মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-'রমজান আলীর জীবনের গেট আর খোলে না' by হাকিম বাবুল
'মুক্তিযুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করছি। কিন্তুক নিজের জীবনের আর্থিক স্বাধীনতা পাইলাম না। যা-ই হোক, দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করার, দেশ স্বাধীন করার ভাইগ্য কয়জনের কফালে জোডে, কইন দেহি। অহন খাইয়া না খাইয়া কোনোমতে সংসার চলছে। সংসারে কষ্ট আছে।
কিন্তুক আবার মুক্তিযুদ্ধের কতা স্বাধীনতার কতা মুনে অইলে গরবে বুকটা ভইরা যায়।' বলছিলেন ৭০ বছর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী।
বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের সমুচ্চুড়া গ্রামে। বাবার নাম হোসেন আলী। স্বল্প শিক্ষিত রমজান আলীর বয়স তখন ২৮ বছর। সবে বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে খবর পান পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের ধরে ধরে নিয়ে মেরে ফেলছে।
গ্রামের যুবকদের সঙ্গে রমজান আলীও চলে যান ভারতে। ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নেমে পড়েন যুদ্ধে। তাঁর কম্পানি কমান্ডার ছিলেন নন্নী এলাকার আবদুল গফুর। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন ময়মনসিংহের কাশিগঞ্জ, ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচাসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে।
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলীর শুরু হয় খেয়েপরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এরইমধ্যে আট বছর আগে একমাত্র ছেলে রফিকুল ইসলাম হঠাৎ মারা গেলে রমজান আলী আরো অসহায় হয়ে পড়েন। ছেলের বউ, চার নাতি-নাতনি নিয়ে রমজান আলী পড়ে যান অথৈ সাগরে।
রমজান আলী জানান, ১৯৯৮ সালে মধুটিলা ইকোপার্ক নির্মিত হলে তিনি মাস্টাররোলে গেইটম্যানের চাকরি পান। নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে পাওয়া সামান্য বেতন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিন মাস পরপর পাওয়া সম্মানী ভাতা_এ দিয়ে কোনো রকমে চলছিল সংসার। ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে গত নভেম্বরে এই চাকরিটাও চলে গেছে। বৃদ্ধ রমজান আলী আফসোস করে বলেন, 'পাঁচ বছর ধইরা গেইট টানলাম। অহন গেইট টানার কামডাও নাই। নতুন ডাক অইছে। যে ইজারাদার পাইছে হেই দখল পাইলো না। নেতাদের দ্বন্দ্বের জের ধইরা অহন আমার চাকুরীডা নাই।'
রণাঙ্গণের স্মৃতি : কাশিগঞ্জের একটি লড়াইয়ের স্মৃতিচারণা করে রমজান আলী বলেন, 'আমরা কাশিগঞ্জ অ্যাটাক করার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ধরে ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মধ্যরাত। দেখি দক্ষিণ দিক দিয়া নৌকায় একটি দল আসছে। আমরা মনে করেছিলাম, কাদের সিদ্দিকীর দল। আমরা কমান্ডারের কথা মতো 'হল্ট' করার সাথে সাথেই ওরা ফায়ার করে। তখন বুঝেছি ওরা ছিল পাক বাহিনীর দল। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আমরা তিন সহযোদ্ধাকে হারাই। তাদের লাশও আমরা সেদিন আনতে পারিনি।' ওই যুদ্ধে রমজান আলীর পায়েও গুলি লাগে। তিনি তাঁর বাঁ পায়ের দুই স্থানে গুলির দাগ দেখিয়ে বলেন, 'তিনজন সহযোদ্ধাকে হারাইছি। আমিও মইরা যাইতে পারতাম।' তিনি বলেন, 'যুদ্ধে আমি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ব্যবহার করেছি, গ্রেনেড চার্জ করেছি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন অইলে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র জমা দিয়া বাড়ি ফিইরা আসি।'
বন্ধ নিজের দুয়ার : স্বাধীন দেশে কত রংবেরঙের গাড়ি নিয়ে কত রকমের লোক আসে এই পার্ক ভ্রমণ করতে। আর তাদের প্রবেশদ্বার (গেইট) খুলে দিতেন মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী। কিন্তু নিজের জীবনের গেইট যেন তিনি খুলতে পারছেন না। তাঁর স্ত্রী অহেদা বেগম (৬২) বলেন, 'মধুটিলা ইকোপার্কের চাহরীডা থাকলে তাও কিছু ট্যাহা পইসা পাওয়া যাইতো। সংসারডা চলতো। কিন্তুক এই সিজন পুরাডাই বসা। খুব কষ্টে আছি আমরা। নাতি-নাতকোর নেহাপড়ার খরচ, ভরণ-পোষণ কিবাই চলবো অহন চিন্তা কইরাই পাই না।'
