মাদক থেকে নতুন প্রজন্মকে বাঁচান by ডক্টর তুহিন মালিক
ক্ষমতার পালাবদল আর নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েই যেন জাতির সব চিন্তাশক্তি নিঃশেষ হতে চলেছে। অথচ আমাদের নতুন প্রজন্ম আজকে মারাত্মকভাবে সর্বনাশা মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। পাড়া-মহল্লা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়- সর্বত্র মাদকের ভয়াবহ হামলা চলছে।
যেন এক অদ্ভুত মাদক সংস্কৃতিতে ভুগছে আমাদের সন্তানরা। শহরের অভিজাত রাস্তায় এখন নানা রকমের লাউঞ্জ আর সিসা ক্যাফেতে চলছে নারী-পুরুষের অবাধ নেশাসেবন। অ্যামিউজমেন্ট ক্লাব নামে প্রকাশ্যে চলছে মদের বেচাকেনা। সমাজের উঁচু শ্রেণীর অমুক অমুক ক্লাব যেন নিরাপদ ও শান্তিতে মদ্যপানের অভয়াশ্রম। তাদের জন্য নেই কোনো ড্রাগ, নারকোটিক্স, লিকার আইন! সাধ্য আছে কারো এ প্রশ্ন করার? মুড়ি-মুড়কির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেচাবিক্রি হচ্ছে প্রাণঘাতী ইয়াবা ট্যাবলেট। ফেনসিডিল-হেরোইন বহু আগেই পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। তরুণ প্রজন্মের কাছে হাতছানি দিয়ে বেড়াচ্ছে এই নীল ছোবলের সংস্কৃতি। অথচ কী আশ্চর্য, দেশের নীতিনির্ধারকরা, রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের নেতারা, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে মুখে যেন কুলুপ এঁটে বসে আছেন দিব্যি! রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নয় বলে এটা যেন তাঁদের কোনো এজেন্ডাই নয়। এ কথা বললে তাঁরা বলবেন, কই, আমরা তো মাদক দিবসে শোভাযাত্রা করি, সেমিনার, লিফলেট, পোস্টার বানাই। এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের মন্ত্রণালয়, মাদক অধিদপ্তর আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তো রয়েছে বেশ বড় বড় ফর্দ। এসব ফর্দ দেখলে মনে হবে, দেশ মাদকমুক্ত হয়ে গেছে সেই কবে। টুকটাক যা কিছু আছে, সেগুলো তাদের নজরকে ফাঁকি দিতে পারছে না। এত বোতল ফেনসিডিল, এত পিস ইয়াবা বড়ি, এত বোতল বিদেশি মদ- আরো কত কী রয়েছে এসব ফিরিস্তি ফর্দে! অথচ তাদের নাকের ডগায় বসে প্রকাশ্য বাণিজ্য হচ্ছে এসব মাদকের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বড় একটা অংশ হচ্ছে তাদের সহযোগী। তাদের অনৈতিক আয়ের প্রধান অংশই আসে এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। অনেক সময় অনেক সৎ পুলিশ কর্মকর্তাকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অপরাধে। এমনকি র্যাবের চৌকস অফিসাররা পর্যন্ত হিমশিম খাচ্ছেন তাদের দাপটে।
মাদক বাণিজ্যের প্রভাবশালী শক্ত হাত যে কত দূর প্রসারিত তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। এক ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদাকে আইনে সোপর্দ আর তার শাস্তি বিধান করাটা কতটা চ্যালেঞ্জের, তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। মনে মনে ভাবলাম, এটা কি শুধুই র্যাবের একারই দায়িত্ব? তাদের একার পক্ষে কি এটা র্নিমূল করা সম্ভব? সমাজপতি কিংবা রাজনীতিবিদদের কি কিছুই করার নেই? এর বিরুদ্ধে একটা হরতাল-বিক্ষোভ তো দূরে থাক, জনমত গঠনে তাদের কি কোনো কর্মসূচি থাকতে নেই? কাদের জন্য আমাদের এসব রাজনীতি আর কর্মসূচি। যাদের জন্য আমাদের রাজনীতি, তারাই যদি বেঁচে না থাকে, তাহলে কিসের স্বার্থে এই রাজনীতি। গভীর ঘুমের মধ্যে আছি পুরো জাতি। এমন না হয়, যেন ঘুম থেকে জেগে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। আমরা হয়তো ভাবছি, আমার সন্তান তো নেশাখোর নয়। আমি কেন ভাবব। সবার অজান্তেই কিন্তু সূচনা হয় মাদকের। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ করে দেয় এই মরণনেশা- ধ্বংসই যার একমাত্র পরিণতি। তাই আমরা কেউ কিন্তু নিরাপদ নই।