঙ্কা আরও বদ্ধমূল করছে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েকজন ব্যক্তির বিচার সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বন্ধ্যাগমনের মতো নিষ্ফল’ হতে বাধ্য। ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছে কখনো তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
শাহরিয়ার কবির: লেখক, কার্যনির্বাহী সভাপতি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকার রাজপথে প্রথম মিছিলটি হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবিতে। ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মারকপত্র দিয়েছিলেন। সেই মিছিলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিধবা স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম, মুক্তিযুদ্ধে যিনি হারিয়েছিলেন তাঁর পুত্র ও স্বামীকে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, যখন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে থেকে গিয়েছিলেন ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় আসন্ন জেনে নভেম্বরেই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়েও গণহত্যায় প্ররোচিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অপরাধে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় গোলাম আযম ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইউরোপে ঘুরে ঘুরে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। ১৯৮১ সালে আত্মগোপনে থাকাকালে গোলাম আযম বায়তুল মোকাররমে এক জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। উপস্থিত মুসল্লিরা তাঁকে চিনতে পেরে জুতা ছুড়ে মারেন, যার ছবি সে সময়ের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
এহেন গোলাম আযমকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরউজ্জামান
১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ফল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। জিয়ার আমলে আত্মপ্রকাশ করলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে জামায়াত গোলাম আযমকে আমির ঘোষণা করেনি, ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে আব্বাস আলী খান দল পরিচালনা করতেন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে দলের প্রধান ঘোষণা করায় সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সংসদের ভেতর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। রাজপথে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিক্ষোভ মিছিল করে গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার ফল হচ্ছে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত এক অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন, যার যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে গোলাম আযমসহ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান প্রক্রিয়া।
১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি দেশের ১০১ জন বরেণ্য নাগরিক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করে গঠন করেছিলেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নৃশংসতম গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণ দিয়ে এই ঘোষণার শেষে বলা হয়েছিল—
আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয়, তাহলে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছে এ দেশের সমগ্র জনগণের কাছে, সেহেতু গণ-আদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান। এই গণ-আদালতেই পর্যায়ক্রমে বিচার করা হবে ’৭১-এর সব ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীর। একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছি একাত্তরের ঘাতকদের দল, যারা এখনো স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, সেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মব্যবসায়ীদের সব রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীদের, চিহ্নিত ঘাতকদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দোসরদের আজও খোঁজা হচ্ছে বিচারের জন্য, তাদের কোথাও ভোটাধিকার পর্যন্ত নেই। ঘাতকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। আমরা মনে করি, স্বাধীনতার শত্রুরা যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে বিচরণ করবে, তত দিন পর্যন্ত একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। আমাদের কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমই সফল হবে না। এ কারণেই স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
নির্মূল কমিটি গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগেই ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণ-আদালতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জাহানারা ইমাম গণ-আদালতের বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও বরেণ্য নাগরিকেরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের জন্য আয়োজিত গণ-আদালত বিশ্বব্যাপী গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে এক অনন্য সাধারণ সংযোজন দেশে ও বিদেশে শহীদজননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক সূচিত এই আন্দোলনের ২১তম বার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে ২০১৩-এর ১৯ জানুয়ারি।
গত ২১ বছরে নির্মূল কমিটিকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা, পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে প্রতিপক্ষের বহু প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাব দিতে হয়েছে জাহানারা ইমাম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের। বহুধা বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকে এই আন্দোলনের দাবি এক মঞ্চে সমবেত করেছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে নির্মূল কমিটির নেতা ও কর্মীদের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আন্দোলনের ওপর বাইরে থেকে যেমন আঘাত এসেছে, ভেতর থেকে অন্তর্ঘাতেরও বহু ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এই আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমরা আশা করছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের লোকবল ও রসদের যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ হলে ২০১৩ সালের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ১০ জনের বিচার সম্পন্ন হবে।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বানচাল করার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে ও বিদেশে যে বহুমাত্রিক তৎপরতা শুরু করেছিল, বিচারের রায়ের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, সেসব কর্মকাণ্ড ক্রমেই উগ্র ও সহিংস হচ্ছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের ওপর অতর্কিত চোরাগোপ্তা হামলার যেসব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ধারায় তা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন ষোলো আনা আত্মসাৎ করেছে জামায়াত। ১৫ জানুয়ারি ২০১৩ ঢাকা অচল করে দেওয়া বিএনপির মানবপ্রাচীর এবং এর আগের অন্যান্য কর্মসূচির সম্পূর্ণ শোডাউন ছিল জামায়াতের। সর্বত্র ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগান ছিল ট্রাইব্যুনাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে দলের নেতাদের মুক্ত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা-সংক্রান্ত। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তলিয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিরোধী স্লোগানের নিচে।
পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও আমেরিকার প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা জামায়াতের সহিংসতার অন্যতম উৎস। জামায়াতের বিশাল তহবিল, আগ্রাসী অপপ্রচার এবং প্রশাসনের জামায়াতীকরণের মোকাবিলায় সরকারের কোনো কার্যকর প্রতিরোধ দৃশ্যমান নয়। ২০১৩ সালের শুরুতে যদি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ‘জামায়াতে ইসলামী’ এবং ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড় না করানো হয়; জঙ্গি-সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য জামায়াতের রাজনীতি যদি নিষিদ্ধ না হয়, এর মাশুল শুধু মহাজোটকে নয়, সমগ্র জাতিকে দিতে হবে।
২১ বছর আগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূচনাপর্বে আমরা যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম, জামায়াত সম্পর্কে বর্তমান সরকারের দোদুল্যমানতা ও নমনীয়তা এই আশঙ্কা আরও বদ্ধমূল করছে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েকজন ব্যক্তির বিচার সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বন্ধ্যাগমনের মতো নিষ্ফল’ হতে বাধ্য। ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছে কখনো তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
শাহরিয়ার কবির: লেখক, কার্যনির্বাহী সভাপতি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
No comments