চীন ও ভারত-এই শতাব্দীর প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তি by গওসল আযম
বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিবিধির দিকে একটু গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় যে, এশিয়ারই বিরাট আকৃতির আরেকটি দেশ ভারত_ চীনের প্রতিযোগী। পরস্পরের প্রতি সম্পর্ক কী হবে তা দেশ দুটি ঠিক করবে।
তবে তাদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে একবিংশ শতাব্দী বিংশ শতাব্দীর মতো রক্তক্ষয়ী হবে কি-নাবৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কিত প্রাপ্ত তথ্যাদির যাচাই-বাচাই করে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দৃষ্টিগোচর হলো, চীন জাপানকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা যে হবে তা অনেকদিন আগে থেকেই আঁচ করা হয়েছিল। তাই বিষয়টি নিয়ে তেমন মাতামাতি না হলেও মনে করা হচ্ছে, চীন নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিরাজ করবে। তাই বলে ভাবার কোনো অবকাশই নেই যে, আমেরিকাই হবে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী। বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিবিধির দিকে একটু গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় যে, এশিয়ারই বিরাট আকৃতির আরেকটি দেশ ভারত_ চীনের প্রতিযোগী। পরস্পরের প্রতি সম্পর্ক কী হবে তা দেশ দুটি ঠিক করবে। তবে তাদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে একবিংশ শতাব্দী বিংশ শতাব্দীর মতো রক্তক্ষয়ী হবে কি-না । এই পর্যায়ে চীন ও ভারতের সম্পর্ক পরস্পরের প্রতি অর্থনৈতিক কারণে অনুকূল মনে হলেও তারা উভয়েই সন্দিহান। চীনারা মনে করে, তাদের উত্থানে পশ্চিমা শক্তি ঈর্ষাপরায়ণ। পশ্চিমা শক্তি চাতুর্যের সঙ্গে বৈশ্বিক বোঝা চীনের ওপর চাপাতে চায়। ফলে তারা চীনের চতুর্দিকে তাদের ক্ষমতার বলয় তৈরিতে তৎপর। আমেরিকা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মিত্র। আবার তাইওয়ান নিজেকে যাতে রক্ষা করতে পারে, তার জন্য অস্ত্র প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বোপরি চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্ব। এখন আবার বন্ধুত্ব ভিয়েতনামের সঙ্গে। শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি কারিগরি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে। নৌবাহিনীতে যোগ করছে তাদের তৈরি নিত্যনতুন যুদ্ধ সরঞ্জাম। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে বাড়ছে তাদের আগ্রহ। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের আরব সাগর ঘেঁষে গাওদার একটি সমুদ্রবন্দর। বন্দরটি নির্মাণ করে দিচ্ছে চীন। বিনিয়োগের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার। চীন তার পূর্ব অঞ্চল ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিতে চায়। শ্রীলংকার হামবানটোটোয় চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। মিয়ানমারে রয়েছে নৌবাহিনীর রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরও বেশ কয়েকটি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। অন্য কথায় চীন তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে ভারত মহাসাগরভুক্ত এলাকায় গড়ে তুলছে বিশাল এক সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য অতীব আগ্রহী। বাংলাদেশ এ আগ্রহ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম ও চীনের সঙ্গে মিয়ানমার হয়ে সরাসরি রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী। চীন এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে তার সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
