চলতি পথে- কুয়াকাটায় কাটানো দিন by দীপংকর চন্দ
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কাছেই একটা হোটেলের কয়েকটি চেয়ার দখল করে ভোজন-পরবর্তী গল্পগুজবে মেতে উঠেছিলাম আমরা। গল্পগুজবের মধ্যমণি মো. ইউনুসুর রহমান। কলাপাড়া উপজেলা রিসোর্ট সেন্টারে কর্মরত এই যুবকের ভাষ্যে, তাঁর কর্মস্থল কলাপাড়া অঞ্চলটি নথিপত্রে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও উপজেলা সদর কিন্তু খেপুপাড়া নামে সুপরিচিত।
খেপুপাড়া আন্ধারমানিক নদের তীরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ নদীবন্দর। খেপু নামের জনৈক প্রভাবশালী রাখাইন মাতবরের নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় খেপুপাড়া। অনেক অনেক দিন আগে খেপু মাতবর তাঁর বড় ভাই কলাউ মাতবরকে সঙ্গে নিয়ে রাঙ্গাবালী থেকে এ এলাকায় আসেন। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে রাখাইন বসতি গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি খাল দ্বারা বিভক্ত দ্বীপাঞ্চলটির পূর্ব ও পশ্চিম পারে। খালের পূর্ব পারের রাখাইন বসতির ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন খেপু নিজে এবং পশ্চিম পারের বসতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর বড় ভাই কলাউ। খেপুর বড় ভাই কলাউ মাতবরের নামেই খেপুপাড়ার পশ্চিমাংশের নাম হয় কলাপাড়া।
সত্যিকার অর্থে পটুয়াখালী-বরগুনার দক্ষিণের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার কৃতিত্ব রাখাইনদের। তাদের কঠোর পরিশ্রমেই সমুদ্র উপকূলীয় অনুৎপাদী অনাবাদি বনাঞ্চল উৎপাদনের উপকরণে পরিণত হয়েছে, কথাগুলো বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান ইউনুসুর রহমান। হোটেলের বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান বাইরে। আমরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথে নেমে আসি। সৈকতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পথের দুই পাশের ব্যস্ত দোকানপাট, মনোমুগ্ধকর স্থাপনাগুলোর দিকে তাকাই। সর্বত্রই বাঙালি মুখের বিজয়কেতন। ক্বচিৎ-কদাচিৎ দু-একজন রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও সহজেই অনুমান করা যায়, বর্তমানে এ অঞ্চলে ভীষণভাবেই সংখ্যালঘু তারা।
রাখাইনদের সংখ্যালঘু হওয়ার প্রক্রিয়া মূলত শুরু হয় উনিশ শতকের প্রথম পাদে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ অঞ্চলে ভূমি কর আদায় ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯০৭ সালে গঠন করে ‘দ্য বাখরগঞ্জ-সুন্দরবন কলোনিজেশন’। কলাপাড়া, আমতলী ও বরগুনার রাখাইন-অধ্যুষিত বেশ কিছু এলাকা অধিভুক্ত হয় এই কলোনিজেশনে। খেপুপাড়া বন্দরে স্থাপিত হয় কলোনিজেশন অফিস। ১৯০৮ সালে প্রথম কলোনিজেশন অফিসার নিযুক্ত হন আতাউর রহমান খান। রাখাইনদের ওপর আরোপিত হয় ভূমি কর। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৫৮ সালে কলোনিজেশন অফিসারের পদটি রেসিডেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় রাজকর্মচারীর পদক্ষমতা পূর্বপেক্ষা কিছুটা সংকুচিত হলেও রাখাইনদের ওপর নানাবিধ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক চাপ প্রবর্ধিত হতে থাকে প্রতি মুহূর্তেই। পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগে বিপুলসংখ্যক বাঙালির পদার্পণ ঘটে এই ভূ-ভাগে। শুরু হয় এক অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সহজ-সরল রাখাইনরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে সর্বক্ষেত্রেই। উপরন্তু বাঙালি সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশের কূটকৌশলে ভূমি হারিয়ে খর্বিত অধিকারের এক সংখ্যালঘু জাতিসত্তায় পরিণত হয় তারা।
রাখাইনদের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতে সৈকত সন্নিকটের বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে থাকি আমরা। পূর্ব দিকে ঝাউবন। সেখানে বাউল বাতাসের বিচরণ। কাছেই সমুদ্রের হাতছানি। বেড়িবাঁধের ঢাল বেয়ে আমরা নিচে নেমে আসি। শেষ বিকেলের নরম রোদ গায়ে মাখতে মাখতে সমুদ্রসৈকতে পৌঁছাই। সৈকতে কয়েকটা ছোট আকারের নৌকা পড়ে আছে কাত হয়ে। অধিকারবঞ্চিত রাখাইনদের মতোই কি সুদিন হারা নৌকাগুলো? চলনশক্তিহীন?
না, চলনশক্তিহীন নয় ওগুলো, জানালেন অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে তেল মাখতে থাকা মো. বশির। সমুদ্রে ভাটা শুরু হলেই নৌকাগুলো জলে ভাসাবেন বশির ও তাঁর সঙ্গীরা। উপকূলের নিকটবর্তী জলে পেতে রাখা খুটাজালে আটকে পড়া মাছ তুলে আনবেন।
কী ধরনের মাছ আটকা পড়ে খুটাজালে? নির্মল কৌতূহলে জানতে চাই আমরা।
অন্যমনস্ক হয়ে বশির জানান, ফ্যাসা মাছ, পোয়া মাছ, তুলার ডাঁটি মাছ—কপাল ভালো হলে ভরা মৌসুমে আটকা পড়ে দু-চারটি ইলিশও।
নৌকা-জাল, এসবের মালিকানা কি তাঁদের নিজস্ব?
না, সবকিছুর মালিকানাই অন্যের। আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়ে নৌকা-জাল কিনেছেন তাঁরা। তাঁদের পুঁজি কেবল শ্রম। এই শ্রম বিনিয়োগ করে সমুদ্র থেকে মাছ তুলে আনেন তাঁরা। দাদনের চুক্তি অনুযায়ী সেগুলো পৌঁছে দেন নির্দিষ্ট আড়তে।
মো. বশির ও তাঁর সঙ্গীরা নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ পান এর বিনিময়ে?
না, দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে মো. বশির জানান, যে অর্থ তাঁরা পান মাছের বিনিময়ে, তাতে তাঁদের জীবন চলে না। তাহলে কেন করেন এই কাজ?
দাদন! দাদনের ফাঁদে জীবন যে বাঁধা আমাদের! আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলতে বলতে শূন্য দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকান মো. বশির।
আমরা বশিরের মুখের দিকে তাকাই। একজন বাঙালি আড়তদারের কূটকৌশলের শিকার একজন বাঙালি মৎস্যজীবীর মুখ সেটি। সেই নিষপ্রভ, সেই বেদনাবিধুর বাঙালি মুখের সঙ্গে সংখ্যালঘু রাখাইন জনগোষ্ঠীর বঞ্চিত মুখচ্ছবি যে মিলেমিশে একাকার একেবারে! তাহলে? বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সত্যিকার পরিচয় কী? তারা কি সবাই সমগোত্রীয়? কোথায় বসবাস তাদের? শ্রেণীবিভক্ত সমাজের একই সমতলে?
দীপংকর চন্দ
সত্যিকার অর্থে পটুয়াখালী-বরগুনার দক্ষিণের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার কৃতিত্ব রাখাইনদের। তাদের কঠোর পরিশ্রমেই সমুদ্র উপকূলীয় অনুৎপাদী অনাবাদি বনাঞ্চল উৎপাদনের উপকরণে পরিণত হয়েছে, কথাগুলো বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান ইউনুসুর রহমান। হোটেলের বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান বাইরে। আমরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথে নেমে আসি। সৈকতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পথের দুই পাশের ব্যস্ত দোকানপাট, মনোমুগ্ধকর স্থাপনাগুলোর দিকে তাকাই। সর্বত্রই বাঙালি মুখের বিজয়কেতন। ক্বচিৎ-কদাচিৎ দু-একজন রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও সহজেই অনুমান করা যায়, বর্তমানে এ অঞ্চলে ভীষণভাবেই সংখ্যালঘু তারা।
রাখাইনদের সংখ্যালঘু হওয়ার প্রক্রিয়া মূলত শুরু হয় উনিশ শতকের প্রথম পাদে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ অঞ্চলে ভূমি কর আদায় ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯০৭ সালে গঠন করে ‘দ্য বাখরগঞ্জ-সুন্দরবন কলোনিজেশন’। কলাপাড়া, আমতলী ও বরগুনার রাখাইন-অধ্যুষিত বেশ কিছু এলাকা অধিভুক্ত হয় এই কলোনিজেশনে। খেপুপাড়া বন্দরে স্থাপিত হয় কলোনিজেশন অফিস। ১৯০৮ সালে প্রথম কলোনিজেশন অফিসার নিযুক্ত হন আতাউর রহমান খান। রাখাইনদের ওপর আরোপিত হয় ভূমি কর। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৫৮ সালে কলোনিজেশন অফিসারের পদটি রেসিডেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় রাজকর্মচারীর পদক্ষমতা পূর্বপেক্ষা কিছুটা সংকুচিত হলেও রাখাইনদের ওপর নানাবিধ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক চাপ প্রবর্ধিত হতে থাকে প্রতি মুহূর্তেই। পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগে বিপুলসংখ্যক বাঙালির পদার্পণ ঘটে এই ভূ-ভাগে। শুরু হয় এক অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সহজ-সরল রাখাইনরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে সর্বক্ষেত্রেই। উপরন্তু বাঙালি সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশের কূটকৌশলে ভূমি হারিয়ে খর্বিত অধিকারের এক সংখ্যালঘু জাতিসত্তায় পরিণত হয় তারা।
রাখাইনদের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতে সৈকত সন্নিকটের বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে থাকি আমরা। পূর্ব দিকে ঝাউবন। সেখানে বাউল বাতাসের বিচরণ। কাছেই সমুদ্রের হাতছানি। বেড়িবাঁধের ঢাল বেয়ে আমরা নিচে নেমে আসি। শেষ বিকেলের নরম রোদ গায়ে মাখতে মাখতে সমুদ্রসৈকতে পৌঁছাই। সৈকতে কয়েকটা ছোট আকারের নৌকা পড়ে আছে কাত হয়ে। অধিকারবঞ্চিত রাখাইনদের মতোই কি সুদিন হারা নৌকাগুলো? চলনশক্তিহীন?
না, চলনশক্তিহীন নয় ওগুলো, জানালেন অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে তেল মাখতে থাকা মো. বশির। সমুদ্রে ভাটা শুরু হলেই নৌকাগুলো জলে ভাসাবেন বশির ও তাঁর সঙ্গীরা। উপকূলের নিকটবর্তী জলে পেতে রাখা খুটাজালে আটকে পড়া মাছ তুলে আনবেন।
কী ধরনের মাছ আটকা পড়ে খুটাজালে? নির্মল কৌতূহলে জানতে চাই আমরা।
অন্যমনস্ক হয়ে বশির জানান, ফ্যাসা মাছ, পোয়া মাছ, তুলার ডাঁটি মাছ—কপাল ভালো হলে ভরা মৌসুমে আটকা পড়ে দু-চারটি ইলিশও।
নৌকা-জাল, এসবের মালিকানা কি তাঁদের নিজস্ব?
না, সবকিছুর মালিকানাই অন্যের। আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়ে নৌকা-জাল কিনেছেন তাঁরা। তাঁদের পুঁজি কেবল শ্রম। এই শ্রম বিনিয়োগ করে সমুদ্র থেকে মাছ তুলে আনেন তাঁরা। দাদনের চুক্তি অনুযায়ী সেগুলো পৌঁছে দেন নির্দিষ্ট আড়তে।
মো. বশির ও তাঁর সঙ্গীরা নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ পান এর বিনিময়ে?
না, দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে মো. বশির জানান, যে অর্থ তাঁরা পান মাছের বিনিময়ে, তাতে তাঁদের জীবন চলে না। তাহলে কেন করেন এই কাজ?
দাদন! দাদনের ফাঁদে জীবন যে বাঁধা আমাদের! আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলতে বলতে শূন্য দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকান মো. বশির।
আমরা বশিরের মুখের দিকে তাকাই। একজন বাঙালি আড়তদারের কূটকৌশলের শিকার একজন বাঙালি মৎস্যজীবীর মুখ সেটি। সেই নিষপ্রভ, সেই বেদনাবিধুর বাঙালি মুখের সঙ্গে সংখ্যালঘু রাখাইন জনগোষ্ঠীর বঞ্চিত মুখচ্ছবি যে মিলেমিশে একাকার একেবারে! তাহলে? বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সত্যিকার পরিচয় কী? তারা কি সবাই সমগোত্রীয়? কোথায় বসবাস তাদের? শ্রেণীবিভক্ত সমাজের একই সমতলে?
দীপংকর চন্দ
No comments