রমজান আলী জানান, মধুটিলা ইকোপার্কে ডিউটি করে ভ্রমণ মৌসুমে তিনি পেতেন দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন সংসার চলে খুব কষ্টে, খেয়ে না খেয়ে। বড় নাতিনি রূপালী খাতুনের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফি দুই হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে পূরণ করেছে। টাকা জোগাড় করেছেন খুব কষ্টে। অপর নাতি রুবেল সপ্তম ও শিউলী ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। এদের লেখাপড়ার খরচ ও ভরণপোষণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। নিজের বসতভিটা মিলিয়ে ১৪/১৫ কাঠা জমি থাকলেও তাঁর ফসলে সংসারের খরচই চলে না। তাই পার্কে গেইটম্যানের চাকরি নিয়েছিলেন। টিকল না তাও।
এ পর্যায়ে কী স্বপ্ন দেখেন রমজান আলী? 'জীবনের শেষ আকাংখাডা পুরা অইলে মইরাও শান্তি পামু। মুনে অনেক কষ্ট আছে কিন্তুক দেশটার স্বাধীনতায় যারা বাধা দিছে, দেশের মাইনষেরে যারা খুন-খারাবি করছে, আমগর মাও-বইনের ইজ্জত নিছে, তাগর বিচারডা দেইক্কা মরবার পাইলে কোন আফসোস থাকবো না। আল্লার কাছে কই, ওই আলবদর-রাজাকারগোরে ফাঁসি না দেইক্কা তুমি কব্বরে নিও না।' কালের কণ্ঠকে বলেন বৃদ্ধ এই বীর সেনানী।
নালিতাবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুদ্দিন আহমদ বলেন, 'রমজান আলী একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জীবন বাজি রেখে তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ছেলেটার মৃত্যুই তাঁকে কাহিল করে তুলেছে। তাকে মধুটিলা ইকোপার্কের গেইটম্যানের চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। একজন অসহায় মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে বাদ দিয়ে থাকলে এটা ঠিক হয়নি। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।' তিনি বলেন, 'মধুটিলা ইকোপার্কটি পোড়াগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত। এ পার্ক থেকে সরকার প্রতিবছর অনেক টাকা আয় করে থাকে। ওই আয়ের শতকরা ১০ ভাগ স্থানীয় অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।'
বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের সমুচ্চুড়া গ্রামে। বাবার নাম হোসেন আলী। স্বল্প শিক্ষিত রমজান আলীর বয়স তখন ২৮ বছর। সবে বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে খবর পান পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের ধরে ধরে নিয়ে মেরে ফেলছে।
গ্রামের যুবকদের সঙ্গে রমজান আলীও চলে যান ভারতে। ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নেমে পড়েন যুদ্ধে। তাঁর কম্পানি কমান্ডার ছিলেন নন্নী এলাকার আবদুল গফুর। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন ময়মনসিংহের কাশিগঞ্জ, ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচাসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে।
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলীর শুরু হয় খেয়েপরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এরইমধ্যে আট বছর আগে একমাত্র ছেলে রফিকুল ইসলাম হঠাৎ মারা গেলে রমজান আলী আরো অসহায় হয়ে পড়েন। ছেলের বউ, চার নাতি-নাতনি নিয়ে রমজান আলী পড়ে যান অথৈ সাগরে।
রমজান আলী জানান, ১৯৯৮ সালে মধুটিলা ইকোপার্ক নির্মিত হলে তিনি মাস্টাররোলে গেইটম্যানের চাকরি পান। নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে পাওয়া সামান্য বেতন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিন মাস পরপর পাওয়া সম্মানী ভাতা_এ দিয়ে কোনো রকমে চলছিল সংসার। ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে গত নভেম্বরে এই চাকরিটাও চলে গেছে। বৃদ্ধ রমজান আলী আফসোস করে বলেন, 'পাঁচ বছর ধইরা গেইট টানলাম। অহন গেইট টানার কামডাও নাই। নতুন ডাক অইছে। যে ইজারাদার পাইছে হেই দখল পাইলো না। নেতাদের দ্বন্দ্বের জের ধইরা অহন আমার চাকুরীডা নাই।'