এমনিতেই ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধের ঘা এখনও দগদগে, বিশেষ করে সেই সময়ের সামরিক অফিসার এবং রাজনীতিবিদদের মনে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ লাভের অন্তরায় হিসেবে চীন অব্যাহতভাবে ক্রিয়াশীল। ভারত বৈরী পাকিস্তানের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। বৃহত্তর স্বার্থে চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেললেও তিব্বত এবং কাশ্মীরের ব্যাপারে কঠোরতর মনোভাব ও কার্যকলাপের অহরহ প্রকাশ ঘটাছে। দুটি ইস্যুর গুরুত্বই অপরিসীম। এ দুটিকে কেন্দ্র করে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬২ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি তিব্বতের ভেতর দিয়েই তাওয়াং দুই সপ্তাহের জন্য দখল করেছিল। দখল করেছিল অরুণাঞ্চলের সিংহভাগ এবং কাশ্মীরের একটি স্লাব। মারা পড়েছিল তিন হাজার ভারতীয় ফৌজ এবং নর-নারী। তাওয়াংয়ের অধিবাসীদের স্মৃতিতে চীনাদের ক্ষতি এখনও ভাস্বর। তারা এখনও মনে করে, চীনা সৈন্যরা ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও অত্যন্ত সদয় এবং সাহায্যের হাত সদাপ্রস্তুত। তারা গম ও আলু চাষে সাহায্য করেছে। এর অর্থ এই নয় যে, তারা দিলিল্গর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না। তারা এখনও দিলিল্গর প্রতি আস্থাশীল এবং ভারতীয় হওয়াই ভালোবাসে, অরুণাঞ্চলের জন্য আছে ভারতের আরও একটি সংরক্ষিত সৈন্যের দল এবং কিছু সুখোই যুদ্ধ বিমান যা সীমান্ত রক্ষার জন্য বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ বাস করে চীন এবং ভারতে। ১৯৭২ সালে চীন-ভারত সম্পর্ক পুনর্স্ট্থাপিত হওয়ার পর উত্তরোত্তর গভীর হয়েছে। ঘটেছে এর পরিব্যাপ্তি। চীন এবং ভারতের প্রবৃদ্ধির হার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি। বছর দুয়েকের মধ্যেই ভারত জাপানকে অতিক্রম করে চীনের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধি যত বাড়ছে ততই বাড়ছে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৯০ সালে চীন ও ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৭০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে এ বছর ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা। চীন ও ভারত উভয়েই আফ্রিকার তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে উভয়েই আফ্রিকার তেলপ্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। মজার কথা এই যে, চীন ও ভারতের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিপরীতধর্মী। চীনের আর্থিক খাত উৎপাদনমুখী। ভারতের সেবামুখী। সুতরাং তাদের মধ্যে গভীর সখ্যের ক্ষেত্র অত্যন্ত উর্বর। এর জন্য পশ্চিমা সংবাদপত্র নতুন একটা শব্দ সংযোজন করেছে। শব্দটি চীন্ডিয়া। বিশ্ববাণিজ্য এবং বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে চীন্ডিয়ার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চীন্ডিয়া আর্থিক উন্নতি লাখ লাখ মানুষকে, বিশেষ করে চীনের দারিদ্র্যসীমার বাইরে টেনে এনেছে। চীন এখন উন্নয়নের যে কোনো মাপকাঠিতে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সুতরাং ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভাবলেও চলে। বৈরিতার বা দ্বন্দ্বের সম্পর্কের পুনরুত্থান চীন্ডিয়ার শুধু ভাবমূর্তিরই ক্ষতি করবে না, ক্ষতি করবে উভয়ের এগিয়ে যাওয়াকে যা কারোরই কাম্য নয়। তাছাড়াও উভয়ের রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য। সুতরাং চীন্ডিয়া পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করলে বিশ্ব চীন্ডিয়ার সঙ্গে উপকৃত হবে। চীন্ডিয়ার রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক সৈন্য যার সংখ্যা ৪০ লাখ। আছে মানববিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র। চীন্ডিয়া পুরনো দ্বন্দ্বে ফিরে গেলে উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন্ডিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের দীর্ঘ পরিসরে রয়েছে খানাখন্দ এবং চোরাবালি। অনেকেই মনে করেন, তেলকে কেন্দ্র করে চীন্ডিয়ার প্রতিযোগিতা বৈরী ভাবের রূপান্তর মেটাতে পারে। আফ্রিকার তেলপ্রাপ্তির ব্যপারে তাদের সহযোগিতা সাময়িক এবং পরীক্ষামূলক।
