সাক্ষাৎকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেশবাসীরই প্রত্যাশা by অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত ও ওয়াকিল আহমেদ হিরন সমকাল :মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ চলছে দুটি ট্রাইব্যুনালে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, স্বাধীনতার চার দশক পর কেন এ বিচারের উদ্যোগ? একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই কেন এটা করা হলো না?
মাহবুবে আলম : কেবল জ্ঞানপাপী বা মতলববাজরাই এমন কথা বলতে পারে। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। 'বিচারের নামে দেশকে বিভক্ত করা হচ্ছে', 'বঙ্গবন্ধু সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন'_ এ ধরনের ভাঙা রেকর্ড তারা বারবার বাজাচ্ছেন। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিচারের পদক্ষেপ বিজয়ের পরপরই নেওয়া হয়েছিল। এটাও মনে রাখতে হবে, একাত্তরের ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ সরকার জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ কয়েকটি স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।সমকাল : বিচার প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হয়?
মাহবুবে আলম :মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের অধীনে বিচার কাজও শুরু হয়। পরবর্র্তী সময়ে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস অ্যাক্ট নামে আলাদা একটি আইনও পাস হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ঘৃণ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্তদের বিচারের জন্যই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
সমকাল : কাদের এ আইনের আওতায় বিচার হওয়ার কথা ছিল?
মাহবুবে আলম :পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় একদল সহযোগী বাংলাদেশের সর্বত্র গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটায়। প্রচলিত আইনে হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যদান, আলামত উপস্থাপন_ এ ধরনের আরও কিছু বিষয় প্রয়োজন হয়। কিন্তু যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এটা সবসময় সম্ভব হয় না। এ কারণে সংবাদপত্রের খবর ও নিবন্ধ, অন্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য আমলে নেওয়ার বিধান ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটানো না হলে অপরাধীরা বিচার এড়াতে পারত না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যারা দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তারা একাত্তরের ঘাতক ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের বিচারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক ও খুনিদের দলগুলোকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছে। নির্বাচনী আঁতাত করেছে। মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছে। এভাবে লাখ লাখ মানুষের আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, জনগণ এবং বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্ম রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা মেনে নিতে পারেনি।
সমকাল :একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। তখন কেন মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্তদের বিচারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি?
মাহবুবে আলম : দেশবাসীর জানা আছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডসহ আরও কয়েকটি অপরাধের মামলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়াও ২১ বছর বন্ধ রাখা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করেছে। এ জন্যও বাধাবিঘ্ন কম ছিল না। ঘাতকদের বাঁচানোর জন্য কম চেষ্টা হয়নি। ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায় এসে বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের দণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়। জেলহত্যার বিচারের জন্যও এ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সমকাল :অতীতের ঘটনায় পরিণত হয়েছে একাত্তর, এমন কথা আবারও এসেছে...
মাহবুবে আলম :ঘাতক কিংবা তাদের সমর্থকরাই এ কথা বলছে। কিন্তু তা বাংলাদেশের জনগণের বিন্দুমাত্র সমর্থন পায়নি। এরপর নতুন বাহানা তোলা হয়েছে_ যেহেতু মূল অপরাধ করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের ছেড়ে দিয়েছে, এ কারণে এ দেশে তাদের সহযোগীদের বিচার করার নৈতিক বা আইনগত অধিকার নেই। এ ধরনের বক্তব্যও জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর নতুন স্লোগান_ পুরনো, তামাদি হয়ে যাওয়া ঘটনা সামনে এনে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক মামলা দায়েরের পর তারা আদালতের ভেতরে-বাইরে এ কথা বলেছে। এ বক্তব্যও গৃহীত হয়নি। তারা এটাও বলল যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা ও ঘায়েল করা। কিন্তু সেটাও দেশবাসীর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। বিশেষ করে আমি তরুণ প্রজন্মকে অভিবাদন জানাই। তারা সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নস্যাৎ করে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোচ্চার রয়েছে।
সমকাল : মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যাতে না হয় সে জন্য আদালতের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে...।
মাহবুবে আলম : বিচার কাজে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করছে বলে যে অভিযোগ সেটা যে ভিত্তিহীন, এ ঘটনা থেকে তার প্রমাণ মেলে। বিচার বন্ধের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে। সেটা গৃহীত হয়নি। তাদের আবেদন যৌক্তিক ছিল না। যতদূর মনে পড়ছে, মামলা বন্ধের জন্য তারা অন্তত ৫টি মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। ১৯৭৩ সালের আইন সংশোধন করার বিরুদ্ধেও তারা মামলা করেছিল। ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজামুল হক নাসিম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন_ এমন অভিযোগ এনে তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও মামলা করেছিল তারা। মোট কথা, এ মামলা যাতে না চলে সে জন্য কোনো চেষ্টাই তারা বাদ রাখেনি। আমরা জেনেছি যে, তারা সংঘবদ্ধভাবে অনেক সাক্ষীকে ভয় দেখিয়েছে কিংবা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। আদালতে হাজির না হতে বলেছে। দেশের ভেতর ও বাইরে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে। অনেক অর্থ ব্যয় করেছে লবিস্টদের পেছনে। এত সব বাধা অতিক্রম করেই ১০ জনের বিরুদ্ধে দুটি ট্রাইব্যুনালে মামলা এগিয়ে চলেছে। কয়েকটি মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দেশের মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে এ বিচারের প্রতি নজর রাখছে।
সমকাল : জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। বিএনপির একাধিক নেতাও রয়েছেন। তারা কিন্তু এখনও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষয়টিকেই সামনে আনার চেষ্টা করছে।
মাহবুবে আলম : তাদের বক্তব্য ভিত্তিহীন। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সমকাল : দেশের বাইরে অবস্থানকারী এক ব্যক্তির সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের কথোপকথন নিয়ে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে বিবাদী পক্ষ। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবে আলম :আমার দেশ এ কথোপকথনের কিছু অংশ ছেপেছে। এতে তাদের নিজস্ব মন্তব্যও ছাপা হয়েছে। এটা সঠিক হয়নি। আইনের দৃষ্টিতে তারা অপরাধ করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষে যারা সক্রিয় তারা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হৈচৈ করছে। বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার জন্য নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। বিচার কাজে স্বচ্ছতা নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সেজন্য বিচারপতি নিজামুল হক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। আরেকজন বিচারপতিকে এখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো বিচারকের কর্মকাণ্ড বা আচরণে আসামিদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় যে তারা ন্যায়বিচার পাবে না সে ক্ষেত্রে আদালতে আবেদন করার বিধান রয়েছে। বিচারপতি নিজামুল হকের পদক্ষেপে এর সুযোগ আর নেই। কাজেই আসামিদের কিংবা তাদের হয়ে যারা দেশ-বিদেশে লবিং করছেন তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই।
সমকাল : একজন রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, মামলা তামাদি হয়ে গেছে। আপনি কী মনে করেন?
মাহবুবে আলম : এ উক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায়, অসৎ উদ্দেশ্যেই এ কথা বলা হচ্ছে। প্রথম থেকেই যারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার ঠেকাতে সক্রিয়, তাদের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা এটা। সব দেশেই ফৌজদারি মামলা চলে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। এ মামলায় আসামিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের আইনজীবীরা উপস্থিত থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে জেরা করেছেন। একজন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ ও জেরা চলে তিন মাস ধরে_ এমন ঘটনাও এ ট্রাইব্যুনালে ঘটেছে। এ থেকে স্পষ্ট যে কতটা সময় দেওয়া হয়েছে আসামিপক্ষকে। বিচারের স্বচ্ছতা বজায় রাখার মনোভাব থেকেই এটা করা হয়েছে। আমি শুরুতেই বলেছি, বিচার হবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে। একটি মামলায় আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীও শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী প্রদান সমাপ্ত হয়েছে। এসব বক্তব্য আদালতে নথিভুক্ত রয়েছে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপকথনের বিষয়টি এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। মামলায় তার সঙ্গে ছিলেন আরও দু'জন বিচারক। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, এমন বক্তব্য এনে বিচার কাজ ফের শুরু করার দাবি হাস্যকর এবং সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার কাজ বিলম্বিত এমনকি ভণ্ডুল করাই তাদের লক্ষ্য। এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। জনগণ এটা হতে দেবে না। তারা সচেতন রয়েছে।
সমকাল : এ সংক্রান্ত আইনের বিধান কী বলে?