রণাঙ্গণের স্মৃতি : কাশিগঞ্জের একটি লড়াইয়ের স্মৃতিচারণা করে রমজান আলী বলেন, 'আমরা কাশিগঞ্জ অ্যাটাক করার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ধরে ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মধ্যরাত। দেখি দক্ষিণ দিক দিয়া নৌকায় একটি দল আসছে। আমরা মনে করেছিলাম, কাদের সিদ্দিকীর দল। আমরা কমান্ডারের কথা মতো 'হল্ট' করার সাথে সাথেই ওরা ফায়ার করে। তখন বুঝেছি ওরা ছিল পাক বাহিনীর দল। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আমরা তিন সহযোদ্ধাকে হারাই। তাদের লাশও আমরা সেদিন আনতে পারিনি।' ওই যুদ্ধে রমজান আলীর পায়েও গুলি লাগে। তিনি তাঁর বাঁ পায়ের দুই স্থানে গুলির দাগ দেখিয়ে বলেন, 'তিনজন সহযোদ্ধাকে হারাইছি। আমিও মইরা যাইতে পারতাম।' তিনি বলেন, 'যুদ্ধে আমি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ব্যবহার করেছি, গ্রেনেড চার্জ করেছি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন অইলে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র জমা দিয়া বাড়ি ফিইরা আসি।'
বন্ধ নিজের দুয়ার : স্বাধীন দেশে কত রংবেরঙের গাড়ি নিয়ে কত রকমের লোক আসে এই পার্ক ভ্রমণ করতে। আর তাদের প্রবেশদ্বার (গেইট) খুলে দিতেন মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী। কিন্তু নিজের জীবনের গেইট যেন তিনি খুলতে পারছেন না। তাঁর স্ত্রী অহেদা বেগম (৬২) বলেন, 'মধুটিলা ইকোপার্কের চাহরীডা থাকলে তাও কিছু ট্যাহা পইসা পাওয়া যাইতো। সংসারডা চলতো। কিন্তুক এই সিজন পুরাডাই বসা। খুব কষ্টে আছি আমরা। নাতি-নাতকোর নেহাপড়ার খরচ, ভরণ-পোষণ কিবাই চলবো অহন চিন্তা কইরাই পাই না।'
রমজান আলী জানান, মধুটিলা ইকোপার্কে ডিউটি করে ভ্রমণ মৌসুমে তিনি পেতেন দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন সংসার চলে খুব কষ্টে, খেয়ে না খেয়ে। বড় নাতিনি রূপালী খাতুনের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফি দুই হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে পূরণ করেছে। টাকা জোগাড় করেছেন খুব কষ্টে। অপর নাতি রুবেল সপ্তম ও শিউলী ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। এদের লেখাপড়ার খরচ ও ভরণপোষণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। নিজের বসতভিটা মিলিয়ে ১৪/১৫ কাঠা জমি থাকলেও তাঁর ফসলে সংসারের খরচই চলে না। তাই পার্কে গেইটম্যানের চাকরি নিয়েছিলেন। টিকল না তাও।
এ পর্যায়ে কী স্বপ্ন দেখেন রমজান আলী? 'জীবনের শেষ আকাংখাডা পুরা অইলে মইরাও শান্তি পামু। মুনে অনেক কষ্ট আছে কিন্তুক দেশটার স্বাধীনতায় যারা বাধা দিছে, দেশের মাইনষেরে যারা খুন-খারাবি করছে, আমগর মাও-বইনের ইজ্জত নিছে, তাগর বিচারডা দেইক্কা মরবার পাইলে কোন আফসোস থাকবো না। আল্লার কাছে কই, ওই আলবদর-রাজাকারগোরে ফাঁসি না দেইক্কা তুমি কব্বরে নিও না।' কালের কণ্ঠকে বলেন বৃদ্ধ এই বীর সেনানী।
নালিতাবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুদ্দিন আহমদ বলেন, 'রমজান আলী একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জীবন বাজি রেখে তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ছেলেটার মৃত্যুই তাঁকে কাহিল করে তুলেছে। তাকে মধুটিলা ইকোপার্কের গেইটম্যানের চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। একজন অসহায় মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে বাদ দিয়ে থাকলে এটা ঠিক হয়নি। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।' তিনি বলেন, 'মধুটিলা ইকোপার্কটি পোড়াগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত। এ পার্ক থেকে সরকার প্রতিবছর অনেক টাকা আয় করে থাকে। ওই আয়ের শতকরা ১০ ভাগ স্থানীয় অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।'
No comments