পানিপ্রাপ্তির ব্যাপারে চীন্ডিয়ার সম্পর্ক ভৌগোলিক কারণে প্রকৃতিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। উত্তর ভারতের ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ ক'টি নদীর উৎসস্থল তিব্বত। ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃতি আবার বাংলাদেশ পর্যন্ত। চীন ঘোষণা করেছে, ব্রহ্মপুত্রের নদে ইয়ারলুঙ্গ সাংপাও বাঁধ নির্মাণ করবে। চীনের বাঁধ নির্মাণ ভারতের জন্য ভীতি হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারত মনে করে, বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে চীনা কৃষকদের দেবে। চীনে ভারতের রফতানির শতকরা ৭০ ভাগ কাঁচামাল এবং বিশেষত আয়রন ওর। চীন শুল্কমুক্ত রফতানির যে সুবিধা ভারতকে দেয় আয়রন ওর তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এখানেই ভারতের অসন্তুষ্টি। ভারতের উৎপাদন খাত এখনও প্রতিযোগিতামূলক নয়। চীন পিছিয়ে আছে আইটিসেবার ক্ষেত্রে। তবে অচিরেই চীন তা কাটিয়ে উঠবে।
চীন্ডিয়ার ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উর্বরক্ষেত্র তাদের দীর্ঘ ৪০ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত। ১৯৬২ সালে চীনা অভিযানের পরেও সীমান্তরেখার সিংহভাগ অনির্দিষ্ট। উত্তর ভারতের অনির্দিষ্ট সীমানায় ভারত সুইজারল্যান্ডের আয়তনের সমপরিমাণ ভূখণ্ড তাদের বলে দাবি করে। চীন এই ভূখণ্ড তাদের লাদাখের অন্তর্ভুক্ত বলে দখলে রেখেছে। পূর্বের অংশে চীন দাবি করে, সুইজারল্যান্ডের আয়তনের তিনগুণ ভূখণ্ড যার অন্তর্ভুক্ত অরণ্যাঞ্চলের সিংহভাগ। এর জন্য দায়ী ম্যাকমোহন লাইন। ৪৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ ম্যাকমোহন টানা হয়েছিল ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বৈদেশিক সচিব স্যার ম্যাকমোহন কর্তৃক। চীন মনে করে, ম্যাকমোহন লাইন তাদের জন্য অপমান। ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণে তাওয়াংয়ের অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও ভারত ১৯৫১ সালে দখল করে নেয় চীন তিব্বতে তাদের সৈন্য প্রেরণের পর। ভারতের তাওয়াং দখলকে চীন মনে করে অনৈতিক, যুক্তিহীন এবং মানবতাবিহীন। ম্যাকমোহন লাইন চীন্ডিয়ার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে স্যার ম্যাকমোহনের একটি ভুলের জন্য। তিনি ম্যাকমোহন লাইন টেনেছিলেন একটি মোটানিব দিয়ে, যার বিস্তৃতি হিসাব অনুযায়ী ১০ কিলোমিটার যা নিয়ে চীন্ডিয়ার যে কোনো সময় ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভবনা। চীন্ডিয়ার সম্পর্ক আন্তরিকতাবিহীন এবং অবিশ্বাস্যপূর্ণ। তাদের সীমান্ত রক্ষীরা প্রায়ই সীমান্তে অবৈধ প্রবেশের জন্য পরস্পরকে দায়ী করে এবং প্রমাণস্বরূপ সিগারেট এবং নুডলসের প্যাকেট দাখিল করে, যা জঞ্জাল বই কিছুই নয়। তবুও এ ধরনের মহড়া অত্যন্ত সতর্কভাবে চলছে। এই অবস্থায় চীন্ডিয়ার বিবদময় ক্ষেত্রগুলোর যে কোনো একটি থেকে রণদামামা বাজার আশঙ্কা থাকতেই পারে। তবে তা এড়িয়ে চলা উভয়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। চীন্ডিয়ার যে দ্বন্দ্ব তা বিরাজমান থাকবে মানুষের শঙ্কায় একবিংশ শতাব্দীর আশঙ্কা হিসেবে।
গওসল আযম : সাবেক মহাসচিব, আইবিবি ও কলাম লেখক
এমনিতেই ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধের ঘা এখনও দগদগে, বিশেষ করে সেই সময়ের সামরিক অফিসার এবং রাজনীতিবিদদের মনে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ লাভের অন্তরায় হিসেবে চীন অব্যাহতভাবে ক্রিয়াশীল। ভারত বৈরী পাকিস্তানের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। বৃহত্তর স্বার্থে চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ মিটিয়ে ফেললেও তিব্বত এবং কাশ্মীরের ব্যাপারে কঠোরতর মনোভাব ও কার্যকলাপের অহরহ প্রকাশ ঘটাছে। দুটি ইস্যুর গুরুত্বই অপরিসীম। এ দুটিকে কেন্দ্র করে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬২ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মি তিব্বতের ভেতর দিয়েই তাওয়াং দুই সপ্তাহের জন্য দখল করেছিল। দখল করেছিল অরুণাঞ্চলের সিংহভাগ এবং কাশ্মীরের একটি স্লাব। মারা পড়েছিল তিন হাজার ভারতীয় ফৌজ এবং নর-নারী। তাওয়াংয়ের অধিবাসীদের স্মৃতিতে চীনাদের ক্ষতি এখনও ভাস্বর। তারা এখনও মনে করে, চীনা সৈন্যরা ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও অত্যন্ত সদয় এবং সাহায্যের হাত সদাপ্রস্তুত। তারা গম ও আলু চাষে সাহায্য করেছে। এর অর্থ এই নয় যে, তারা দিলিল্গর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না। তারা এখনও দিলিল্গর প্রতি আস্থাশীল এবং ভারতীয় হওয়াই ভালোবাসে, অরুণাঞ্চলের জন্য আছে ভারতের আরও একটি সংরক্ষিত সৈন্যের দল এবং কিছু সুখোই যুদ্ধ বিমান যা সীমান্ত রক্ষার জন্য বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ বাস করে চীন এবং ভারতে। ১৯৭২ সালে চীন-ভারত সম্পর্ক পুনর্স্ট্থাপিত হওয়ার পর উত্তরোত্তর গভীর হয়েছে। ঘটেছে এর পরিব্যাপ্তি। চীন এবং ভারতের প্রবৃদ্ধির হার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি। বছর দুয়েকের মধ্যেই ভারত জাপানকে অতিক্রম করে চীনের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধি যত বাড়ছে ততই বাড়ছে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৯০ সালে চীন ও ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৭০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে এ বছর ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা। চীন ও ভারত উভয়েই আফ্রিকার তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে উভয়েই আফ্রিকার তেলপ্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। মজার কথা এই যে, চীন ও ভারতের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিপরীতধর্মী। চীনের আর্থিক খাত উৎপাদনমুখী। ভারতের সেবামুখী। সুতরাং তাদের মধ্যে গভীর সখ্যের ক্ষেত্র অত্যন্ত উর্বর। এর জন্য পশ্চিমা সংবাদপত্র নতুন একটা শব্দ সংযোজন করেছে। শব্দটি চীন্ডিয়া। বিশ্ববাণিজ্য এবং বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে চীন্ডিয়ার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চীন্ডিয়া আর্থিক উন্নতি লাখ লাখ মানুষকে, বিশেষ করে চীনের দারিদ্র্যসীমার বাইরে টেনে এনেছে। চীন এখন উন্নয়নের যে কোনো মাপকাঠিতে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সুতরাং ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভাবলেও চলে। বৈরিতার বা দ্বন্দ্বের সম্পর্কের পুনরুত্থান চীন্ডিয়ার শুধু ভাবমূর্তিরই ক্ষতি করবে না, ক্ষতি করবে উভয়ের এগিয়ে যাওয়াকে যা কারোরই কাম্য নয়। তাছাড়াও উভয়ের রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য। সুতরাং চীন্ডিয়া পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করলে বিশ্ব চীন্ডিয়ার সঙ্গে উপকৃত হবে। চীন্ডিয়ার রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক সৈন্য যার সংখ্যা ৪০ লাখ। আছে মানববিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র। চীন্ডিয়া পুরনো দ্বন্দ্বে ফিরে গেলে উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন্ডিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের দীর্ঘ পরিসরে রয়েছে খানাখন্দ এবং চোরাবালি। অনেকেই মনে করেন, তেলকে কেন্দ্র করে চীন্ডিয়ার প্রতিযোগিতা বৈরী ভাবের রূপান্তর মেটাতে পারে। আফ্রিকার তেলপ্রাপ্তির ব্যপারে তাদের সহযোগিতা সাময়িক এবং পরীক্ষামূলক।
