খোলা চোখে- নয়াদিল্লির জ্যোতি, শরীয়তপুরের হেনা by হাসান ফেরদৌস
অবশেষে মেয়েটির নাম জানা গেছে। জ্যোতি সিং পাণ্ডে, মাত্র ২৩ বছরের প্যারা মেডিকেলের ছাত্রী। পরিবারের প্রথম কলেজপড়ুয়া মেয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে এই বড় মেয়েটিকে নিয়ে মা-বাবার কতই না স্বপ্ন ছিল। কোনো স্বপ্নই পূরণ হলো না।
ছয় পাষণ্ড যুবক উপর্যুপরি ধর্ষণের পর পিটিয়ে বিবস্ত্র করে তাঁকে নয়াদিল্লির রাস্তায় আধমরা করে ছুড়ে ফেলে। তারা চেয়েছিল, চলন্ত বাস তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে, আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। সঙ্গে এক পুরুষ বন্ধু ছিলেন, ধর্ষকদের আক্রমণে তিনিও ক্ষতবিক্ষত। তবু নিজের শরীর দিয়ে মেয়েটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। চলন্ত রাস্তার পাশে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দুটি মানুষ, সাহায্যের জন্য আকুলিবিকুলি করেছেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশেষে অ্যাম্বুলেন্সে মেয়েটিকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন তিনি মৃত্যুর দরজায়। বাকরুদ্ধ পিতার সঙ্গে শুধু কথা হয়েছিল। ‘বাবা, বড় ব্যথা’, চোখের জলে ভিজতে ভিজতে তিনি বলেছিলেন। অসহায় পিতা আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, বেটা।’
না, কিছুই ঠিক হয়নি। চিকিৎসকদের চেষ্টায় হয়তো ত্রুটি ছিল না। সরকার খুব দ্রুত বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। অবশ্য ‘ক্লিনিক্যালি’ মৃত মেয়েটিকে বিদেশে নেওয়া ছিল কেবল লোক দেখানো ব্যাপার—সরকার কিছু একটা করছে, সে কথা প্রমাণ করা। ভাবা হয়েছিল, অল্পতেই বাদ-প্রতিবাদ থেমে যাবে। ধর্ষণের ঘটনা ভারতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। গরিবের মেয়ে, তাঁর ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি কিছু জোটার কথাও নয়। অতএব, যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে, এই নির্মম ও নিষ্ঠুর মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশজুড়ে এমন প্রতিবাদ উঠবে, সে কথা তারা কেউ ভাবতে পারেনি। বিদেশে, এমনকি এই সুদূর নিউইয়র্কেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধু তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা নয়। সব দেশে, সব সময়েই মেয়েরা পাষণ্ড পুরুষদের লোভ ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথম ভারতের মেয়েরা বলছেন, তাঁরা বিনা প্রতিবাদে প্রতিকারহীন এই সহিংসতা আর মেনে নেবেন না। তাঁদের দাবি, শুধু আইন নয়, আইনের বাস্তবায়ন চাই। কাজটা ক্ষমতাসীনদের কানে তা পৌঁছাবে না। এমন অপরাধের জন্য চূড়ান্ত শাস্তি অবধারিত—এই ভয় জাগাতে না পারলে ঘাতক পুরুষ দু-চারটে শহুরে প্রতিবাদে থোড়াই কেয়ার করবে।
মনে হচ্ছে, ভারতে অবস্থা এবার হয়তো বদলাতে শুরু করবে। অন্তত নতুন আইন হবে, বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা হয়তো হবে। কিন্তু যা হবে না তা হলো, মেয়েদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পুরুষের রাক্ষুসে যৌন ক্ষুধারও পরিবর্তন হবে না। হাজার বছর ধরে যে সংস্কৃতিতে মেয়েদের স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সমাজের সবচেয়ে নিচের পাদানিতে, সেখানে শুধু আইন করে রাতারাতি মেয়েদের সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তন অসম্ভব। এ জন্য যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন, ভারতে এবার তার সূচনা হলো, এ কথা কেউ কেউ বলছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ভারতীয় লেখিকা সোহেইলা আবদুল আলী, যিনি নিজে ১৭ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তাঁর আশার কথা লিখেছেন। ৩২ বছর আগে, যখন তিনি ধর্ষণের শিকার হন, এমন পাশবিক কাণ্ডের বিরুদ্ধে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিছিল করবেন, তাঁদের দাবির সামনে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মাথা নত করবেন, এমন কথা ভাবাও যেত না। কিন্তু এখন তা ভাবা যায়, এমনকি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে মনের মধ্যে বিশ্বাসও জাগে।
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ, এ নিয়ে দ্বিমত নেই। দ্বিমত যেখানে, তা হলো ধর্ষণের কারণ নিয়ে। ধর্মগুরু থেকে রাজনীতিক, সবার এক যুক্তি—পুরুষদের উত্তেজিত না করলে এমন ঘটনা তো ঘটে না। তাঁরা চান, মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে, মাথা গুঁজে ঘরে বসে থাকুন, তাঁদের বাইরে এক পা-ও বের হওয়া যাবে না। জ্যোতির ক্ষেত্রেও আধ ডজন যুক্তি দিয়ে সব দোষ ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ওপরে চাপানোর চেষ্টা হয়েছে। আশারাম বাপু নামের এক ধর্মগুরু যুক্তি দেখিয়েছেন, দোষ একা পুরুষদের নয়, মেয়েটিরও ছিল। তিনি কেন পুরুষগুলোকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেননি? মধ্যপ্রদেশের এক মন্ত্রী যুক্তি দেখিয়েছেন, রাত-বিরেতে বাইরে যাওয়ার আগে এমন বিপদের কথা মেয়েটির ভাবা উচিত ছিল। রাজস্থানের এক বিধায়ক প্রস্তাব করেছেন, মেয়েদের স্কার্ট পরা নিষিদ্ধ করতে হবে, তা না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। চণ্ডীগড়ের এক মন্ত্রী বলেছেন, আসলে মেয়েটির রাশির দোষ, গ্রহ-নক্ষত্রের একটা কিছু গড়বড় হয়েছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর তো আর আমাদের কোনো হাত নেই। অতএব, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। যে আইনজীবী ধৃত ধর্ষকদের পক্ষে ওকালতির দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর যুক্তি আরও সোজাসাপটা। তাঁর কথা, ‘এ দেশে ভদ্রলোকের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না।’
মৃত্যুর আগে মেয়েটি বর্বর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহের ওপরেও ধর্ষণ চলছে। ধর্ষক সে-ই পুরুষ, সে কেবলই পশু।
ধর্ষণের ব্যাপারে পৃথিবীর সর্বত্রই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এক। কয়েক বছর আগে ঢাকায় নববর্ষের প্রথম প্রহরের উৎসবে অংশ নিতে গিয়ে একটি মেয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ওই সময় ফেনীর সরকারদলীয় সাংসদ জয়নাল হাজারী সব দোষ চাপিয়েছিলেন মেয়েটির ওপর, তাঁকে কটাক্ষ করে একটি নাটিকা লিখিয়ে তা মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থাও করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বরিশালে সংখ্যালঘু মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার হয়েছিল। সে সময় আরেক সরকারদলীয় সাংসদ ও মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সুযোগ থাকলে তিনি নিজেও ধর্ষণের কাজে নেমে যেতেন।’ এক মার্কিন রিপাবলিকান দলীয় রাজনীতিক ধর্ষণকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘যখন আটকানো যাবেই না, তখন অভিযোগ না করে ধর্ষণ উপভোগ করা বুদ্ধিমানের কাজ।’
ভিন্ন ভিন্ন সরকারি দল, ভিন্ন দেশ—কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি অবিকল এক!
