এই অধঃপতন কি অরোধ্য by মনজুর আহমদ
ভয়ঙ্কর এক খবরে স্তম্ভিত হয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষ। স্তম্ভিত প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশীরাও। খবরটি হচ্ছে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা জুনিয়র ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা করান। খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের নানান আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে বাধ্য করেন। ছাত্রীদের যেতে বাধ্য করা হয় নেতাদের বাসায়, এমনকি মন্ত্রীদের কাছেও।
এই দেহব্যবসা নিয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের দুই বিবদমান গ্রুপের মধ্যে ঘটে গেছে সংঘর্ষের ঘটনা। আর এ সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ সব কাহিনী। পরিস্থিতির শিকার কিছু ছাত্রী বলেছেন, নেত্রীদের নির্দেশ মেনে নির্দিষ্ট স্থানে যেতে অস্বীকার করায় তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম অত্যাচার। লোহার রড দিয়ে পর্যন্ত তাদের পেটানো হয়েছে। বের করে দেয়া হয়েছে হোস্টেল থেকে।নিঃসন্দেহে এ এক ভয়াবহ খবর। কলেজে পড়তে পাঠানো মেয়েকে দেহব্যবসায় লিপ্ত করা আমাদের সমাজে এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার। শুধু আমাদের সমাজই বা বলি কেন, পৃথিবীর কোনো সমাজই নিজের ঘরের মেয়ের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের মতো যেসব সমাজ পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচিকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে থাকে, সেসব সমাজে মেয়ের কোনো ধরনের স্খলনের ঘটনা পরিবারে ধস নামিয়ে দেয়। যে আমেরিকায় আমার এখন বসবাস এই ফ্রি সেক্স বা অবাধ যৌনতার দেশেও পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ। এ দেশে পতিতা আছে; কিন্তু পতিতাবৃত্তি বেআইনি। অবশ্য আইনের চোখে ধুলো দিয়ে বহু মহিলা দেহব্যবসা করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছে।
ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ঘটনায় পত্র-পত্রিকার খবরে তাদের দেহব্যবসায়ে লিপ্ত করানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, নেতা-মন্ত্রীদের বাড়ি ও অন্যান্য স্থানে পাঠিয়ে জুনিয়র ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা করানো হতো। শুধু ইডেন নয়, বদরুন্নেসা কলেজও নাকি এমন ঘটনা থেকে মুক্ত নয়। একই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে শিউরে ওঠার মতো আরও একটি তথ্য। তা হলো শুধু কলেজের নিচু ক্লাসের কম বয়সী মেয়েরাই নয়, ছাত্রলীগ নেত্রীরা বাইরে থেকে নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রীদেরও হোস্টেলে এনে তাদেরও এই অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। ছাত্রলীগ করা এসব মেয়ের সামনে তুলে ধরা হয় নানা প্রলোভন। ভবিষ্যতে বড় নেত্রী বানানো, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, ভবিষ্যতের উজ্জ্বল জীবন ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগ ব্যাপক অনাচার-অপকীর্তি চালিয়ে দেশজুড়ে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে তারই এক নতুন ও ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত ইডেন কলেজের এ ঘটনা। এ ঘটনায় দেশের সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হলেও সরকারের টনক নড়েছে কি না ঠাহর হচ্ছে না। সরকার ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কার্যকলাপে অসন্তোষ প্রকাশ করে এ সংগঠনের ওপর থেকে তার কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত রয়েছেন। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেননি। এ থেকে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয় যে, সরকার ছাত্রলীগকে যা খুশি করার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। এমন অবাধ সুযোগ ছাত্রলীগ সদ্ব্যবহারও করছে পুরোপুরি। শক্তিমদমত্ততায় তারা দেশজুড়ে এক অরাজকতার সৃষ্টি করেছে। আর এমন সব কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা অধঃপতনে নিয়ে চলেছে ছাত্রলীগকে। অধঃপতনে নিয়ে চলেছে দেশকে। ছাত্রলীগ করার অর্থ এখন দাঁড়িয়েছে নিজেদের বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলা। এই বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলতে টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য প্রভৃতির পাশাপাশি নারী ব্যবসার মতো ঘৃণিত কাজ করা থেকেও তারা বিরত থাকছে না এবং এই নারী ব্যবসায়ে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের নিয়োজিত করতেও ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিবেকে বাঁধছে না। বিবেকের কাছে লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, এমন একটি ন্যক্কারজনক ব্যাপার নিয়ে তারা দুই গ্রুপ প্রকাশ্যে মারামারি-সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও দ্বিধা করছে না।
শুধু ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা করানোই নয়, পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের এই নেত্রীরা ভর্তি বাণিজ্য এমনকি বিষয় বদল থেকেও বিপুল অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন। গত বছর ভর্তি হওয়া ৭০০ এবং এ বছর ভর্তি হওয়া ৯০০ ছাত্রীর প্রতিজনের কাছ থেকে ছাত্রলীগ নেত্রীরা নাকি সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেছেন।
দুঃখ লাগে, সংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগের আজকের এ অবস্থা দেখে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতারা কিংবা অতীতের নেতারা কি কখনও ভেবেছিলেন তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আদর্শে গড়ে ওঠা সংগঠনটি সব আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে এমন একটি বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার কামধেনুতে পরিণত হবে?
কিন্তু কেমন করে সম্ভব সংবিধানসম্মতভাবে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক দেশে কোনো সংগঠনের পক্ষে এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠা? কেমন করে সম্ভব দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী যা খুশি তাই করা? এর জবাবে অনস্বীকার্যভাবে একটি কথাই বলা যায়, এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠা তখনই সম্ভব, যখন পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। আগেই বলেছি, সরকার ছাত্রলীগের ব্যাপারে নির্বিকার। প্রধানমন্ত্রী মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। তাহলে এদের রোধ করবে কে? একটি সত্য অনুধাবনের মতো বোধশক্তি এ সরকারের নিশ্চয় লোপ পায়নি যে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলার অধিকার পেয়েই আজকের নেতৃত্ব এত নিচে নামিয়েছে সংগঠনকে। বিত্ত-বৈভবে ফুলে-ফেঁপে ওঠার নেশায় মরিয়া এ নেতৃত্ব নারী ব্যবসার মতো ঘৃণ্য কাজেও নেমে পড়তে দ্বিধা করেনি। একে আমি তাদের অধঃপতন হিসেবেই অভিহিত করতে চাই। আর বাস্তবিক অর্থে এ ধরনের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের দেশকেই এক নৈতিক সর্বনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের এবং সমাজের এমন সম্ভাব্য সর্বনাশ রোধে কি কেউ এগিয়ে আসবেন না? আমরা কি অসহায়ের মতো শুধু দেশ ও জাতির এই অরোধ্য অধঃপতনকে নির্বিকার প্রত্যক্ষ করতে থাকব?
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী, প্রবীণ সাংবাদিক
No comments