কালের আয়নায়-দেশের রাজনীতিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
'ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি' কথাটিতে অনেকে বিশ্বাস করেন, অনেকে করেন না। আমি মাঝে মধ্যে করি। তবে ধর্মের মতো এই ব্যাপারেও আমি সংশয়বাদী। আমার ধারণা, ইতিহাস হয়তো মাঝে মধ্যে পুনরাবৃত্তি ঘটায়, কিন্তু আগেরবার যা ঘটেছে তা আবার পুরোপুরি ঘটায় না। একটু ওলটপালট করে।
এ জন্যই বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক পণ্ডিত সিনা ফুলিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, ২০১৪ সালে দেশে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সংসদে ৬০টি আসনও পাবে না, বরং ২০০১ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, আমি তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আশানুরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ নাও করতে পারে। কিন্তু বিএনপি ২০০১ সালের মতো নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের অধিকারী হয়ে ক্ষমতায় আসবে, তার সম্ভাবনাও আমি দেখি না।
লন্ডনের 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকা অবশ্য প্রেডিকশন করেছে, 'ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে খালেদা জিয়াই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।' এই ধরনের প্রেডিকশনকে বলা হয় 'সাংবাদিকতায় শুভঙ্করের ফাঁকি।' এই ফাঁকিবাজির সাংবাদিকতায় ব্রিটেনের চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর মুখপত্র 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকাটি সিদ্ধহস্ত। তাই চাতুর্যের সঙ্গে বলা হয়েছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হলে হবেন না।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি (২০০১ সালের) যে হবেই এ কথাটা 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকার কানে কানে কে বলে দিল? এটা সত্য, বাংলাদেশের আগামী সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনে ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। ইকোনমিস্টের আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশের একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ, তাদের নতুন-পুরনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং নিরপেক্ষতার ভেকধারী তাদের মুখপত্র দুটিকে আবার ২০০১ সালের নির্বাচনপূর্ব সময়ের মতো সক্রিয়, ঐক্যবদ্ধ এবং 'কাশিমবাজার কুঠিতে' সমবেত হতে দেখা যাচ্ছে।
এবার তাদের সঙ্গে নতুন কিছু মুখও জুটেছে। তার অর্থ এই নয় যে, ইতিহাস ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। যদি ঘটায়ও তাহলে হুবহু ঘটাবে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সবসময় হুবহু ঘটেছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিএনপিসহ সকল দলের অংশগ্রহণে যদি যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, তাহলেও ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। স্বল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতার মার্জিনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এখনও খুব বেশি; তবে আওয়ামী লীগ নানা কারণে নির্বাচনে সরাসরি ক্ষমতায় থাকার মতো জয়লাভ নাও করতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বিএনপি জয়ী হবে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েও সে জয়ী হতে পারবে না। এমনকি এরশাদ যদি মহাজোট ছাড়েন তাহলেও নয়।
তাহলে কী হবে? এই দুরূহ প্রশ্নটিরই জবাব ইতিহাসে অনুচ্চারিত রয়েছে। এখানে এসেই মানুষের বিচার-বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি ইতিহাসের কাছে হার মেনেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ভারতে বিজেপি কোয়ালিশন যখন দিলি্লতে ক্ষমতাসীন এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের সম্মুখীন, তখন তারা নির্বাচনপূর্ব 'ইন্ডিয়া শাইনিং' উৎসব শুরু করেছিল। প্রচার করছিল যে, বিজেপির শাসনামলে ভারতের এতই উন্নয়ন ঘটেছে যে, নির্বাচনে তারা নিরঙ্কুশ জয়ের অধিকারী হবে। দেশের অধিকাংশ মিডিয়া জনমত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে বলেছিল, বিজেপি বিরাট জয়ের অধিকারী হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফল হয়েছিল উল্টো। বিজেপির ভরাডুবি এবং কংগ্রেসের ক্ষমতা পুনর্দখল।
বর্তমান বাংলাদেশেও বিএনপির প্রচারডঙ্কা এত জোরেশোরে বাজছে এবং একশ্রেণীর নিরপেক্ষ মিডিয়া তাতে এত বেশি রসদ জোগাচ্ছে যে, মনে হতে পারে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি বুঝি অনিবার্য। আমি দেশে অবস্থানকালে দেখে বিস্মিত হয়েছি, অনেক আওয়ামী লীগার এবং দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেও এ কথা বিশ্বাস করেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি সুবিধা করতে না পারে, তবে দলের এই হতাশাবাদী সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্যই যে পারবে না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