পানিপ্রাপ্তির ব্যাপারে চীন্ডিয়ার সম্পর্ক ভৌগোলিক কারণে প্রকৃতিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। উত্তর ভারতের ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ ক'টি নদীর উৎসস্থল তিব্বত। ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃতি আবার বাংলাদেশ পর্যন্ত। চীন ঘোষণা করেছে, ব্রহ্মপুত্রের নদে ইয়ারলুঙ্গ সাংপাও বাঁধ নির্মাণ করবে। চীনের বাঁধ নির্মাণ ভারতের জন্য ভীতি হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারত মনে করে, বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে চীনা কৃষকদের দেবে। চীনে ভারতের রফতানির শতকরা ৭০ ভাগ কাঁচামাল এবং বিশেষত আয়রন ওর। চীন শুল্কমুক্ত রফতানির যে সুবিধা ভারতকে দেয় আয়রন ওর তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এখানেই ভারতের অসন্তুষ্টি। ভারতের উৎপাদন খাত এখনও প্রতিযোগিতামূলক নয়। চীন পিছিয়ে আছে আইটিসেবার ক্ষেত্রে। তবে অচিরেই চীন তা কাটিয়ে উঠবে।
চীন্ডিয়ার ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উর্বরক্ষেত্র তাদের দীর্ঘ ৪০ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত। ১৯৬২ সালে চীনা অভিযানের পরেও সীমান্তরেখার সিংহভাগ অনির্দিষ্ট। উত্তর ভারতের অনির্দিষ্ট সীমানায় ভারত সুইজারল্যান্ডের আয়তনের সমপরিমাণ ভূখণ্ড তাদের বলে দাবি করে। চীন এই ভূখণ্ড তাদের লাদাখের অন্তর্ভুক্ত বলে দখলে রেখেছে। পূর্বের অংশে চীন দাবি করে, সুইজারল্যান্ডের আয়তনের তিনগুণ ভূখণ্ড যার অন্তর্ভুক্ত অরণ্যাঞ্চলের সিংহভাগ। এর জন্য দায়ী ম্যাকমোহন লাইন। ৪৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ ম্যাকমোহন টানা হয়েছিল ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বৈদেশিক সচিব স্যার ম্যাকমোহন কর্তৃক। চীন মনে করে, ম্যাকমোহন লাইন তাদের জন্য অপমান। ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণে তাওয়াংয়ের অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও ভারত ১৯৫১ সালে দখল করে নেয় চীন তিব্বতে তাদের সৈন্য প্রেরণের পর। ভারতের তাওয়াং দখলকে চীন মনে করে অনৈতিক, যুক্তিহীন এবং মানবতাবিহীন। ম্যাকমোহন লাইন চীন্ডিয়ার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে স্যার ম্যাকমোহনের একটি ভুলের জন্য। তিনি ম্যাকমোহন লাইন টেনেছিলেন একটি মোটানিব দিয়ে, যার বিস্তৃতি হিসাব অনুযায়ী ১০ কিলোমিটার যা নিয়ে চীন্ডিয়ার যে কোনো সময় ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভবনা। চীন্ডিয়ার সম্পর্ক আন্তরিকতাবিহীন এবং অবিশ্বাস্যপূর্ণ। তাদের সীমান্ত রক্ষীরা প্রায়ই সীমান্তে অবৈধ প্রবেশের জন্য পরস্পরকে দায়ী করে এবং প্রমাণস্বরূপ সিগারেট এবং নুডলসের প্যাকেট দাখিল করে, যা জঞ্জাল বই কিছুই নয়। তবুও এ ধরনের মহড়া অত্যন্ত সতর্কভাবে চলছে। এই অবস্থায় চীন্ডিয়ার বিবদময় ক্ষেত্রগুলোর যে কোনো একটি থেকে রণদামামা বাজার আশঙ্কা থাকতেই পারে। তবে তা এড়িয়ে চলা উভয়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। চীন্ডিয়ার যে দ্বন্দ্ব তা বিরাজমান থাকবে মানুষের শঙ্কায় একবিংশ শতাব্দীর আশঙ্কা হিসেবে।
গওসল আযম : সাবেক মহাসচিব, আইবিবি ও কলাম লেখক
No comments