বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৬০১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মুন্সী আবদুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে মুন্সী আবদুর রউফসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিলেন বুড়িঘাটে। তাঁদের দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। রাঙামাটি জেলার নান্নেরচরের অন্তর্গত বুড়িঘাট। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক বুড়িঘাট হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। অদূরেই কাপ্তাই লেক। জলপথে যোগাযোগের জন্য লেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।চট্টগ্রামের কালুরঘাটেও অবস্থান নিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল। কালুরঘাট থেকে রামগড়ে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল বুড়িঘাট দিয়ে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তখন ছিল না। ১১ এপ্রিল কালুরঘাটের পতন হলে মুক্তিযোদ্ধারা এই পথ দিয়েই রামগড়ে পশ্চাদপসরণ করেন।
কালুরঘাটের পতন হলে পাকিস্তানিরা বুড়িঘাট ও রামগড় দখলের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২০ সদস্যের ছোট একটি দল লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। এ সময় তারা বুড়িঘাটে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষার কাছাকাছি চলে এসেছে।
তখন পাকিস্তানি সেনারা গোলাগুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। তখন দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি রেকি দলের বেশির ভাগ সদস্য নিহত এবং লঞ্চটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। জীবিতরা ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুজন শহীদ হন।
পরদিন ১৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি দল বুড়িঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। সাতটি স্পিডবোট ও দুটি লঞ্চযোগে তারা সেখানে আসে। সংখ্যায় ছিল দুই কোম্পানির মতো। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ভারী অস্ত্রের মধ্যে ছিল ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অসংখ্য মেশিনগান।
পাকিস্তানিদের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম ছিলেন। তার পরও তাঁরা অসীম মনোবল ও দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত শত তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা আর মেশিনগানের হাজার হাজার গুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
এই পরিস্থিতির সুযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল তীরে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। পাকিস্তানিদের অব্যাহত গোলাগুলির মুখে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা নড়াচড়া করারও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। সবাই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়েন।
এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু এর জন্য প্রযোজন কাভারিং ফায়ার। অসীম সাহসী মুন্সি আবদুর রউফ স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। দলনেতা খালেকুজ্জামানকে তিনি বলেন, ‘স্যার, আপনি সবাইকে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করুন। আমি পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করছি।’
এরপর মুন্সি আবদুর রউফ একাই পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। এই সুযোগে তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করেন। রউফের অস্ত্রের নিখুঁত গুলিবর্ষণে পাকিস্তানিদের কয়েকটি স্পিডবোট ডুবে যায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
আকস্মিক ক্ষতিতে পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা নিরাপদ দূরত্বে পিছু হটে যায়। পেছনে পাকিস্তানি বাহিনী পুনর্গঠিত হয়ে মুন্সি আবদুর রউফের অবস্থান লক্ষ্য করে আবারও মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। একটা গোলা সরাসরি রউফের দেহে আঘাত করে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মাংসপিণ্ড। এভাবে শেষ হয় বুড়িঘাটের যুদ্ধ।
বুড়িঘাট যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হতে পারেননি, কিন্তু মুন্সি আবদুর রউফের বীরত্ব ও সাহসিকতায় বেঁচে যান তাঁর দলনেতা খালেকুজ্জামান এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা। পরে রউফের সহযোদ্ধারা তাঁর দেহের খণ্ডিত অংশ সংগ্রহ ও একত্র করেন। সেখানে একটি টিলার ওপর তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধি চিহ্নিত।
মুন্সি আবদুর রউফ ইপিআর বাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সেক্টরের অধীন ১১ নম্বর উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। মাঝারি মেশিনগান ডিটাচমেন্টের ১ নম্বর মেশিনগানচালক ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (বীর উত্তম, পরে মেজর) নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দলের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত বুড়িঘাট যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য শহীদ মুন্সি আবদুর রউফকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ০৬।
শহীদ মুন্সি আবদুর রউফের পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী (সাবেক বোয়ালমারী) উপজেলার ছালামতপুর গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মুন্সি মেহেদি হোসেন, মা মুকিদুননেছা।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-১ এবং বীরশ্রেষ্ঠ, জাহনারা ইমাম, গণপ্রকশনী।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments