একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন by মোহাম্মদ আলী
এলিফ্যান্ট রোডে কম্প্যাথের উল্টোদিকে দুই বন্ধুর পাশাপাশি দুটি অফিস। একটির নাম আলতামিরা হোমস, অন্যটির নাম পাওয়ার পয়েন্ট। পাওয়ার পয়েন্টের স্বত্বাধিকারী ছিলেন আগা আহমেদ তসলিম। দু'জনই উদার প্রকৃতির মুক্তমনা মানুষ।
দু'জনের অফিসেই প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে ভরদুপুরে না হয়, বিকেলে বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা লেগেই থাকত। আর সে কারণেই সেখানে হতো নানা তর্ক-বিতর্ক। কখনও হতো রাজনীতির কঠিন ও জটিল সব তত্ত্ব আলোচনা-বিতর্ক। আবার কখনও সংস্কৃতির আদি থেকে বর্তমানকালের অবস্থা পর্যন্ত আলোচনাও সেখানে স্থান পেত। এসব নিয়ে কখনও চলত বাজি ধরাধরি, আবার কখনও লাগত বাগ্যুদ্ধ।
এদের একজনের নাম আগা আহমেদ তসলিম, অন্যজনের নাম স্থপতি রেজাউল করিম।
এক যুগেরও আগের কথা। রেজাউল ভাইয়ের অফিসে তসলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। রেজাউল ভাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'ওর নাম মোহাম্মদ আলী। ও আরজ আলী মাতুব্বরের ওপর একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছে। বইটির নাম 'আরজ আলী মাতুব্বর : চিন্তাজগৎ'। কয়েকদিন পরে আবার দেখা হলে তিনি এবার বললেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আমি তুমি বলব, যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে। এভাবেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আগা আহমেদ তসলিম ভাইয়ের জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বিজয়করা গ্রামে। বাবা আগা এন আর চৌধুরী সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও হয়েছিল সেই স্কুলজীবন থেকে। সে সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনি গিয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লাকসাম উপজেলার বিএলএফ, ইস্টার্ন সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মধ্যে কোনো ব্যাপারে কখনও অহঙ্কার দেখিনি, দেখিনি কোনো আত্মম্ভরিতা। বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ও যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তার যেন দেশের কাছে কিছুই চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। শুধু তিনি যেন কিছু একটা করতে চাইতেন দেশের জন্য, সেই যন্ত্রণা তাকে সবসময় দগ্ধ করত।
'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'-এর স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে যারা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালাম। তাদের সঙ্গে শিবনারায়ণ দাস ও আগা আহমেদ তসলিমসহ আরও বেশ কয়েকজন বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি নানাভাবে এ কাজের জন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। এক সময় আজিজ সুপার মার্কেটে 'আহমদ ছফা ইনস্টিটিউট' গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তাদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন শিবনারায়ণ দাস। সেখানেও তসলিম ভাই বিভিন্নভাবে ওই ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। কিন্তু এমন একজন মানুষ হঠাৎ মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় হলো। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন সবাই তার পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু মৃত্যুর নির্মম হাতছানি তাকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। কিন্তু স্বপ্ন দেখা মুক্তিযোদ্ধার কি কখনও মৃত্যু হয়? বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু হবে না।
আধুনিক চেতনাসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, উদারপন্থি এক সময়ের বামকর্মী তসলিম ভাইকে হয়তো আর আমাদের মাঝে পাব না। কিন্তু তার অজস্র গুণগ্রাহী বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, যাদের সামর্থ্য আছে, যারা তার আজীবন-লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করতে সক্ষম। তার লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে একটি 'সর্বাধুনিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান' উপহার দেওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি 'সাংস্কৃতিক সংগঠন' গড়ে তোলা। তার সেই স্বপ্ন কি এই রাষ্ট্র বা তার কোনো সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু কাঁধে তুলে নেবেন? একজন মুক্তিযোদ্ধার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে আমরা কি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি না?
nanditaali@gmail.com
এদের একজনের নাম আগা আহমেদ তসলিম, অন্যজনের নাম স্থপতি রেজাউল করিম।
এক যুগেরও আগের কথা। রেজাউল ভাইয়ের অফিসে তসলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। রেজাউল ভাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'ওর নাম মোহাম্মদ আলী। ও আরজ আলী মাতুব্বরের ওপর একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছে। বইটির নাম 'আরজ আলী মাতুব্বর : চিন্তাজগৎ'। কয়েকদিন পরে আবার দেখা হলে তিনি এবার বললেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আমি তুমি বলব, যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে। এভাবেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আগা আহমেদ তসলিম ভাইয়ের জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বিজয়করা গ্রামে। বাবা আগা এন আর চৌধুরী সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও হয়েছিল সেই স্কুলজীবন থেকে। সে সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনি গিয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লাকসাম উপজেলার বিএলএফ, ইস্টার্ন সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মধ্যে কোনো ব্যাপারে কখনও অহঙ্কার দেখিনি, দেখিনি কোনো আত্মম্ভরিতা। বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ও যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তার যেন দেশের কাছে কিছুই চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। শুধু তিনি যেন কিছু একটা করতে চাইতেন দেশের জন্য, সেই যন্ত্রণা তাকে সবসময় দগ্ধ করত।
'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'-এর স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে যারা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালাম। তাদের সঙ্গে শিবনারায়ণ দাস ও আগা আহমেদ তসলিমসহ আরও বেশ কয়েকজন বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি নানাভাবে এ কাজের জন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। এক সময় আজিজ সুপার মার্কেটে 'আহমদ ছফা ইনস্টিটিউট' গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তাদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন শিবনারায়ণ দাস। সেখানেও তসলিম ভাই বিভিন্নভাবে ওই ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। কিন্তু এমন একজন মানুষ হঠাৎ মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় হলো। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন সবাই তার পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু মৃত্যুর নির্মম হাতছানি তাকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। কিন্তু স্বপ্ন দেখা মুক্তিযোদ্ধার কি কখনও মৃত্যু হয়? বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু হবে না।
আধুনিক চেতনাসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, উদারপন্থি এক সময়ের বামকর্মী তসলিম ভাইকে হয়তো আর আমাদের মাঝে পাব না। কিন্তু তার অজস্র গুণগ্রাহী বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, যাদের সামর্থ্য আছে, যারা তার আজীবন-লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করতে সক্ষম। তার লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে একটি 'সর্বাধুনিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান' উপহার দেওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি 'সাংস্কৃতিক সংগঠন' গড়ে তোলা। তার সেই স্বপ্ন কি এই রাষ্ট্র বা তার কোনো সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু কাঁধে তুলে নেবেন? একজন মুক্তিযোদ্ধার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে আমরা কি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি না?
nanditaali@gmail.com
No comments