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর দেখে আতঙ্কিত হয়েছি রীতিমতো। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকের নামই উঠে এসেছে পত্রিকার রিপোর্টে- যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রথম দিকে ইয়াবা সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। এখন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই এ নেশায় আসক্ত। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীর ৮০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদকরাজ্যে। নব্বইয়ের দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও আজ সেই ইয়াবা নেশার রাজ্যকে শাসন করছে। ভারতে ভুলভুলাইয়া, থাইল্যান্ডে চকেলি, ইয়াবা বা পাগলা বড়ি আর বাংলাদেশে ইয়াবা এখন বহুলপরিচিত নাম। দেশে ঠিক কী পরিমাণ ইয়াবা ব্যবহৃত হচ্ছে, এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও আনুমানিক হিসাবে বলা হচ্ছে, এর পরিমাণ দৈনিক ১২ লাখ ট্যাবলেটের কম নয়। সোজা কথায় প্রতিদিন ইয়াবার মরণনেশা গ্রহণ করছে ১২ লাখ মানুষ। এ নেশার জন্য গড় ব্যয় জনপ্রতি ৩০০ টাকারও বেশি। গড়ে সর্বনিম্ন মাসিক ব্যয় ৯ হাজার টাকা। ফলে ইয়াবা কেনার জন্য অনেকে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নিশ্চিত হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়।
ডায়েট কন্ট্রোল আর ছিপছিপে শারীরিক গঠনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ইয়াবায় আসক্ত করা হচ্ছে। নেশার টাকা জোগাতে অনেকেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানির মতো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে প্রকৃত মাদকসেবীর সংখ্যা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তাদের মধ্যে বড় অংশ তরুণসমাজ। তাদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মহল্লার অন্ধকার গলি থেকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে মাদক। দেশে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা লক্ষাধিক। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী।
১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও জনবলের অভাবে এটি যেন অনেকটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নেশার উপকরণ হিসেবে ৩২ ধরনের মাদকদ্রব্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মাদকদ্রব্যের তালিকায় সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। দেশে মাদকাসক্তের তুলনায় নিরাময়কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সমাজকে মাদকমুক্ত করতে হলে জনসচেতনার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে। দেশে মাদকের বিস্তার রোধ করতে হলে উৎসমূলেই একে ঠেকাতে হবে। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই চলবে না, মাদকের ভয়ংকর নেশা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সামাজিকভাবে মাদককে নিরুৎসাহ করতে হবে।
এ দেশে মাদকসম্রাটদের কেউ প্রকাশ্যে আসে না কখনো, ধরাছোঁয়া তো দূরে থাক। আমিন হুদার মতো ভিআইপি মাদকসম্রাটরা কদাচিৎ ধরা পড়ে আইনের হাতে। মাদক ব্যবসায়ীর চেয়ে মাদকের বাহকরাই বেশি ধরা পড়ে। তা সত্ত্বেও দেশে মাদক অপরাধের মামলার সংখ্যা কয়েক হাজার। মামলা দায়ের করেই যেন কাজ শেষ আমাদের। বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে এসব মামলা। উপযুক্ত সাক্ষীর অভাব ও সাক্ষীরা শেষ পর্যন্ত ঠিক না থাকার কারণে তাদের শাস্তি হয় না। তা ছাড়া তদন্তকাজে কর্মকর্তার আত্মসমর্পণ ও গাফিলতিসহ নানা কারণে তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে। অঢেল টাকার জোরে এসব আসামি দেদারছে খালাস পেয়ে যাচ্ছে অহরহ। নামিদামি উকিলের আর্গুমেন্টে খুব সহজেই তারা জামিনে বের হয়ে