বাংলাদেশ-ভারত-সমতাভিত্তিক বাণিজ্য সম্পর্কই লক্ষ্য
বিশ্বব্যাপী আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সূচক এখন বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ওঠানামা করে। ইউরোপের দেশগুলো বহুকালের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ভুলে যখন বৃহত্তর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামোর মধ্যে নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্মাণের পথে বহুদূর এগিয়ে গেছে;
আমাদের পার্শ্ববর্তী আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো যখন শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট গড়ে নিজেদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিচ্ছে; এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোও যখন এ বিষয়ে কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে, তখনও দক্ষিণ এশিয়া অনেকটা পিছিয়ে। রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন এখানকার আঞ্চলিক সহযোগিতার জোট সার্ককে সক্রিয় হতে দিচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জোটবদ্ধতার উদ্যোগগুলো প্রত্যাশিত গতিতে বাস্তবায়িত হতে পারছে না। অবশ্য সাম্প্রতিককালে আশান্বিত হওয়ার মতো বেশকিছু উদ্যোগ এসেছে। এ অঞ্চলের বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক নির্মাণের জন্য সক্রিয় হয়েছে। ভারতের যে 'দাদাসুলভ' খবরদারির অভিযোগ অতীতে প্রায়ই উঠত তা এখন সে পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তিত। ভারতের মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের নীতি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হয়। তিনি প্রকৃত অর্থেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও বিকাশের জন্য ভারতকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে ছাড় দিয়ে সম্পর্ক নির্মাণে প্রতিবেশীদের উৎসাহিত করতে হবে। সেটি হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে, সমতাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক। ভারতের দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশেও অতীতে যেমন ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যেত তা এখন অনেকটাই অপসৃত। দেশ দুটি এখন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্মাণের জন্য প্রস্তুত। শুধু ভারতই নয়, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর বাংলাদেশের ইতিবাচক মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু মনোভাবের ইতিবাচকতাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। এর জন্য চাই সঠিক ও পরিকল্পিত কর্মোদ্যোগ। এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গতিশীলতার জন্য যেমন ভারতসহ প্রতিবেশীদের জন্য বাংলাদেশের বন্দর ও সড়ক রেলপথের সুবিধা উন্মোচিত হওয়া দরকার, তেমনি বাংলাদেশের সুবিধা নিশ্চিত করতে ভারতের করণীয় অনেক। বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শুল্ক সুবিধাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্পষ্ট চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার আছে। একইভাবে আছে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার ক্ষেত্রে নানা প্রত্যাশাও। ঢাকায় ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর বৈঠকে দু'দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের বাধা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো। শুধু মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকই নয়, ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে আলোচনাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। ব্যবসায়ীরা ভারতের দিক থেকে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। সমতার স্বার্থেই ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করা দরকার। বাণিজ্য সম্পর্কের সমতা না থাকলে সেটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে ভারত যদি প্রকৃত অর্থেই একটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চায় তাহলে বাণিজ্যের বাধাগুলো তার তরফেই অপসারণ করতে হবে। পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ, প্রতিশ্রুত খাদ্য আমদানি ও পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে গতিশীল ব্যবস্থাপনার কথাও দু'দেশকে ভাবতে হবে। খাদ্য আমদানি ও পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে নতুন প্রতিশ্রুতি এসেছে, এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বস্তুত বাণিজ্য সম্পর্কের বাধাই শুধু নয়, দু'দেশের সীমান্তে যে সংকট আছে, সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ আছে সেসব সমাধানেও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। কেননা একদিকে সমস্যা জিইয়ে রেখে অন্যদিকে সমাধানের উদ্যোগ সম্পর্ককে দৃঢ় করতে দেবে না। আমাদের সম্পর্কের সম্ভাবনা অপার, মিলনের ক্ষেত্র বিশাল, পারস্পরিক লাভের অঙ্ক বড়। তবে এক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করতে আন্তরিক, গতিশীল ও কার্যকর উদ্যোগ আসবে না কেন?
No comments