জ্বালানি সংকট- বিকল্প শক্তির উদ্ভাবন by হাসান কামরুল

পরিবেশ-প্রতিবেশসহ জীববৈচিত্র্যের কথা বিবেচনায় এনে সবুজ পৃথিবী বিনির্মাণে কার্বন সমৃদ্ধ কয়লা মানুষের কল্যাণে খুব বেশিদিন আর ব্যবহার হবে না। তাই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু সূর্যালোক নয়, মানুষকে সংশ্লিষ্ট হতে হবে বায়ুর ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীজুড়েই জ্বালানি সংকট চলছে। পেট্রো ডলারের ওপরই নির্ভরশীল বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি। যে দেশ যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সে দেশের কদর পৃথিবীজুড়ে তত বেশি। তেল, কয়লা ও গ্যাস_ এ তিন সম্পদকেন্দ্রিক মানুষের জীবনচিত্র। গত বছর পর্যন্ত পৃথিবীর জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৮৫ ভাগই তেল, গ্যাস ও কয়লা পূরণ করেছে। ৩৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েলের মাধ্যমে। ২৩ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা মিটেছে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে এবং ২৫ শতাংশ বিশ্ব জ্বালানির চাহিদা পূরণ হয়েছে প্রাকৃতিক কয়লা থেকে। কয়লার মজুদ ও উত্তোলনের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে কয়েকশ' বিলিয়ন টন কয়লা জনকল্যাণে তেমন কোনো কাজেই আসছে না। বিশ্ব চাহিদার শতকরা ২৫ ভাগ কয়লা থেকেই উৎপন্ন হচ্ছে পৃথিবীর ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎ। এ কথাও সত্য, পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণের শতকরা ৪৩ শতাংশই হচ্ছে কয়লা পোড়ানোর কারণে। তা জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এ ৪৩ শতাংশ কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন টন কয়লা পোড়ানোর ফলে। কার্বন পোড়ানোর দিক থেকে ভারত প্রথম ও চীন নবম স্থান দখল করে আছে।
পৃথিবীর শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে পারমাণবিক তাপশক্তির বিকিরণের ফলে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানির চাহিদার ২৫ শতাংশই পূরণ হচ্ছে নিজস্ব জীবাশ্ম জ্বালানির খনির উৎপাদন থেকে এবং শতকরা ৭০ ভাগ জ্বালানিই যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে থাকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে। তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর ৬১ শতাংশ তেল খনি এ অঞ্চলে অবস্থিত। রাশিয়ায় পৃথিবীর জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ রয়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ রয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। খনিজসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার ওপরই জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ মহল। বিকল্প জ্বালানির উদ্ভাবন নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়েছে গোটা পৃথিবীতে। এখন পর্যন্ত তেলকূপ থেকে উৎপাদিত আবিষ্কৃত তেলের মজুদ রয়েছে ২০০ ট্রিলিয়ন ব্যারেল। পৃথিবীর প্রতি বছর তেলের চাহিদা রয়েছে ৩১ বিলিয়ন ব্যারেল। গত পাঁচ বছরে তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৫৫ ইউএস ডলার। তা বর্তমানে ১০০ ডলারে গড়িয়েছে। গত ৩০ বছরে নতুন তেলকূপ খনন বা রিজার্ভ তেমন একটা আবিষ্কৃত হয়নি। দু'চারটি নতুন তেলকূপের সন্ধান পাওয়া গেলেও এ থেকে রেকর্ডসংখ্যক উৎপাদন যোগ হয়নি। ভূবিজ্ঞানীদের ভাষায়_ পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ এখন নিম্নমুখী। অতি সম্প্রতি ব্রাজিল তার উপসাগরে বিপুল প্রাকৃতিক তেলের মজুদ আবিষ্কার করেছে। বর্তমান তেলের যে মজুদ রয়েছে তা দিয়ে হয়তো পৃথিবী আরও ৪০ বছর চলতে পারবে। এর মধ্যে যদি নতুন কোনো কূপ বা আধার আবিষ্কার করা না যায় তবে তা পৃথিবীকে গভীর এক সংকটে ফেলে দেবে। ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণায় স্পষ্ট, কেবল প্রতি বছর ৩-৫ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহারজনিত অজ্ঞতার কারণে অপচয় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক তেল ব্যবহারের হার পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ। জাপান ব্যবহার করে শতকরা ১৪, স্পেন ১৩ দশমিক ৮, মেক্সিকো ৬, ব্রাজিল ৩ দশমিক ৫, চীন ১ দশমিক ৫ এবং ভারত ব্যবহার করে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ ভাগ (সূত্র : সিমন্স অ্যান্ড কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল)। বিশ্বজুড়ে তেলের চাহিদা প্রতিদিনকার বিপরীতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হচ্ছে। তাই বিকল্প জ্বালানির কথা জোরেশোরেই ধ্বনিত হচ্ছে।
বায়ু, পানি ও সৌরালোকের ব্যবহারের দিকেই নজর দিচ্ছে দুনিয়ার তাবৎ ভূবিজ্ঞানী। এর মধ্যে সূর্যের আলোর ব্যবহারের বিভিন্ন কৌশলও নিরূপণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সোলার প্যানেল দুনিয়াজুড়েই এখন খুব পরিচিত শব্দ। সূর্যের আলোর বিশাল এ শক্তির উৎস নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগের সহজলভ্য দিক উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছে পৃথিবীর বড় বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস থেকে শুরু করে বড় বড় বাণিজ্যিক ভবনে সোলার প্যানেলের ব্যবহার বিশ্বকে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত ও ইউরোপীয় অঞ্চলে সৌরশক্তির ব্যবহারে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশও। সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ৪০ লাখ পরিবারের মধ্যে সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে আরও ৪০ লাখ পরিবারকে সোলার প্যানেলের আওতায় নিয়ে আসার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনবায়নযোগ্য কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, প্রাকৃতিক তেল ও ইউরেনিয়ামের মতো সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। কেননা প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধ মজুদ একদিন না একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই পৃথিবীকে নবায়নযোগ্য বিকল্প শক্তির দিকে ধাবিত হতে হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশসহ জীববৈচিত্র্যের কথা বিবেচনায় এনে সবুজ পৃথিবী বিনির্মাণে কার্বন সমৃদ্ধ কয়লা মানুষের কল্যাণে খুব বেশিদিন আর ব্যবহার হবে না। তাই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সূর্যালোক নয়, মানুষকে সংশ্লিষ্ট হতে হবে বায়ুর ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। জলবিদ্যুতের দিকেও সমান হারে ঝুঁকে পড়তে হবে আধুনিকতা ও সভ্যতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

হাসান কামরুল :কলাম লেখক
swapnaa007@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.