মাহবুবে আলম : একজন বিচারক যদি অপারগ হন কিংবা হতে পারে যে তার মৃত্যু ঘটল_ এ ক্ষেত্রে নতুন কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। উভয়পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য এবং তথ্য-উপাত্ত প্রদান করেই রায় দেওয়া হয়। আলোচ্য ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বাইরে কী বলেছেন তার কোনো প্রভাব বিচার কাজে পড়ার অবকাশ নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে, ট্রাইব্যুনাল একজন বিচারক নিয়ে গঠিত নয়। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের সময় এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবীই বলেননি যে সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত কিংবা বাধা পেয়েছেন। এ মামলা নতুন করে শুরুর বক্তব্য তাই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ বক্তব্য বিশেষ মতলব নিয়েই করা। এটাও মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দেন। তারা মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেশের সম্পদ ধ্বংস করেছে। তাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচতে এক কোটি লোক অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এসব ঐতিহাসিক সত্য। অনেক মানুষ তার সাক্ষী। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে। একজন বিচারপতি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কী কথা বলেছেন তার দ্বারা এ সত্য মুছে ফেলা যায় না। রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব শুধু এটুকুই যে এই দুষ্কর্মের সঙ্গে আসামিরা কতটা যুক্ত ছিল তা তুলে ধরা।
সমকাল :রাষ্ট্রপক্ষের হাতে এ দায়িত্ব তো দেশবাসীই অর্পণ করেছে...।
মাহবুবে আলম :জামায়াতে ইসলামীর প্রধান নেতা গোলাম আযমের একটি ছবি আছে পাকিস্তানের সেনাপতির সঙ্গে। এই সেনাপতির নির্দেশেই গণহত্যা পরিচালিত হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধে গোলাম আযমের সম্পৃক্ততা প্রমাণে এই ছবিটিই কি যথেষ্ট নয়? এ ধরনের অনেক ছবি প্রমাণ হিসেবে আদালতের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের সত্য ঘটনার ভিত্তিতেই আদালত তাদের রায় প্রদান করবেন বলে দেশবাসী আশা করে। অন্যান্য মামলার সঙ্গে এখানেই এসব মামলার পার্থক্য। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যে কাউকে এ ধরনের ঐতিহাসিক সত্য এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাজা দেওয়া যাবে।
সমকাল : বিএনপির দু'জন নেতা এ মামলায় অভিযুক্ত। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চান। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?
মাহবুবে আলম : এ বিচার কাজ চলছে সরকার প্রণীত আইনের ভিত্তিতে। আমরা জানি, কোথাও কোথাও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের অন্য দেশ থেকে ধরে এনে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান বলতে সম্ভবত এটাই বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। আমাদের সার্বভৌম সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনেই বিচার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। সাধারণত অপরাধীরা নিজের সমর্থনে আইনজীবী নিয়োগসহ যে ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন এ বিচারে সবই দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধে যেসব বিচার বিভিন্ন দেশে হয়েছে তার কোনো কোনোটিতে আপিলের বিধান ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে রায় সম্পর্কে আবেদন করার বিধান রাখা আছে। আজ যে ব্যক্তিবর্গ আন্তর্জাতিক মানের কথা বলছেন, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতার কথা বলছেন তারা কিন্তু কখনও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের দাবি তোলেননি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন গণআদালত গঠন করেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রতীকী বিচারের ব্যবস্থা করেন, তখন এসব ব্যক্তি সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন কিংবা তার বিরোধিতা করেছিলেন। তারা এটা মনে রাখেন না যে, এ বিচার দেশবাসীর প্রত্যাশার পরিণতি। কেউ তা বানচাল করতে পারবে না।
সমকাল : স্কাইপের মাধ্যমে আলাপের বিষয়টি বহুল আলোচিত। আপনি কী বলবেন?
মাহবুবে আলম : একটি মহল অন্যায়ভাবে একজনের কথা টেপ করেছে এবং সেটা নিয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিল। যখনই একটি মামলায় বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন তা প্রকাশ করে বিচার কাজ ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। প্রথম থেকেই তাদের যে চক্রান্ত, রেকর্ড করা ও তা প্রকাশ তারই ধারাবাহিকতা। একজনের বক্তব্য এভাবে রেকর্ড করা গর্হিত অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। এর পেছনে ঘুষ প্রদান কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রলোভন দেখানো হয়ে থাকতে পারে। তাদের একটিই উদ্দেশ্য ছিল_ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং অপরাধীদের মুক্ত করা। আড়িপাতা অপরাধ। এ ধরনের অপরাধে সত্তরের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে একজন রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিঘি্নত করার জন্য একজন বিচারপতির কথা আড়ি পেতে শুনেছে এবং তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছে। অনতিবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সাধারণ নাগরিকদের কথা আদান-প্রদানের গোপনীয়তা রক্ষার যে বিধান সংবিধানে রয়েছে তা অকার্যকর হয়ে পড়বে। ঐতিহাসিক সত্য কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। বিচার কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে, এটাই দেশবাসী দেখতে চায়। সরকার ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু এ জন্য প্রধান বিচারপতির সম্মতির প্রয়োজন পড়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হবেন না_ এমন শপথ আগেই নিয়েছেন। তারা হাইকোর্টে দায়িত্ব পালনের সময় মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের দণ্ড দিয়ে রায় প্রদান করেছেন। দেশবাসীর কাছে তা গ্রহণযোগ্যও হয়েছে। ট্রাইব্যুনালেও তারা ন্যায়পরায়ণ থেকে দায়িত্ব পালন করবেন, এ আস্থা রাখাই যায়।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবে আলম : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সম্পর্কে বক্তব্য সমকাল পাঠকদের কাছে তুলে ধরার সুযোগ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ।
No comments