আসছে। একান্তই নিম্ন আদালতে না হলেও হাইকোর্টে কিন্তু নানা রকম আইন ও ঘটনার মারপ্যাঁচে বিচারকরা বাধ্য হন তাদের জামিন দিতে। তাদের জামিন আবেদন আর মামলার শুনানিতে আইনজীবীর বহর দেখে কোর্টরুমে বসার কোনো জায়গাই পাওয়া যায় না। মাদকের মামলা করে অনেক আইনজীবীকে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে দেখেছি প্রায় দুই দশকে আমার ওকালতি জীবনে। হয়তো আমি ভুলভাবে দেখেছি এসব। অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়ানোর দায়িত্ব হয়তো আমাদের রয়েছে ঠিকই, তবে বিবেকের জানালাটা খোলা রাখার প্রার্থনা করি বিনীতভাবেই। পাছে ভয়ও পাই, আবার কোন কথায় না আমার ওকালতি চলে যায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে তো আর প্রলয় বন্ধ হচ্ছে না। মাদকের ছোবল টগবগিয়ে তেড়ে আসছে আমাদের সবার পরিবারে। কি উকিল, কি পুলিশ, কি বিচারক, কি রাজনীতিবিদ, কি সমাজপতি বা সাধারণ মানুষ- রক্ষা নেই কারো। কেননা আমাদের সবাইকে নিয়েই তো একটা জাতি। এ জাতির পরবর্তী প্রজন্ম কাদের নিয়ে হবে? নিশ্চয়ই মাদকাসক্তদের নিয়ে নয়। এর নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা আর অঙ্গীকার তো আমাদেরই করতে হবে, নয় কি?
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
মাদক বাণিজ্যের প্রভাবশালী শক্ত হাত যে কত দূর প্রসারিত তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। এক ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদাকে আইনে সোপর্দ আর তার শাস্তি বিধান করাটা কতটা চ্যালেঞ্জের, তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। মনে মনে ভাবলাম, এটা কি শুধুই র্যাবের একারই দায়িত্ব? তাদের একার পক্ষে কি এটা র্নিমূল করা সম্ভব? সমাজপতি কিংবা রাজনীতিবিদদের কি কিছুই করার নেই? এর বিরুদ্ধে একটা হরতাল-বিক্ষোভ তো দূরে থাক, জনমত গঠনে তাদের কি কোনো কর্মসূচি থাকতে নেই? কাদের জন্য আমাদের এসব রাজনীতি আর কর্মসূচি। যাদের জন্য আমাদের রাজনীতি, তারাই যদি বেঁচে না থাকে, তাহলে কিসের স্বার্থে এই রাজনীতি। গভীর ঘুমের মধ্যে আছি পুরো জাতি। এমন না হয়, যেন ঘুম থেকে জেগে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। আমরা হয়তো ভাবছি, আমার সন্তান তো নেশাখোর নয়। আমি কেন ভাবব। সবার অজান্তেই কিন্তু সূচনা হয় মাদকের। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ করে দেয় এই মরণনেশা- ধ্বংসই যার একমাত্র পরিণতি। তাই আমরা কেউ কিন্তু নিরাপদ নই।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর দেখে আতঙ্কিত হয়েছি রীতিমতো। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকের নামই উঠে এসেছে পত্রিকার রিপোর্টে- যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রথম দিকে ইয়াবা সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। এখন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই এ নেশায় আসক্ত। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীর ৮০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদকরাজ্যে। নব্বইয়ের দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও আজ সেই ইয়াবা নেশার রাজ্যকে শাসন করছে। ভারতে ভুলভুলাইয়া, থাইল্যান্ডে চকেলি, ইয়াবা বা পাগলা বড়ি আর বাংলাদেশে ইয়াবা এখন বহুলপরিচিত নাম। দেশে ঠিক কী পরিমাণ ইয়াবা ব্যবহৃত হচ্ছে, এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও আনুমানিক হিসাবে বলা হচ্ছে, এর পরিমাণ দৈনিক ১২ লাখ ট্যাবলেটের কম নয়। সোজা কথায় প্রতিদিন ইয়াবার মরণনেশা গ্রহণ করছে ১২ লাখ মানুষ। এ নেশার জন্য গড় ব্যয় জনপ্রতি ৩০০ টাকারও বেশি। গড়ে সর্বনিম্ন মাসিক ব্যয় ৯ হাজার টাকা। ফলে ইয়াবা কেনার জন্য অনেকে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নিশ্চিত হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়।
ডায়েট কন্ট্রোল আর ছিপছিপে শারীরিক গঠনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ইয়াবায় আসক্ত করা হচ্ছে। নেশার টাকা জোগাতে অনেকেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানির মতো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে প্রকৃত মাদকসেবীর সংখ্যা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তাদের মধ্যে বড় অংশ তরুণসমাজ। তাদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মহল্লার অন্ধকার গলি থেকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে মাদক। দেশে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা লক্ষাধিক। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী।
১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও জনবলের অভাবে এটি যেন অনেকটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নেশার উপকরণ হিসেবে ৩২ ধরনের মাদকদ্রব্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মাদকদ্রব্যের তালিকায় সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। দেশে মাদকাসক্তের তুলনায় নিরাময়কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সমাজকে মাদকমুক্ত করতে হলে জনসচেতনার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে। দেশে মাদকের বিস্তার রোধ করতে হলে উৎসমূলেই একে ঠেকাতে হবে। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই চলবে না, মাদকের ভয়ংকর নেশা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সামাজিকভাবে মাদককে নিরুৎসাহ করতে হবে।
এ দেশে মাদকসম্রাটদের কেউ প্রকাশ্যে আসে না কখনো, ধরাছোঁয়া তো দূরে থাক। আমিন হুদার মতো ভিআইপি মাদকসম্রাটরা কদাচিৎ ধরা পড়ে আইনের হাতে। মাদক ব্যবসায়ীর চেয়ে মাদকের বাহকরাই বেশি ধরা পড়ে। তা সত্ত্বেও দেশে মাদক অপরাধের মামলার সংখ্যা কয়েক হাজার। মামলা দায়ের করেই যেন কাজ শেষ আমাদের। বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে এসব মামলা। উপযুক্ত সাক্ষীর অভাব ও সাক্ষীরা শেষ পর্যন্ত ঠিক না থাকার কারণে তাদের শাস্তি হয় না। তা ছাড়া তদন্তকাজে কর্মকর্তার আত্মসমর্পণ ও গাফিলতিসহ নানা কারণে তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে। অঢেল টাকার জোরে এসব আসামি দেদারছে খালাস পেয়ে যাচ্ছে অহরহ। নামিদামি উকিলের আর্গুমেন্টে খুব সহজেই তারা জামিনে বের হয়ে আসছে। একান্তই নিম্ন আদালতে না হলেও হাইকোর্টে কিন্তু নানা রকম আইন ও ঘটনার মারপ্যাঁচে বিচারকরা বাধ্য হন তাদের জামিন দিতে। তাদের জামিন আবেদন আর মামলার শুনানিতে আইনজীবীর বহর দেখে কোর্টরুমে বসার কোনো জায়গাই পাওয়া যায় না। মাদকের মামলা করে অনেক আইনজীবীকে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে দেখেছি প্রায় দুই দশকে আমার ওকালতি জীবনে। হয়তো আমি ভুলভাবে দেখেছি এসব। অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়ানোর দায়িত্ব হয়তো আমাদের রয়েছে ঠিকই, তবে বিবেকের জানালাটা খোলা রাখার প্রার্থনা করি বিনীতভাবেই। পাছে ভয়ও পাই, আবার কোন কথায় না আমার ওকালতি চলে যায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে তো আর প্রলয় বন্ধ হচ্ছে না। মাদকের ছোবল টগবগিয়ে তেড়ে আসছে আমাদের সবার পরিবারে। কি উকিল, কি পুলিশ, কি বিচারক, কি রাজনীতিবিদ, কি সমাজপতি বা সাধারণ মানুষ- রক্ষা নেই কারো। কেননা আমাদের সবাইকে নিয়েই তো একটা জাতি। এ জাতির পরবর্তী প্রজন্ম কাদের নিয়ে হবে? নিশ্চয়ই মাদকাসক্তদের নিয়ে নয়। এর নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা আর অঙ্গীকার তো আমাদেরই করতে হবে, নয় কি?
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
No comments