কথা সামান্যই-বাঙালির একক জাতিসত্তা by ফজলুল আলম
ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে পার্থক্য থাকে। প্রধানত এ পার্থক্য প্রকাশ পায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্ষমতাগত সম্পর্কের মধ্যে। কিন্তু একই জাতি, জাতির ব্যাখ্যা ছাড়াই বলতে হয়, স্বীকৃত কোনো একটি গোষ্ঠীর জনগণের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ে পার্থক্য প্রকটভাবে প্রতীয়মান।
জাতিসত্তার চেতনা যে সেসব পার্থক্য ও বিভাজন অতিক্রম করবে, তেমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
ব্রিটিশ আমলে বাঙালির জাতিসত্তার চেতনা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা অঞ্চল থেকে কিছুটা পৃথক ছিল বলে অনেকে মনে করেন (হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো); তখন অবশ্য ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। পরাধীনতার হীনম্মন্যতার সঙ্গে এই রাজধানিত্বের গৌরবও কিছুটা যে মিশ্রিত ছিল না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। সে সময় বাঙালির সংস্কৃতির ভিন্নতা তুলনা করা হতো ভারতের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে; কারণ জাতিসত্তা অবধাবনে সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এটাও স্বীকার না করে উপায় নেই যে বঙ্গের সাধারণ মানুষের জন্য পলাশী-পূর্ব ইতিহাসও এমন কোনো গৌরবের ইতিহাস ছিল না। কিন্তু শিক্ষার অভাবেই হোক বা না জানার ভান করেই হোক, বাঙালির কতকগুলো চেতনাবোধ সর্বদাই জাতিগতভাবে ভোঁতা হয়ে আছে। একটি হলো বাস্তবতা জ্ঞান, দ্বিতীয়টি তাত্ত্বিক জ্ঞান। বাঙালি ধর্মীয় জ্ঞানে সর্বদাই অগ্রসর ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকলেও সে কেন এতটা ধর্মপ্রবণ হয়ে উঠেছিল, তা অনেকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতসীনের ছত্রচ্ছায়ায় বাস করা বাঙালি নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করতেই এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিল, যাতে সাধারণ মানুষ নিপীড়ন, অবহেলা ও দৈন্য সহ্য করতে পারে। ক্ষমতাসীনরা ধর্মকে এমনভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে, যাতে তারা নিজেদের অবস্থা দৈব প্রদত্ত বলে মনে করে এবং পরলোকের সুখে মগ্ন থাকে। তাদের পক্ষে শ্রেণীবিভাজন অর্থাৎ সমাজে নিজেদের নিম্নস্থান কোনো পীড়ার জন্ম দেয় না, অমানবিক কষ্টের মধ্যেও না- তারা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর তাদের ব্যবস্থা করবেন। এসবই বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে চিরায়ত হয়ে গেছে এবং চিরায়ত সত্যতে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করতে আমরা ভুলি না।
ফলে সম্ভবত যুগ যুগ ধরে (কত যুগ আমি বলতে পারছি না, সেটার জন্য অন্য গবেষণার প্রয়োজন) বাঙালির বাস্তব শ্রেণীচেতনা তাত্ত্বিক তো নয়ই, যতটা জাগ্রত হতে পারত, তা হয়নি। এ অবস্থানটি উন্নত না অনুন্নত, সেটা এখানে বিচার্য নয়, তবে মেনে নিতেই হবে যে এ অবস্থানটিও বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। বাঙালি নানাভাবে তাদের জাতিসত্তার গর্ব নিয়ে বড়াই করেছে, এখনো করে। কলকাতা থেকে দিল্লিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হলে বাঙালির গর্ব কমে যায় বলে অনেকে মনে করেন- এটি একটি আজগুবি বক্তব্য। কারণ যে বাঙালি সশস্ত্র ও নিরস্ত্র- দুই ধরনের সংগ্রামে এ উপমহাদেশে ব্রিটিশদের অস্তিত্ব্ব ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, রাজধানী নিয়ে ব্রিটিশদের পলায়ন একটা জয় ছিল বটে। এমনও হতে পারে, রাজধানী সরানোতে অনেক বাঙালি বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ হয় ধীরে ধীরে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গে রাজধানী স্থাপন, বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ এবং বঙ্গ থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া- এসবই বাঙালি জাতিসত্তার উপলব্ধি জোরদার করেছিল এবং গর্ব বৃদ্ধি করেছিল। এ গর্ব দেশকাল ও রাজনীতিতে যে খর্ব হয় না, তা আমরা ভারত ভাগের অর্ধশতাব্দী পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস থেকে অবলোকন করেছি।