জ্যোতির কথা লিখতে গিয়ে আমার বাংলাদেশের আরেক অভাগা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। হেনা আখতার নামের মাত্র ১৪ বছরের এক বালিকা, তার চেয়ে ২৬ বছরের বড় এক নিকট আত্মীয়র হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। ঠিক দুই বছর আগে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। শরীয়তপুরের স্কুলের ছাত্রী এই মেয়েটি আক্রান্ত হয় তার চাচাতো ভাই মাহবুব খানের হাতে। লোকটি বিবাহিত, হেনার সমবয়সী একটি ছেলেও আছে তাঁর। চাচাতো ভাই তাকে বিরক্ত করেন, সে কথা জানিয়ে হেনা তাঁর মা-বাবার কাছে নালিশ করেছে। মাহবুবের সঙ্গে তাদের এই নিয়ে বচসাও হয়েছে। একদিন রাতে শৌচাগার থেকে ফেরার পথে মাহবুব বালিকাটির মুখ চেপে ধরে তাকে খেতের ভেতর নিয়ে ধর্ষণ করেন। তার চিৎকার শুনে প্রথমে ছুটে আসেন মাহবুবের স্ত্রী। স্বামীকে দোষ দেওয়ার বদলে সব দোষ তিনি চাপান হেনার ওপর; বলেন, সে নষ্টা মেয়ে। এ নিয়ে গ্রামে সালিস বসে। তাতে স্থানীয় ইমাম ফতোয়া দেন, অবৈধ কাজের জন্য হেনাকে ২০১টি দোররা মারতে হবে। মা-বাবার চোখের সামনে শুরু হয় সে দোররা মারা। তার পিঠ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে, চিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ, কিন্তু হাত কাঁপে না কপট ধর্মগুরুর। মাটিতে পড়ে যায় হেনা, তবু দোররা মারা বন্ধ হয় না। একসময় সে নেতিয়ে পড়ে। এভাবে সবার চোখের সামনে খুন হয় হেনা।
এ ঘটনা জানাজানি হলে থানা-পুলিশ শুরু হয়। ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটির মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কোনো চিহ্ন তার শরীরে নেই। তত দিনে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি নাগরিক অধিকার সংস্থার তরফ থেকেও প্রশ্ন উঠেছে। নতুন করে তদন্ত শুরু হয়, যে চার চিকিৎসক মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাঁদের নামে ফৌজদারি মামলা হয়। যে ইমাম দোররার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধর্ষক মাহবুব খানও গ্রেপ্তার হন।
এ দুটি ঘটনা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু এর জন্য লড়তে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশে কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণ রোধে উভয় সরকারেরই আন্তরিক অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের মন্ত্রী থেকে পাড়ার পুরোহিত, সবাই অন্য কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া সবার আগে মেয়েদের দুষতে দুই পায়ে খাড়া। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। প্রতিবাদ করার বদলে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করতেই তাঁরা অধিক ব্যস্ত। এর ফলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শুধু মেয়েদের নিরাপত্তা আক্রান্ত নয়, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার মতো মৌলিক অধিকারও সংকুচিত হয়ে আসছে।
আশার কথা, আজকের মেয়েরা অত সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। গত সপ্তাহে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন মুনিরকা বাসস্টপেজ থেকে সন্ধ্যায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রদীপ হাতে মিছিলে যোগ দেন। ওই বাসস্টপেজ থেকেই জ্যোতিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেসব ছেলেমেয়ের স্লোগান ছিল, এই রাত, এই আকাশ—সবকিছুর ওপরে আমাদের সমান অধিকার আছে। ভয় দেখিয়ে সে রাত, সে আকাশ ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। ‘সারি রাত হামারি হ্যায়।’ ১৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে দেখলাম সেই একই দৃশ্য। সেই একই দাবি, ‘এই রাতের আকাশ আমারও।’
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
না, কিছুই ঠিক হয়নি। চিকিৎসকদের চেষ্টায় হয়তো ত্রুটি ছিল না। সরকার খুব দ্রুত বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। অবশ্য ‘ক্লিনিক্যালি’ মৃত মেয়েটিকে বিদেশে নেওয়া ছিল কেবল লোক দেখানো ব্যাপার—সরকার কিছু একটা করছে, সে কথা প্রমাণ করা। ভাবা হয়েছিল, অল্পতেই বাদ-প্রতিবাদ থেমে যাবে। ধর্ষণের ঘটনা ভারতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। গরিবের মেয়ে, তাঁর ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি কিছু জোটার কথাও নয়। অতএব, যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে, এই নির্মম ও নিষ্ঠুর মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশজুড়ে এমন প্রতিবাদ উঠবে, সে কথা তারা কেউ ভাবতে পারেনি। বিদেশে, এমনকি এই সুদূর নিউইয়র্কেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধু তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা নয়। সব দেশে, সব সময়েই মেয়েরা পাষণ্ড পুরুষদের লোভ ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথম ভারতের মেয়েরা বলছেন, তাঁরা বিনা প্রতিবাদে প্রতিকারহীন এই সহিংসতা আর মেনে নেবেন না। তাঁদের দাবি, শুধু আইন নয়, আইনের বাস্তবায়ন চাই। কাজটা ক্ষমতাসীনদের কানে তা পৌঁছাবে না। এমন অপরাধের জন্য চূড়ান্ত শাস্তি অবধারিত—এই ভয় জাগাতে না পারলে ঘাতক পুরুষ দু-চারটে শহুরে প্রতিবাদে থোড়াই কেয়ার করবে।
মনে হচ্ছে, ভারতে অবস্থা এবার হয়তো বদলাতে শুরু করবে। অন্তত নতুন আইন হবে, বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা হয়তো হবে। কিন্তু যা হবে না তা হলো, মেয়েদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পুরুষের রাক্ষুসে যৌন ক্ষুধারও পরিবর্তন হবে না। হাজার বছর ধরে যে সংস্কৃতিতে মেয়েদের স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সমাজের সবচেয়ে নিচের পাদানিতে, সেখানে শুধু আইন করে রাতারাতি মেয়েদের সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তন অসম্ভব। এ জন্য যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন, ভারতে এবার তার সূচনা হলো, এ কথা কেউ কেউ বলছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ভারতীয় লেখিকা সোহেইলা আবদুল আলী, যিনি নিজে ১৭ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তাঁর আশার কথা লিখেছেন। ৩২ বছর আগে, যখন তিনি ধর্ষণের শিকার হন, এমন পাশবিক কাণ্ডের বিরুদ্ধে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিছিল করবেন, তাঁদের দাবির সামনে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মাথা নত করবেন, এমন কথা ভাবাও যেত না। কিন্তু এখন তা ভাবা যায়, এমনকি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে মনের মধ্যে বিশ্বাসও জাগে।
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ, এ নিয়ে দ্বিমত নেই। দ্বিমত যেখানে, তা হলো ধর্ষণের কারণ নিয়ে। ধর্মগুরু থেকে রাজনীতিক, সবার এক যুক্তি—পুরুষদের উত্তেজিত না করলে এমন ঘটনা তো ঘটে না। তাঁরা চান, মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে, মাথা গুঁজে ঘরে বসে থাকুন, তাঁদের বাইরে এক পা-ও বের হওয়া যাবে না। জ্যোতির ক্ষেত্রেও আধ ডজন যুক্তি দিয়ে সব দোষ ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ওপরে চাপানোর চেষ্টা হয়েছে। আশারাম বাপু নামের এক ধর্মগুরু যুক্তি দেখিয়েছেন, দোষ একা পুরুষদের নয়, মেয়েটিরও ছিল। তিনি কেন পুরুষগুলোকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেননি? মধ্যপ্রদেশের এক মন্ত্রী যুক্তি দেখিয়েছেন, রাত-বিরেতে বাইরে যাওয়ার আগে এমন বিপদের কথা মেয়েটির ভাবা উচিত ছিল। রাজস্থানের এক বিধায়ক প্রস্তাব করেছেন, মেয়েদের স্কার্ট পরা নিষিদ্ধ করতে হবে, তা না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। চণ্ডীগড়ের এক মন্ত্রী বলেছেন, আসলে মেয়েটির রাশির দোষ, গ্রহ-নক্ষত্রের একটা কিছু গড়বড় হয়েছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর তো আর আমাদের কোনো হাত নেই। অতএব, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। যে আইনজীবী ধৃত ধর্ষকদের পক্ষে ওকালতির দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর যুক্তি আরও সোজাসাপটা। তাঁর কথা, ‘এ দেশে ভদ্রলোকের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না।’
মৃত্যুর আগে মেয়েটি বর্বর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহের ওপরেও ধর্ষণ চলছে। ধর্ষক সে-ই পুরুষ, সে কেবলই পশু।
ধর্ষণের ব্যাপারে পৃথিবীর সর্বত্রই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এক। কয়েক বছর আগে ঢাকায় নববর্ষের প্রথম প্রহরের উৎসবে অংশ নিতে গিয়ে একটি মেয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ওই সময় ফেনীর সরকারদলীয় সাংসদ জয়নাল হাজারী সব দোষ চাপিয়েছিলেন মেয়েটির ওপর, তাঁকে কটাক্ষ করে একটি নাটিকা লিখিয়ে তা মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থাও করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বরিশালে সংখ্যালঘু মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার হয়েছিল। সে সময় আরেক সরকারদলীয় সাংসদ ও মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সুযোগ থাকলে তিনি নিজেও ধর্ষণের কাজে নেমে যেতেন।’ এক মার্কিন রিপাবলিকান দলীয় রাজনীতিক ধর্ষণকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘যখন আটকানো যাবেই না, তখন অভিযোগ না করে ধর্ষণ উপভোগ করা বুদ্ধিমানের কাজ।’
ভিন্ন ভিন্ন সরকারি দল, ভিন্ন দেশ—কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি অবিকল এক!