তবে আমার গণনা অন্যখানে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আগামীতে ঘটানোর জন্য তখনকার একটি সুশীল সমাজ, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক, হাসিনাবিদ্বেষী প্রবীণ একদল নেতা, সুবিধাবাদী ও সুযোগ-সন্ধানী কিছু নতুন রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা এবং একশ্রেণীর তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া, বিশেষ করে একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক যেভাবে তখন জোট ও ঘোঁট পাকিয়েছিল, বর্তমানেও তেমনভাবে তারা সেই ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে। মনে হয়, ২০০১ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে তারা ছাড়বে না। কিন্তু আমার গণনায় এই চক্রান্ত সকল হবে না নানা কারণে। প্রথম কারণ, ২০০১ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০১৩ সালে নেই। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আগে জাতীয় পরিস্থিতির কথা বলি। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের সময় তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক এবং একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকের সম্পাদক, যাদের হাসিনাবিদ্বেষ সকল সীমা অতিক্রম করেছিল, তারা রাষ্ট্রপতির 'কনসাসকিপার' হয়ে উঠেছিলেন। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান প্রকাশ্যেই নিজের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বিগ মিডিয়ার অধিকাংশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। আর্মি ও ব্যুরোক্রেসির প্রভাবশালী অংশই বিএনপির পক্ষে কাজ করেছে। আর্মি আওয়ামী সমর্থক ও ভোটদাতাদের ঠ্যাঙানোর কাজেও অংশ নিয়েছে। গোটা দেশে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটদাতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগের অনুকূল ছিল না। আমেরিকায় নিউ কনজারভেটিভদের প্রার্থী জর্জ বুশ জুনিয়র প্রেসিডেন্ট পদে তখন বসেছেন এবং তাদের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার থিয়োরি অনুযায়ী বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো প্রয়োজন বলে তারা মনে করেছেন। জামায়াত তখন তাদের চোখে মডার্ন, ডেমোক্রেটিক মুসলিম দল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জঙ্গিবাদ ঠেকাতে সৌদি আরবের মদদে বাংলাদেশের জামায়াতিদের মার্কিন স্বার্থরক্ষায় কাজে লাগানো যাবে বলে তারা ধরে নিয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান মেরি বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঢাকায় টুয়েসডে টুয়েসডে ক্লাব আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ভারতে দিলি্লর ক্ষমতাসীনদের ভূমিকাও এ সময় ছিল রহস্যপূর্ণ। তারা বরের ঘরের পিসি এবং কনের ঘরের মাসির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের আইএসআই তখনও প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী এবং বিএনপিকে প্রবলভাবে মদদ জোগাচ্ছে। সৌদি বাদশাহরাও একই ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
২০১৩ সালে এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি রোগে-শোকে ও বয়সের ভারে কাতর হলেও ২০০১ সালের রাষ্ট্রপতির মতো 'দোদিল বান্দা' এবং 'কনসাসকিপারদের' দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত ব্যক্তি নন। তাকে বিভ্রান্ত বা বিপথগামী করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে আগের ধরনের কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি, যে সরকারকে তার প্রধান উপদেষ্টা (লতিফুর রহমান)সহ বিএনপি হাইজ্যাক করতে পারবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একবার বিচার বিভাগের লতিফুর রহমানের এবং আরেকবার সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইয়াজউদ্দিনের নির্লজ্জ ভূমিকা দেখার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা ও ভূমিকা সম্পর্কে শেখ হাসিনার মোহমুক্তি ঘটেছে এবং কোনো অবস্থাতেই তিনি এই ব্যর্থ ও বিএনপি দ্বারা ব্যবস্থায় ফিরে যেতে রাজি নন। এই সিদ্ধান্তে জনমতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যদি অটল থাকতে পারেন, তাহলে ২০১৪ সালে ২০০১ সালের চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটানো বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী এবং তাদের অনুগত সুশীল সমাজের পক্ষে সম্ভব হবে না। একশ্রেণীর 'নিরপেক্ষ' পত্রিকা গোষ্ঠীও পারবে না।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ২০০১ সালের চেয়ে বর্তমানের একটি বড় পরিবর্তন এই যে, ২০০১ সালে ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, কর্নেল (অব.) অলি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অথবা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নামধারী তাদের সহযোগী সুশীল সমাজের মাথাওয়ালা কয়েক ব্যক্তি এবং তাদের মুখপত্র একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক বর্তমানের মতো দেশের মানুষের কাছে এত বেশি এক্সপোজড হননি এবং তাদের মুখোশ খুলে পড়েনি। জনসাধারণকে তারা তখন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ও সম্পাদকের মুখোশ ধারণ করে সহজেই বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু গত বারো বছরে, বিশেষ করে এক-এগারোর ঘটনায় তারা আসলে কাদের লোক এবং কাদের স্বার্থের তল্পি বহন করছেন, তা সাধারণ মানুষের কাছেও ধরা পড়ে যাওয়ায় তাদের ক্ষতি করার শক্তি ও প্রভাব কমেছে এবং আগামী নির্বাচন যথাসময়ে বিনা প্রতিবন্ধকতায় অনুষ্ঠিত হলে হয়তো দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা মৃত ফসিলে পরিণত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে যে দু'একটি তরুণ মুখ এসে জড়ো হয়েছে, আগামী নির্বাচনে তাদের অবস্থা হয়তো দাঁড়াবে পাগলা মেহের আলীর মতো। তখন তাদের মুখে একটি বাক্যই শুধু শোনা যাবে। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, জনমনে ক্রমাগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং এখনও করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যে ইংরেজি ও বাংলা দুটি দৈনিক, ২০০১ সালে (জনসাধারণ তাদের আসল ভূমিকা ধরতে না পারা পর্যন্ত) তারা যে ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী ছিল, বর্তমানে তা তাদের নেই। পাঠকদের কাছে ক্রেডিবিলিটি না থাকলে কেবল প্রচার আধিক্য দ্বারা কোনো মিডিয়া জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার প্রমাণ, আমরা লন্ডনের টাইমস এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার বেলাতেও দেখি।
টাইমস গ্রুপ অব নিউজ পেপারের মালিক রুপার্ট মারডোককে এক সময় বলা হতো 'কিংস মেকার'_ টাইমস পত্রিকার প্রভাবের জোরে তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত বহু দেশের সরকারের উত্থান-পতন ঘটিয়েছেন। এই প্রভাব টাইমস পত্রিকার এখন আর নেই। তার কাটতি কমেনি, কিন্তু নানা অপসাংবাদিকতায় জড়িত হওয়ার অভিযোগ ওঠায় এই গ্রুপের সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বন্ধ হয়ে গেছে। টাইমসের ওপর জনআস্থাও দারুণভাবে কমেছে। ফলে সাম্প্রতিককালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নয়া নেতা নির্বাচনকালে বামঘেঁষা নেতা এড মিলিব্যান্ডের দারুণ বিরোধিতা করেও টাইমস কিছুই করতে পারেনি। এড মিলিব্যান্ড নির্বাচিত হয়েছেন।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাটির আজ একই অবস্থা। শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বলে আনন্দবাজারের দাবি। এই দাবি অদ্যাবধি মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আনন্দবাজার এককালে অঙ্গুলি ঘোরালে যে ক্ষমতাসীন সরকারকে বা তাদের না-পছন্দের কোনো রাজনৈতিক দলকে নাস্তানাবুদ করতে পারত, সেই ক্ষমতা আনন্দবাজারের নেই। নানা ধরনের অপসাংবাদিকতায় তার স্বরূপ পাঠকসাধারণ ধরে ফেলেছে এবং তার প্রভাবের জাদুশক্তি আলাদিনের চেরাগের মতো হস্তান্তর হয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে আনন্দবাজারের সমর্থন অথবা বিরোধিতা এখন ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই আগের গুরুত্ব পায় না। অথচ আনন্দবাজারের কাটতি এখনও সর্বাধিক। এই সর্বাধিক প্রচারিত কাগজটির বিরোধিতা উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ত্রিশ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিল। আবার গত রাজ্য নির্বাচনের আগে পত্রিকাটি যখন সিপিএম-ঘেঁষা হতে চেষ্টা করেছে, তখন নির্বাচনে সিপিএমের হার হয়েছে। এই হার নিশ্চিত জেনে আনন্দবাজার শেষ দিকে মমতাপন্থি হওয়ার চেষ্টা করেছিল। মমতার তৃণমূল তাকে আমল দেয়নি।
বাংলাদেশের যে দুটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক তাদের প্রচার ও প্রভাবের জোরে ২০০১ সালে অঘটনঘটনপটীয়সী ক্ষমতার অধিকারী ছিল, এখন তা নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকা, এক-এগারোর ঠিক পূর্ববর্তী সময় এবং এক-এগারোর সময় তাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে দেশের পাঠক সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা কাদের স্বার্থে পরিচালিত এবং গণতন্ত্রের মিত্র সেজে এই পত্রিকা দুটি দেশে গণস্বার্থ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কতটা ক্ষতিসাধন করেছে। ফলে পত্রিকা দুটির কাটতি কমেনি; কিন্তু আগের প্রভাব পাঠক সমাজে নেই বললেই চলে।
অতীতে তারা জনমানসে অনবরত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এখনও যে করছে না তা নয়। ড. ইউনূসকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো, ড. কামাল হোসেনকে ফসিল থেকে আবার ফসলে পরিণত করার চেষ্টা, হাসিনা ও খালেদাকে অপরাজনীতির সমান পাল্লায় বসিয়ে হাসিনাকে ডিসক্রেডিট করার চেষ্টা, কোনো চেষ্টাই পত্রিকা দুটি বাদ দেয়নি। কিন্তু এবার গণদেবতা তাতে ভুলছে না। ভুলবে তা মনে হয় না। পত্রিকা দুটির আগের রূপ ও খদ্দের দুই-ই আছে। নেই শুধু পাঠক সমাজে, বৃহত্তর জনসমাজে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ২০০১ সালের মতো নয়, বরং ভিন্ন। বারাক ওবামা আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দেশটির নীতি পরিবর্তিত হবে মনে হয় না। বিএনপি ও জামায়াতের মিত্র রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুশ্চিন্তা করার কারণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামা জয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগ একটি বড় বোনাস পেয়েছে। ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় খুঁটির জোর হিলারি ক্লিনটন আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নেই। তার বদলে এসেছেন জন কেরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে এসেছেন চাক হেগেল। তিনি রিপাবলিকান সদস্য হলেও যুদ্ধবিরোধী এবং ইসরায়েলের সমালোচক। বাংলাদেশে তিনি বিএনপি-জামায়াতের বান্ধব হবেন এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে আশা করা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজীনা সাহেব সম্ভবত এখন কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সতর্ক এবং সংযত হবেন।
দিলি্লতে খালেদা জিয়ার অভাবিত সংবর্ধনার পর ঢাকায় আওয়ামী লীগ মহলে একটু অস্থিরতার ভাব দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল দিলি্ল বুঝি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু দিলি্ল ঝুঁকতে চাইলেও তা পারবে মনে হয় না। খালেদা জিয়ার সহজে জামায়াতের গাঁটছড়া থেকে নিজেকে এবং তার দলকে মুক্ত করতে পারবেন না। সে সঙ্গে দিলি্লকে ভারত বিরোধিতা পরিহার করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন, তাও পূরণ করতে পারছেন না। তার ওপর পশ্চিমবঙ্গে মমতা-উপদ্রব দিলি্লর কংগ্রেস সরকারকে ক্রমশই ভাবিত করে তুলেছে এবং রাজ্যের রাজনীতিতে সিপিএম ও কংগ্রেস আবার ধীরে ধীরে কাছাকাছি হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি তার হঠকারী বুদ্ধি দ্বারা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মিত্রতায় যে চিড় ধরিয়েছেন, তা মেরামত করতে হলে খালেদা নয়, শেখ হাসিনার ওপরই মনমোহন সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হবে। মনে হয় দিলি্ল এখন হাসিনাকে তুষ্ট করারই বেশি চেষ্টা করবে; খালেদাকে নয়। দিলি্লর একটি পত্রিকা এই বলে সম্প্রতি মনমোহন সরকারকে সাবধান করেছে যে, 'মমতা ও খালেদার চরিত্র অভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে মমতাকে সমর্থন করে কংগ্রেস মুখের অর্ধাংশ পুড়িয়েছে। বাংলাদেশে খালেদাকে সমর্থন দিলে বাকি অর্ধাংশও পোড়াবে।' দিলি্ল এই সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করতে পারবে বা চাইবে মনে হয় না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা তাই ২০০১ সালের মতো রহস্যপূর্ণ হবে তাও মনে হয় না।
বাকি রইল পাকিস্তান ও সৌদি আরব। ২০০১ সালে পাকিস্তানের আইএসআই যতটা শক্তিশালী এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল, বর্তমানে তা নেই। আমেরিকার সঙ্গে সংঘাতে তাদের শক্তি ও প্রভাব দুই-ই কমেছে। বাংলাদেশেও তাদের ঘাঁটি এখন দুর্বল এবং বিএনপি-জামায়াতকে আগের মতো সমর্থন দিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে কোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ওপর আগের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের নেই। সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা দেখে মনে হয়, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা না চাইলেও এখন মুখ ফুটে সে কথা বলতে নারাজ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের ভূমিকার প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর মনোভাব সৌদি আরবকেও এই বার্তা পেঁৗছে দিয়েছে যে, হাসিনা সরকারকে চোখ রাঙিয়ে নত করা যাবে না।
বস্তুত ২০০১ ও ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য, তাতে মনে করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনে বিএনপি সহজ ওয়াকওভার পাবে বা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই পুনরাবৃত্তির আশা করে দেশবাসীর কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত যেসব নতুন ও পুরনো রাজনৈতিক নেতা, স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী, সুযোগ-সন্ধানী কলামিস্ট, নিরপেক্ষতার মুখোশধারী সাংবাদিক আবার কাশিমবাজার কুঠিতে জড়ো হয়েছেন এবং থার্ড ফোর্স বা তৃতীয় শক্তির চিৎকার জুড়েছেন, এমনকি কোনো কোনো মহলে 'কালনেমির লঙ্কাভাগও' শুরু হয়ে গেছে, তাদের জন্য যে আবার একটি বড় হতাশা ও পরাজয় অপেক্ষা করছে তা বলার জন্য গণক ঠাকুর হওয়ার দরকার নেই।
তবে হ্যাঁ, এরপরও কথা থাকে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি-না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের প্রশ্নে বিএনপির আবদার মেনে না নিলে তারা নির্বাচন বর্জন করে তা বানচাল এবং দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারবে কি-না? আমার ধারণা, বিদেশি প্ররোচনা ও সাহায্য না থাকলে বিএনপি-জামায়াত নিজেদের শক্তিতে তেমন কিছু করতে পারবে না। তাদের দেশি দোসররা সেমিনার, গোলটেবিল এবং টিভির টক শো গরম করতে পারবে, তার বেশি কিছু নয়। তবু এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে কি-না সে সম্পর্কেও বিশদ পর্যালোচনা প্রয়োজন। এক কথায় ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। পাণ্ডিত্য দ্বারা নয়, এ সম্পর্কে নিজের সাংবাদিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত একটি পর্যালোচনা শিগগিরই লেখার ইচ্ছা রইল। আজকের লেখাটির কলেবর আর বাড়াতে চাই না।
লন্ডন, ১৮ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৩
লন্ডনের 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকা অবশ্য প্রেডিকশন করেছে, 'ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে খালেদা জিয়াই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।' এই ধরনের প্রেডিকশনকে বলা হয় 'সাংবাদিকতায় শুভঙ্করের ফাঁকি।' এই ফাঁকিবাজির সাংবাদিকতায় ব্রিটেনের চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর মুখপত্র 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকাটি সিদ্ধহস্ত। তাই চাতুর্যের সঙ্গে বলা হয়েছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হলে হবেন না।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি (২০০১ সালের) যে হবেই এ কথাটা 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকার কানে কানে কে বলে দিল? এটা সত্য, বাংলাদেশের আগামী সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনে ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। ইকোনমিস্টের আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশের একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ, তাদের নতুন-পুরনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং নিরপেক্ষতার ভেকধারী তাদের মুখপত্র দুটিকে আবার ২০০১ সালের নির্বাচনপূর্ব সময়ের মতো সক্রিয়, ঐক্যবদ্ধ এবং 'কাশিমবাজার কুঠিতে' সমবেত হতে দেখা যাচ্ছে।
এবার তাদের সঙ্গে নতুন কিছু মুখও জুটেছে। তার অর্থ এই নয় যে, ইতিহাস ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। যদি ঘটায়ও তাহলে হুবহু ঘটাবে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সবসময় হুবহু ঘটেছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিএনপিসহ সকল দলের অংশগ্রহণে যদি যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, তাহলেও ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। স্বল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতার মার্জিনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এখনও খুব বেশি; তবে আওয়ামী লীগ নানা কারণে নির্বাচনে সরাসরি ক্ষমতায় থাকার মতো জয়লাভ নাও করতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বিএনপি জয়ী হবে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েও সে জয়ী হতে পারবে না। এমনকি এরশাদ যদি মহাজোট ছাড়েন তাহলেও নয়।
তাহলে কী হবে? এই দুরূহ প্রশ্নটিরই জবাব ইতিহাসে অনুচ্চারিত রয়েছে। এখানে এসেই মানুষের বিচার-বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি ইতিহাসের কাছে হার মেনেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ভারতে বিজেপি কোয়ালিশন যখন দিলি্লতে ক্ষমতাসীন এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের সম্মুখীন, তখন তারা নির্বাচনপূর্ব 'ইন্ডিয়া শাইনিং' উৎসব শুরু করেছিল। প্রচার করছিল যে, বিজেপির শাসনামলে ভারতের এতই উন্নয়ন ঘটেছে যে, নির্বাচনে তারা নিরঙ্কুশ জয়ের অধিকারী হবে। দেশের অধিকাংশ মিডিয়া জনমত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে বলেছিল, বিজেপি বিরাট জয়ের অধিকারী হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফল হয়েছিল উল্টো। বিজেপির ভরাডুবি এবং কংগ্রেসের ক্ষমতা পুনর্দখল।
বর্তমান বাংলাদেশেও বিএনপির প্রচারডঙ্কা এত জোরেশোরে বাজছে এবং একশ্রেণীর নিরপেক্ষ মিডিয়া তাতে এত বেশি রসদ জোগাচ্ছে যে, মনে হতে পারে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি বুঝি অনিবার্য। আমি দেশে অবস্থানকালে দেখে বিস্মিত হয়েছি, অনেক আওয়ামী লীগার এবং দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেও এ কথা বিশ্বাস করেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি সুবিধা করতে না পারে, তবে দলের এই হতাশাবাদী সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্যই যে পারবে না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
তবে আমার গণনা অন্যখানে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আগামীতে ঘটানোর জন্য তখনকার একটি সুশীল সমাজ, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক, হাসিনাবিদ্বেষী প্রবীণ একদল নেতা, সুবিধাবাদী ও সুযোগ-সন্ধানী কিছু নতুন রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা এবং একশ্রেণীর তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া, বিশেষ করে একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক যেভাবে তখন জোট ও ঘোঁট পাকিয়েছিল, বর্তমানেও তেমনভাবে তারা সেই ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে। মনে হয়, ২০০১ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে তারা ছাড়বে না। কিন্তু আমার গণনায় এই চক্রান্ত সকল হবে না নানা কারণে। প্রথম কারণ, ২০০১ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০১৩ সালে নেই। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আগে জাতীয় পরিস্থিতির কথা বলি। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের সময় তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক এবং একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকের সম্পাদক, যাদের হাসিনাবিদ্বেষ সকল সীমা অতিক্রম করেছিল, তারা রাষ্ট্রপতির 'কনসাসকিপার' হয়ে উঠেছিলেন। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান প্রকাশ্যেই নিজের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বিগ মিডিয়ার অধিকাংশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। আর্মি ও ব্যুরোক্রেসির প্রভাবশালী অংশই বিএনপির পক্ষে কাজ করেছে। আর্মি আওয়ামী সমর্থক ও ভোটদাতাদের ঠ্যাঙানোর কাজেও অংশ নিয়েছে। গোটা দেশে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটদাতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগের অনুকূল ছিল না। আমেরিকায় নিউ কনজারভেটিভদের প্রার্থী জর্জ বুশ জুনিয়র প্রেসিডেন্ট পদে তখন বসেছেন এবং তাদের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার থিয়োরি অনুযায়ী বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো প্রয়োজন বলে তারা মনে করেছেন। জামায়াত তখন তাদের চোখে মডার্ন, ডেমোক্রেটিক মুসলিম দল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জঙ্গিবাদ ঠেকাতে সৌদি আরবের মদদে বাংলাদেশের জামায়াতিদের মার্কিন স্বার্থরক্ষায় কাজে লাগানো যাবে বলে তারা ধরে নিয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান মেরি বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঢাকায় টুয়েসডে টুয়েসডে ক্লাব আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ভারতে দিলি্লর ক্ষমতাসীনদের ভূমিকাও এ সময় ছিল রহস্যপূর্ণ। তারা বরের ঘরের পিসি এবং কনের ঘরের মাসির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের আইএসআই তখনও প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী এবং বিএনপিকে প্রবলভাবে মদদ জোগাচ্ছে। সৌদি বাদশাহরাও একই ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
২০১৩ সালে এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি রোগে-শোকে ও বয়সের ভারে কাতর হলেও ২০০১ সালের রাষ্ট্রপতির মতো 'দোদিল বান্দা' এবং 'কনসাসকিপারদের' দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত ব্যক্তি নন। তাকে বিভ্রান্ত বা বিপথগামী করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে আগের ধরনের কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি, যে সরকারকে তার প্রধান উপদেষ্টা (লতিফুর রহমান)সহ বিএনপি হাইজ্যাক করতে পারবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একবার বিচার বিভাগের লতিফুর রহমানের এবং আরেকবার সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইয়াজউদ্দিনের নির্লজ্জ ভূমিকা দেখার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা ও ভূমিকা সম্পর্কে শেখ হাসিনার মোহমুক্তি ঘটেছে এবং কোনো অবস্থাতেই তিনি এই ব্যর্থ ও বিএনপি দ্বারা ব্যবস্থায় ফিরে যেতে রাজি নন। এই সিদ্ধান্তে জনমতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যদি অটল থাকতে পারেন, তাহলে ২০১৪ সালে ২০০১ সালের চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটানো বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী এবং তাদের অনুগত সুশীল সমাজের পক্ষে সম্ভব হবে না। একশ্রেণীর 'নিরপেক্ষ' পত্রিকা গোষ্ঠীও পারবে না।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ২০০১ সালের চেয়ে বর্তমানের একটি বড় পরিবর্তন এই যে, ২০০১ সালে ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, কর্নেল (অব.) অলি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অথবা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নামধারী তাদের সহযোগী সুশীল সমাজের মাথাওয়ালা কয়েক ব্যক্তি এবং তাদের মুখপত্র একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক বর্তমানের মতো দেশের মানুষের কাছে এত বেশি এক্সপোজড হননি এবং তাদের মুখোশ খুলে পড়েনি। জনসাধারণকে তারা তখন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ও সম্পাদকের মুখোশ ধারণ করে সহজেই বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু গত বারো বছরে, বিশেষ করে এক-এগারোর ঘটনায় তারা আসলে কাদের লোক এবং কাদের স্বার্থের তল্পি বহন করছেন, তা সাধারণ মানুষের কাছেও ধরা পড়ে যাওয়ায় তাদের ক্ষতি করার শক্তি ও প্রভাব কমেছে এবং আগামী নির্বাচন যথাসময়ে বিনা প্রতিবন্ধকতায় অনুষ্ঠিত হলে হয়তো দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা মৃত ফসিলে পরিণত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে যে দু'একটি তরুণ মুখ এসে জড়ো হয়েছে, আগামী নির্বাচনে তাদের অবস্থা হয়তো দাঁড়াবে পাগলা মেহের আলীর মতো। তখন তাদের মুখে একটি বাক্যই শুধু শোনা যাবে। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, জনমনে ক্রমাগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং এখনও করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যে ইংরেজি ও বাংলা দুটি দৈনিক, ২০০১ সালে (জনসাধারণ তাদের আসল ভূমিকা ধরতে না পারা পর্যন্ত) তারা যে ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী ছিল, বর্তমানে তা তাদের নেই। পাঠকদের কাছে ক্রেডিবিলিটি না থাকলে কেবল প্রচার আধিক্য দ্বারা কোনো মিডিয়া জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার প্রমাণ, আমরা লন্ডনের টাইমস এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার বেলাতেও দেখি।
টাইমস গ্রুপ অব নিউজ পেপারের মালিক রুপার্ট মারডোককে এক সময় বলা হতো 'কিংস মেকার'_ টাইমস পত্রিকার প্রভাবের জোরে তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত বহু দেশের সরকারের উত্থান-পতন ঘটিয়েছেন। এই প্রভাব টাইমস পত্রিকার এখন আর নেই। তার কাটতি কমেনি, কিন্তু নানা অপসাংবাদিকতায় জড়িত হওয়ার অভিযোগ ওঠায় এই গ্রুপের সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বন্ধ হয়ে গেছে। টাইমসের ওপর জনআস্থাও দারুণভাবে কমেছে। ফলে সাম্প্রতিককালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নয়া নেতা নির্বাচনকালে বামঘেঁষা নেতা এড মিলিব্যান্ডের দারুণ বিরোধিতা করেও টাইমস কিছুই করতে পারেনি। এড মিলিব্যান্ড নির্বাচিত হয়েছেন।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাটির আজ একই অবস্থা। শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বলে আনন্দবাজারের দাবি। এই দাবি অদ্যাবধি মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আনন্দবাজার এককালে অঙ্গুলি ঘোরালে যে ক্ষমতাসীন সরকারকে বা তাদের না-পছন্দের কোনো রাজনৈতিক দলকে নাস্তানাবুদ করতে পারত, সেই ক্ষমতা আনন্দবাজারের নেই। নানা ধরনের অপসাংবাদিকতায় তার স্বরূপ পাঠকসাধারণ ধরে ফেলেছে এবং তার প্রভাবের জাদুশক্তি আলাদিনের চেরাগের মতো হস্তান্তর হয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে আনন্দবাজারের সমর্থন অথবা বিরোধিতা এখন ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই আগের গুরুত্ব পায় না। অথচ আনন্দবাজারের কাটতি এখনও সর্বাধিক। এই সর্বাধিক প্রচারিত কাগজটির বিরোধিতা উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ত্রিশ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিল। আবার গত রাজ্য নির্বাচনের আগে পত্রিকাটি যখন সিপিএম-ঘেঁষা হতে চেষ্টা করেছে, তখন নির্বাচনে সিপিএমের হার হয়েছে। এই হার নিশ্চিত জেনে আনন্দবাজার শেষ দিকে মমতাপন্থি হওয়ার চেষ্টা করেছিল। মমতার তৃণমূল তাকে আমল দেয়নি।
বাংলাদেশের যে দুটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক তাদের প্রচার ও প্রভাবের জোরে ২০০১ সালে অঘটনঘটনপটীয়সী ক্ষমতার অধিকারী ছিল, এখন তা নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকা, এক-এগারোর ঠিক পূর্ববর্তী সময় এবং এক-এগারোর সময় তাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে দেশের পাঠক সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা কাদের স্বার্থে পরিচালিত এবং গণতন্ত্রের মিত্র সেজে এই পত্রিকা দুটি দেশে গণস্বার্থ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কতটা ক্ষতিসাধন করেছে। ফলে পত্রিকা দুটির কাটতি কমেনি; কিন্তু আগের প্রভাব পাঠক সমাজে নেই বললেই চলে।
অতীতে তারা জনমানসে অনবরত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এখনও যে করছে না তা নয়। ড. ইউনূসকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো, ড. কামাল হোসেনকে ফসিল থেকে আবার ফসলে পরিণত করার চেষ্টা, হাসিনা ও খালেদাকে অপরাজনীতির সমান পাল্লায় বসিয়ে হাসিনাকে ডিসক্রেডিট করার চেষ্টা, কোনো চেষ্টাই পত্রিকা দুটি বাদ দেয়নি। কিন্তু এবার গণদেবতা তাতে ভুলছে না। ভুলবে তা মনে হয় না। পত্রিকা দুটির আগের রূপ ও খদ্দের দুই-ই আছে। নেই শুধু পাঠক সমাজে, বৃহত্তর জনসমাজে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ২০০১ সালের মতো নয়, বরং ভিন্ন। বারাক ওবামা আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দেশটির নীতি পরিবর্তিত হবে মনে হয় না। বিএনপি ও জামায়াতের মিত্র রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুশ্চিন্তা করার কারণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামা জয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগ একটি বড় বোনাস পেয়েছে। ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় খুঁটির জোর হিলারি ক্লিনটন আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নেই। তার বদলে এসেছেন জন কেরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে এসেছেন চাক হেগেল। তিনি রিপাবলিকান সদস্য হলেও যুদ্ধবিরোধী এবং ইসরায়েলের সমালোচক। বাংলাদেশে তিনি বিএনপি-জামায়াতের বান্ধব হবেন এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে আশা করা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজীনা সাহেব সম্ভবত এখন কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সতর্ক এবং সংযত হবেন।
দিলি্লতে খালেদা জিয়ার অভাবিত সংবর্ধনার পর ঢাকায় আওয়ামী লীগ মহলে একটু অস্থিরতার ভাব দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল দিলি্ল বুঝি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু দিলি্ল ঝুঁকতে চাইলেও তা পারবে মনে হয় না। খালেদা জিয়ার সহজে জামায়াতের গাঁটছড়া থেকে নিজেকে এবং তার দলকে মুক্ত করতে পারবেন না। সে সঙ্গে দিলি্লকে ভারত বিরোধিতা পরিহার করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন, তাও পূরণ করতে পারছেন না। তার ওপর পশ্চিমবঙ্গে মমতা-উপদ্রব দিলি্লর কংগ্রেস সরকারকে ক্রমশই ভাবিত করে তুলেছে এবং রাজ্যের রাজনীতিতে সিপিএম ও কংগ্রেস আবার ধীরে ধীরে কাছাকাছি হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি তার হঠকারী বুদ্ধি দ্বারা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মিত্রতায় যে চিড় ধরিয়েছেন, তা মেরামত করতে হলে খালেদা নয়, শেখ হাসিনার ওপরই মনমোহন সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হবে। মনে হয় দিলি্ল এখন হাসিনাকে তুষ্ট করারই বেশি চেষ্টা করবে; খালেদাকে নয়। দিলি্লর একটি পত্রিকা এই বলে সম্প্রতি মনমোহন সরকারকে সাবধান করেছে যে, 'মমতা ও খালেদার চরিত্র অভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে মমতাকে সমর্থন করে কংগ্রেস মুখের অর্ধাংশ পুড়িয়েছে। বাংলাদেশে খালেদাকে সমর্থন দিলে বাকি অর্ধাংশও পোড়াবে।' দিলি্ল এই সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করতে পারবে বা চাইবে মনে হয় না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা তাই ২০০১ সালের মতো রহস্যপূর্ণ হবে তাও মনে হয় না।
বাকি রইল পাকিস্তান ও সৌদি আরব। ২০০১ সালে পাকিস্তানের আইএসআই যতটা শক্তিশালী এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল, বর্তমানে তা নেই। আমেরিকার সঙ্গে সংঘাতে তাদের শক্তি ও প্রভাব দুই-ই কমেছে। বাংলাদেশেও তাদের ঘাঁটি এখন দুর্বল এবং বিএনপি-জামায়াতকে আগের মতো সমর্থন দিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে কোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ওপর আগের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের নেই। সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা দেখে মনে হয়, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা না চাইলেও এখন মুখ ফুটে সে কথা বলতে নারাজ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তুরস্কের ভূমিকার প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর মনোভাব সৌদি আরবকেও এই বার্তা পেঁৗছে দিয়েছে যে, হাসিনা সরকারকে চোখ রাঙিয়ে নত করা যাবে না।
বস্তুত ২০০১ ও ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য, তাতে মনে করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনে বিএনপি সহজ ওয়াকওভার পাবে বা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই পুনরাবৃত্তির আশা করে দেশবাসীর কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত যেসব নতুন ও পুরনো রাজনৈতিক নেতা, স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী, সুযোগ-সন্ধানী কলামিস্ট, নিরপেক্ষতার মুখোশধারী সাংবাদিক আবার কাশিমবাজার কুঠিতে জড়ো হয়েছেন এবং থার্ড ফোর্স বা তৃতীয় শক্তির চিৎকার জুড়েছেন, এমনকি কোনো কোনো মহলে 'কালনেমির লঙ্কাভাগও' শুরু হয়ে গেছে, তাদের জন্য যে আবার একটি বড় হতাশা ও পরাজয় অপেক্ষা করছে তা বলার জন্য গণক ঠাকুর হওয়ার দরকার নেই।
তবে হ্যাঁ, এরপরও কথা থাকে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আগামী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি-না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের প্রশ্নে বিএনপির আবদার মেনে না নিলে তারা নির্বাচন বর্জন করে তা বানচাল এবং দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারবে কি-না? আমার ধারণা, বিদেশি প্ররোচনা ও সাহায্য না থাকলে বিএনপি-জামায়াত নিজেদের শক্তিতে তেমন কিছু করতে পারবে না। তাদের দেশি দোসররা সেমিনার, গোলটেবিল এবং টিভির টক শো গরম করতে পারবে, তার বেশি কিছু নয়। তবু এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে কি-না সে সম্পর্কেও বিশদ পর্যালোচনা প্রয়োজন। এক কথায় ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। পাণ্ডিত্য দ্বারা নয়, এ সম্পর্কে নিজের সাংবাদিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত একটি পর্যালোচনা শিগগিরই লেখার ইচ্ছা রইল। আজকের লেখাটির কলেবর আর বাড়াতে চাই না।
লন্ডন, ১৮ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৩
No comments