নানা যৌক্তিক কারণেই বাঙালি জাতিসত্তা একটি অনন্যসাধারণ রূপ ধারণ করে আছে। এ জাতিসত্তার অনুভূতিতে বাঙালি একটি জাতি, কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এ জাতি একক রাষ্ট্রত্বের দাবি কখনোই করেনি, যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুদূর অতীতে প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলটি বারবার দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল এবং অনেকবারই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। (এসবের মোটামুটি পূর্ণ বিবরণে আগ্রহীদের জন্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্যসংবলিত অনেক বিবরণ পাবেন, তবে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রকাশিত কালচারাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিরিজের ৩য় খণ্ড, ২০০৭ : ১-৬৪ দেখতে পারেন।) সর্বশেষ স্বাধীনতার সফল ডাক এসেছিল ১৯৭১ সালে। সফল হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটা পুরো বঙ্গে প্রযোজ্য হয়নি, ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভারতেই থাকল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু শত বিভাজনের মধ্যেও বিশেষত ধর্মীয় বিভাজন, এক-এক ধর্মীয় গোষ্ঠীতে শ্রেণীবিভাজন সত্ত্বেও বাঙালি জাতিসত্তার একতা ও একক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ প্রথমে ভারতের ও পরে বাঙালির, ভারতের অন্য অঞ্চলের লোকজন পশ্চিমবঙ্গে জোরেশোরে আসন গেড়েছে ইত্যাদি যতভাবেই প্রচার করা হোক না কেন, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে সর্বদাই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে এবং সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের অনেক কাছের ও আপন দেশ।
অনেক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নানাভাবে দুই বাংলার বাঙালিত্ব ধারণাটিই নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রও করছে নানা ফন্দিফিকিরে। বাঙালি জাতিসত্তার একতায় আঘাত করে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এবং ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিকভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকানির ফলে দুই বাংলার বাঙালিদের মধ্যে তিক্ততা ও বিরূপভাবাপন্নতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে চলে গেছেন এবং এখনো এক-দুজন করে যাচ্ছেন। এর ব্যাখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু সেসব আর যা-ই হোক 'দেশপ্রম' নয়। কারণ যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের দেশ এ বাংলাদেশই। আমাদের লজ্জা যে আমরা অসাম্প্রদায়িকতার অঙ্গীকার রাখতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের পরে ধর্মকে আমাদের মধ্যে আবার টেনে আনা হয়েছে- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর একাংশ জঙ্গি হয়ে উঠেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায়। এর জন্য দায়ী বাংলাদেশ। আমরা ৪১ বছর পরও জনগণকে সুশিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চারটি স্তম্ভ রক্ষা করতে পারিনি। দুই বাংলার একক জাতিসত্তা ধ্বংস হলে তার মাশুল আমাদেরই দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী
ব্রিটিশ আমলে বাঙালির জাতিসত্তার চেতনা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা অঞ্চল থেকে কিছুটা পৃথক ছিল বলে অনেকে মনে করেন (হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো); তখন অবশ্য ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। পরাধীনতার হীনম্মন্যতার সঙ্গে এই রাজধানিত্বের গৌরবও কিছুটা যে মিশ্রিত ছিল না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। সে সময় বাঙালির সংস্কৃতির ভিন্নতা তুলনা করা হতো ভারতের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে; কারণ জাতিসত্তা অবধাবনে সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এটাও স্বীকার না করে উপায় নেই যে বঙ্গের সাধারণ মানুষের জন্য পলাশী-পূর্ব ইতিহাসও এমন কোনো গৌরবের ইতিহাস ছিল না। কিন্তু শিক্ষার অভাবেই হোক বা না জানার ভান করেই হোক, বাঙালির কতকগুলো চেতনাবোধ সর্বদাই জাতিগতভাবে ভোঁতা হয়ে আছে। একটি হলো বাস্তবতা জ্ঞান, দ্বিতীয়টি তাত্ত্বিক জ্ঞান। বাঙালি ধর্মীয় জ্ঞানে সর্বদাই অগ্রসর ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকলেও সে কেন এতটা ধর্মপ্রবণ হয়ে উঠেছিল, তা অনেকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতসীনের ছত্রচ্ছায়ায় বাস করা বাঙালি নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করতেই এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিল, যাতে সাধারণ মানুষ নিপীড়ন, অবহেলা ও দৈন্য সহ্য করতে পারে। ক্ষমতাসীনরা ধর্মকে এমনভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে, যাতে তারা নিজেদের অবস্থা দৈব প্রদত্ত বলে মনে করে এবং পরলোকের সুখে মগ্ন থাকে। তাদের পক্ষে শ্রেণীবিভাজন অর্থাৎ সমাজে নিজেদের নিম্নস্থান কোনো পীড়ার জন্ম দেয় না, অমানবিক কষ্টের মধ্যেও না- তারা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর তাদের ব্যবস্থা করবেন। এসবই বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে চিরায়ত হয়ে গেছে এবং চিরায়ত সত্যতে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করতে আমরা ভুলি না।
ফলে সম্ভবত যুগ যুগ ধরে (কত যুগ আমি বলতে পারছি না, সেটার জন্য অন্য গবেষণার প্রয়োজন) বাঙালির বাস্তব শ্রেণীচেতনা তাত্ত্বিক তো নয়ই, যতটা জাগ্রত হতে পারত, তা হয়নি। এ অবস্থানটি উন্নত না অনুন্নত, সেটা এখানে বিচার্য নয়, তবে মেনে নিতেই হবে যে এ অবস্থানটিও বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। বাঙালি নানাভাবে তাদের জাতিসত্তার গর্ব নিয়ে বড়াই করেছে, এখনো করে। কলকাতা থেকে দিল্লিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হলে বাঙালির গর্ব কমে যায় বলে অনেকে মনে করেন- এটি একটি আজগুবি বক্তব্য। কারণ যে বাঙালি সশস্ত্র ও নিরস্ত্র- দুই ধরনের সংগ্রামে এ উপমহাদেশে ব্রিটিশদের অস্তিত্ব্ব ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, রাজধানী নিয়ে ব্রিটিশদের পলায়ন একটা জয় ছিল বটে। এমনও হতে পারে, রাজধানী সরানোতে অনেক বাঙালি বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ হয় ধীরে ধীরে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গে রাজধানী স্থাপন, বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ এবং বঙ্গ থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া- এসবই বাঙালি জাতিসত্তার উপলব্ধি জোরদার করেছিল এবং গর্ব বৃদ্ধি করেছিল। এ গর্ব দেশকাল ও রাজনীতিতে যে খর্ব হয় না, তা আমরা ভারত ভাগের অর্ধশতাব্দী পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস থেকে অবলোকন করেছি।
নানা যৌক্তিক কারণেই বাঙালি জাতিসত্তা একটি অনন্যসাধারণ রূপ ধারণ করে আছে। এ জাতিসত্তার অনুভূতিতে বাঙালি একটি জাতি, কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এ জাতি একক রাষ্ট্রত্বের দাবি কখনোই করেনি, যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুদূর অতীতে প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলটি বারবার দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল এবং অনেকবারই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। (এসবের মোটামুটি পূর্ণ বিবরণে আগ্রহীদের জন্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্যসংবলিত অনেক বিবরণ পাবেন, তবে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রকাশিত কালচারাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিরিজের ৩য় খণ্ড, ২০০৭ : ১-৬৪ দেখতে পারেন।) সর্বশেষ স্বাধীনতার সফল ডাক এসেছিল ১৯৭১ সালে। সফল হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটা পুরো বঙ্গে প্রযোজ্য হয়নি, ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভারতেই থাকল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু শত বিভাজনের মধ্যেও বিশেষত ধর্মীয় বিভাজন, এক-এক ধর্মীয় গোষ্ঠীতে শ্রেণীবিভাজন সত্ত্বেও বাঙালি জাতিসত্তার একতা ও একক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ প্রথমে ভারতের ও পরে বাঙালির, ভারতের অন্য অঞ্চলের লোকজন পশ্চিমবঙ্গে জোরেশোরে আসন গেড়েছে ইত্যাদি যতভাবেই প্রচার করা হোক না কেন, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে সর্বদাই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে এবং সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের অনেক কাছের ও আপন দেশ।
অনেক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নানাভাবে দুই বাংলার বাঙালিত্ব ধারণাটিই নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রও করছে নানা ফন্দিফিকিরে। বাঙালি জাতিসত্তার একতায় আঘাত করে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এবং ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিকভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকানির ফলে দুই বাংলার বাঙালিদের মধ্যে তিক্ততা ও বিরূপভাবাপন্নতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে চলে গেছেন এবং এখনো এক-দুজন করে যাচ্ছেন। এর ব্যাখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু সেসব আর যা-ই হোক 'দেশপ্রম' নয়। কারণ যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের দেশ এ বাংলাদেশই। আমাদের লজ্জা যে আমরা অসাম্প্রদায়িকতার অঙ্গীকার রাখতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের পরে ধর্মকে আমাদের মধ্যে আবার টেনে আনা হয়েছে- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর একাংশ জঙ্গি হয়ে উঠেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায়। এর জন্য দায়ী বাংলাদেশ। আমরা ৪১ বছর পরও জনগণকে সুশিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চারটি স্তম্ভ রক্ষা করতে পারিনি। দুই বাংলার একক জাতিসত্তা ধ্বংস হলে তার মাশুল আমাদেরই দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী
No comments