জ্যোতির কথা লিখতে গিয়ে আমার বাংলাদেশের আরেক অভাগা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। হেনা আখতার নামের মাত্র ১৪ বছরের এক বালিকা, তার চেয়ে ২৬ বছরের বড় এক নিকট আত্মীয়র হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। ঠিক দুই বছর আগে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। শরীয়তপুরের স্কুলের ছাত্রী এই মেয়েটি আক্রান্ত হয় তার চাচাতো ভাই মাহবুব খানের হাতে। লোকটি বিবাহিত, হেনার সমবয়সী একটি ছেলেও আছে তাঁর। চাচাতো ভাই তাকে বিরক্ত করেন, সে কথা জানিয়ে হেনা তাঁর মা-বাবার কাছে নালিশ করেছে। মাহবুবের সঙ্গে তাদের এই নিয়ে বচসাও হয়েছে। একদিন রাতে শৌচাগার থেকে ফেরার পথে মাহবুব বালিকাটির মুখ চেপে ধরে তাকে খেতের ভেতর নিয়ে ধর্ষণ করেন। তার চিৎকার শুনে প্রথমে ছুটে আসেন মাহবুবের স্ত্রী। স্বামীকে দোষ দেওয়ার বদলে সব দোষ তিনি চাপান হেনার ওপর; বলেন, সে নষ্টা মেয়ে। এ নিয়ে গ্রামে সালিস বসে। তাতে স্থানীয় ইমাম ফতোয়া দেন, অবৈধ কাজের জন্য হেনাকে ২০১টি দোররা মারতে হবে। মা-বাবার চোখের সামনে শুরু হয় সে দোররা মারা। তার পিঠ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে, চিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ, কিন্তু হাত কাঁপে না কপট ধর্মগুরুর। মাটিতে পড়ে যায় হেনা, তবু দোররা মারা বন্ধ হয় না। একসময় সে নেতিয়ে পড়ে। এভাবে সবার চোখের সামনে খুন হয় হেনা।
এ ঘটনা জানাজানি হলে থানা-পুলিশ শুরু হয়। ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটির মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কোনো চিহ্ন তার শরীরে নেই। তত দিনে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি নাগরিক অধিকার সংস্থার তরফ থেকেও প্রশ্ন উঠেছে। নতুন করে তদন্ত শুরু হয়, যে চার চিকিৎসক মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাঁদের নামে ফৌজদারি মামলা হয়। যে ইমাম দোররার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধর্ষক মাহবুব খানও গ্রেপ্তার হন।
এ দুটি ঘটনা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু এর জন্য লড়তে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশে কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণ রোধে উভয় সরকারেরই আন্তরিক অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের মন্ত্রী থেকে পাড়ার পুরোহিত, সবাই অন্য কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া সবার আগে মেয়েদের দুষতে দুই পায়ে খাড়া। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। প্রতিবাদ করার বদলে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করতেই তাঁরা অধিক ব্যস্ত। এর ফলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শুধু মেয়েদের নিরাপত্তা আক্রান্ত নয়, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার মতো মৌলিক অধিকারও সংকুচিত হয়ে আসছে।
আশার কথা, আজকের মেয়েরা অত সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। গত সপ্তাহে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন মুনিরকা বাসস্টপেজ থেকে সন্ধ্যায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রদীপ হাতে মিছিলে যোগ দেন। ওই বাসস্টপেজ থেকেই জ্যোতিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেসব ছেলেমেয়ের স্লোগান ছিল, এই রাত, এই আকাশ—সবকিছুর ওপরে আমাদের সমান অধিকার আছে। ভয় দেখিয়ে সে রাত, সে আকাশ ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। ‘সারি রাত হামারি হ্যায়।’ ১৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে দেখলাম সেই একই দৃশ্য। সেই একই দাবি, ‘এই রাতের আকাশ আমারও।’
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments