কূটনীতি-বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক এবং তিন দুয়োরানী by শেখ রোকন
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীতে উভয় দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণ মার্কার বা পিলার স্থাপনে সম্পূরক চুক্তি (সাপ্লিমেন্ট এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষরের প্রস্তাব গত ১০ ডিসেম্বরের বৈঠকে অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা (সমকাল, ১১ ডিসেম্বর ২০১২)।
কয়েক দশক আগে, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে প্রতিবেশী 'বার্মা' সরকারের সম্পাদিক এক চুক্তির আওতায় নাফ নদীতে ৪২টি সীমান্ত পিলার বসানো হয়েছিল। কালের কামড়ে কিছু পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে যৌথ বিশেষজ্ঞ দল এ ব্যাপারে সমীক্ষা চালায় এবং মেরামত ও সংস্কারের পরামর্শ দেয়। এ জন্যই সম্পূরক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সম্পূরক চুক্তিটি স্বাক্ষর ও কার্যকর হলে নাফ নদী এলাকায় দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ সমাধান সহজ হবে। পাশাপাশি এর মধ্য দিয়ে বহুদিন পর নিজের কারণে আলোচনায় স্থান করে নিল নদীটি।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এক চিলতে জলজ বিভাজন রেখা হয়ে থাকা নাফ নদী বেশিরভাগ সময়ই কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণ করে স্থলজ নানা কারণে। বিশেষ করে আরাকান রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন সীমান্ত অতিক্রম করতে চায়, তখন নাফ নদী নৌকা কিংবা সাঁতরে পার হওয়ার মানবিক কাহিনী স্থান পায় সংবাদমাধ্যমে। মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী নাসাকা নদীটিতে নেমে বাংলাদেশি জেলে আটকও অনেকটা নিয়মিত অঘটন। এর বাইরে নাফ এক শান্ত নদীর নাম। এই অঞ্চলের আর দশটা আন্তর্জাতিক নদীর মতো এর পানিসম্পদ, জল বণ্টন, বৈদেশিক দূষণ কিংবা সীমান্ত ভাঙন নিয়ে বিতর্ক নেই বললেই চলে। নাফ নদী, না সাগরের বর্ধিতাংশ_ এ নিয়ে অবশ্য খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। লোনা জল ও জোয়ার-ভাটার প্রবল প্রভাবের কারণে কেউ কেউ আধা শ্যামলা এ জলাভূমিকে বঙ্গোপসাগরের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
নাফ আদতে কিন্তু নদী_ একটু অন্যরকম। বাম তীরে বেশ কিছু ছোট-বড় ছড়া বা পাহাড়ি প্রবাহের সম্মিলিত ধারা। কক্সবাজার জেলার সর্বদক্ষিণে মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্তরেখা বরাবর প্রবাহিত এই ধারার দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬২ কিলোমিটার। এর প্রধান ধারাটির উৎস আরাকানের উত্তরাঞ্চলীয় পর্বতশ্রেণী। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালীর কাছে নাফের ডান তীর বাংলাদেশের ভেতরে চলে এসেছে। তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রবাহিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণের নিয়ম অনুযায়ী এর মধ্যপ্রবাহ হচ্ছে নোম্যান্স ল্যান্ড। নদীটির মোহনার কাছের স্থলভাগ বদর মোকাম বলে পরিচিত। বামতীরে আরাকানের আকিয়াব বন্দর আর বামতীরে রয়েছে টেকনাফ। নাফ নদীর টেকে অবস্থিত বলে এমন নাম।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আরও দুটি নদীর নাম এ প্রসঙ্গে বলতে হবে। প্রথমটি মাতামুহুরী। মগ ভাষায় নদীটি মামুরি এবং মারমা ভাষায় মুরিখিয়াং বা খিয়াং নামে পরিচিত। মাতামুহুরী নদীও অনেকটা নাফের মতো_ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কিছু পাহাড়ি ছড়ার মিলিত প্রবাহ। এর বেশিরভাগ ছড়ার উৎস সীমান্তের ওপারে, আরাকান পার্বত্যাঞ্চলে। স্থানীয়ভাবে মুহুরী অর্থ ছোট ছোট ছিদ্র বা ঝাঁজর। ঝাঁজরের মা হচ্ছে মাতামুহুরী। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা দিয়ে এর প্রধান ধারাটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে আলীকদম ও লামা উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাফলাপুরের কাছে মহেশখালী চ্যানেলে পতিত হয়েছে। মাতামুহুরীর দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার।
মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত তৃতীয় নদীটি হচ্ছে শঙ্খ। এই নদীর সাঙ্গু নামে বহুল পরিচিত। নদীটির মূল নাম উচ্চারণে অপারগ ব্রিটিশরা 'সাঙ্গু' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বলে কথিত রয়েছে। এর উৎসও মিয়ানমারের আরাকান পর্বতমালা। বান্দরবানের থানচি এলাকা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে রুমা, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর; চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। খরস্রোতা শঙ্খ স্থানীয় আদিবসীদের কাজে পূজনীয় ও পবিত্র। এর আয়তন কমবেশি ১৮০ কিলোমিটার।
নদী তিনটির বর্ণনাধর্মী উপস্থাপনা এই কারণে যে, এগুলো সম্পর্কে দেশের অন্যান্য অংশের নাগরিকরা প্রায়ই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। নাফ নদী, না সাগরের বর্ধিতাংশ_ সে বিতর্কের কথা আগেই বলেছি। সাঙ্গু ও শঙ্খ নদীকেও ভিন্ন দুই নদী হিসেবে মনে করেন অনেকে। বান্দরবানের মাতামুহুরী আর ফেনীর মুহুরী নদী গুলিয়ে ফেলার ঘটনাও কম নয়। ক্ষুদ্র এই নিবন্ধের প্রয়োজনে অনলাইনে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা গেল, নদী বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে যে মাতামুহুরী নদী ফেনী এলাকায় প্রবাহিত!
জনমানসে যেমন বিভ্রান্তি, কর্তৃপক্ষের দিক থেকে নাফ, মাতামুহুরী, শঙ্খ নিয়ে তেমনই উদাসীনতা চোখে পড়ে। এই তিন নদী বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ, কৃষি কিংবা যোগাযোগের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে; পাহাড় ও অরণ্যানীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছবির মতো, ছবি তোলার মতো এই তিন নদী ওই অঞ্চলের পর্যটন প্রসারে কতটা কাজে আসতে পারে; এগুলোর সাংস্কৃতিক মূল্য কী; মূলত সমভূমির এই দেশে গুটিকয়েক পাহাড়ি নদীর জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা_ এসব তো রয়েছেই। এই তিন 'আন্তঃসীমান্ত' নদীর যে কৌশলগত গুরুত্ব, সে ব্যাপারে আমাদের কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন?
আমাদের ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রবাহিত। আর তিনটি প্রবেশ করেছে মিয়ানমার থেকে। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে কত আলোচনা, সমীক্ষা, বৈঠক, সেমিনার, লেখালেখি হচ্ছে বলাই বাহুল্য। অভিন্ন ওইসব নদীর হিস্যা আমরা কতটা পেয়েছি, তা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি বা চেয়েছি_ সেটা ভিন্ন আলোচনা। ফলাফল ও অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন, ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলো আলোচনায় রয়েছে। এগুলোর মন্দ, ভালো, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করি। অন্তত কথা তো বলি! কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন তিন নদী যেন দুয়োরানী। কর্তৃপক্ষ কেবল পানি উন্নয়ন বোর্ড সীমান্ত নদীর তালিকায় নাফ, মাতামুহুরী, শঙ্খের নাম তুলেই দায় সেরেছে। সীমান্তের ঠিক কোন পয়েন্ট দিয়ে নদীগুলো প্রবেশ করেছে, বোঝা মুশকিল। ঠিক কী কারণে এগুলোকে আন্তর্জাতিক নদী বলব, সে প্রশ্ন যদি কেউ করেন_ জবাব পাওয়া ভার। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদী কতটা প্রভাবক গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় বোঝা গেছে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, 'ফারাক্কা ইস্যু' গত চার দশক ধরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কিন্তু মিয়ানমার প্রবাহনী তিন নদীর ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও গরজ নেই।
অনেকের জন্য অবাক করা তথ্য হতে পারে_ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের তিন অভিন্ন নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি, সমঝোতা বা প্রটোকল নেই। কোনো বিরোধ দেখা দিলে কার মাধ্যমে, কীভাবে নিষ্পত্তি হবে_ সেটা নির্দিষ্ট করা নেই। বস্তুত শেখ হাসিনা সরকারের গত মেয়াদে নাফ নদী নিয়ে বিরোধ দেখাও দিয়েছিল। নদীটির একটি চ্যানেলে ক্রস ড্যামের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। সে নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিরোধ এবং এক পর্যায়ে গোলাগুলিও হয়। পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈঠকে বসে এবং মিয়ানমার ড্যাম নির্মাণ বন্ধ করে দেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন_ এমন কয়েকজনের কাছে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেছিলাম যে মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন নদীর ব্যাপারে এমন শূন্যতা কেন? তাদের কেউ কেউ বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে 'পানি বণ্টন' নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বলে প্রটোকল বা যৌথ কমিশনের প্রয়োজন হয়নি। তার মানে, নদী হচ্ছে নিছক পানিপ্রবাহ_ এমন সংকীর্ণ ধারণার কারণেই নাফ-শঙ্খ নিয়ে যৌথ কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি! অথচ ক্রস ড্যাম নিয়ে আলোচ্য বিরোধটিই এমন ধারণার বিপক্ষে জ্বলন্ত উদাহরণ। সীমান্ত পিলার মেরামত করার জন্যও কি সাড়ে চার দশক পর একটি সম্পূরক চুক্তি করতে হচ্ছে না?
কেবল নদীর পানি ও সম্পদ ভাগাভাগী, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন নয়; গত কয়েক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নদীর 'অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা' দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। তিন অভিন্ন নদী নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সে ধরনের আলোচনা শুরুর এটাই প্রকৃত সময়। আর কিছু না হোক, কৌশলগত কারণেও তো নদী তিনটি নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার অবকাশ নেই। যে কয়টি দেশ এখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রাসী হয়ে উঠছে, মিয়ানমার সেগুলোর একটি। খোদা না খাস্তা, এই তিন যৌথ নদীর উজানে যদি দেশটি একক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ফেঁদেই বসে, তখন আমরা কী করব? আলোচনা বা দরকষাকষির জন্য নূ্যনতম আইনি ভিত্তিই তো নেই! নাফ নদীতে সীমান্ত পিলার মেরামতের ব্যাপারে সম্পূরক চুক্তি স্বাক্ষরের টেবিলেই কি বিষয়টি উপস্থাপন করা যায় না!
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এক চিলতে জলজ বিভাজন রেখা হয়ে থাকা নাফ নদী বেশিরভাগ সময়ই কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণ করে স্থলজ নানা কারণে। বিশেষ করে আরাকান রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন সীমান্ত অতিক্রম করতে চায়, তখন নাফ নদী নৌকা কিংবা সাঁতরে পার হওয়ার মানবিক কাহিনী স্থান পায় সংবাদমাধ্যমে। মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী নাসাকা নদীটিতে নেমে বাংলাদেশি জেলে আটকও অনেকটা নিয়মিত অঘটন। এর বাইরে নাফ এক শান্ত নদীর নাম। এই অঞ্চলের আর দশটা আন্তর্জাতিক নদীর মতো এর পানিসম্পদ, জল বণ্টন, বৈদেশিক দূষণ কিংবা সীমান্ত ভাঙন নিয়ে বিতর্ক নেই বললেই চলে। নাফ নদী, না সাগরের বর্ধিতাংশ_ এ নিয়ে অবশ্য খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। লোনা জল ও জোয়ার-ভাটার প্রবল প্রভাবের কারণে কেউ কেউ আধা শ্যামলা এ জলাভূমিকে বঙ্গোপসাগরের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
নাফ আদতে কিন্তু নদী_ একটু অন্যরকম। বাম তীরে বেশ কিছু ছোট-বড় ছড়া বা পাহাড়ি প্রবাহের সম্মিলিত ধারা। কক্সবাজার জেলার সর্বদক্ষিণে মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্তরেখা বরাবর প্রবাহিত এই ধারার দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬২ কিলোমিটার। এর প্রধান ধারাটির উৎস আরাকানের উত্তরাঞ্চলীয় পর্বতশ্রেণী। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালীর কাছে নাফের ডান তীর বাংলাদেশের ভেতরে চলে এসেছে। তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রবাহিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণের নিয়ম অনুযায়ী এর মধ্যপ্রবাহ হচ্ছে নোম্যান্স ল্যান্ড। নদীটির মোহনার কাছের স্থলভাগ বদর মোকাম বলে পরিচিত। বামতীরে আরাকানের আকিয়াব বন্দর আর বামতীরে রয়েছে টেকনাফ। নাফ নদীর টেকে অবস্থিত বলে এমন নাম।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আরও দুটি নদীর নাম এ প্রসঙ্গে বলতে হবে। প্রথমটি মাতামুহুরী। মগ ভাষায় নদীটি মামুরি এবং মারমা ভাষায় মুরিখিয়াং বা খিয়াং নামে পরিচিত। মাতামুহুরী নদীও অনেকটা নাফের মতো_ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কিছু পাহাড়ি ছড়ার মিলিত প্রবাহ। এর বেশিরভাগ ছড়ার উৎস সীমান্তের ওপারে, আরাকান পার্বত্যাঞ্চলে। স্থানীয়ভাবে মুহুরী অর্থ ছোট ছোট ছিদ্র বা ঝাঁজর। ঝাঁজরের মা হচ্ছে মাতামুহুরী। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা দিয়ে এর প্রধান ধারাটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে আলীকদম ও লামা উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাফলাপুরের কাছে মহেশখালী চ্যানেলে পতিত হয়েছে। মাতামুহুরীর দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার।
মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত তৃতীয় নদীটি হচ্ছে শঙ্খ। এই নদীর সাঙ্গু নামে বহুল পরিচিত। নদীটির মূল নাম উচ্চারণে অপারগ ব্রিটিশরা 'সাঙ্গু' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বলে কথিত রয়েছে। এর উৎসও মিয়ানমারের আরাকান পর্বতমালা। বান্দরবানের থানচি এলাকা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে রুমা, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর; চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। খরস্রোতা শঙ্খ স্থানীয় আদিবসীদের কাজে পূজনীয় ও পবিত্র। এর আয়তন কমবেশি ১৮০ কিলোমিটার।
নদী তিনটির বর্ণনাধর্মী উপস্থাপনা এই কারণে যে, এগুলো সম্পর্কে দেশের অন্যান্য অংশের নাগরিকরা প্রায়ই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। নাফ নদী, না সাগরের বর্ধিতাংশ_ সে বিতর্কের কথা আগেই বলেছি। সাঙ্গু ও শঙ্খ নদীকেও ভিন্ন দুই নদী হিসেবে মনে করেন অনেকে। বান্দরবানের মাতামুহুরী আর ফেনীর মুহুরী নদী গুলিয়ে ফেলার ঘটনাও কম নয়। ক্ষুদ্র এই নিবন্ধের প্রয়োজনে অনলাইনে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা গেল, নদী বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে যে মাতামুহুরী নদী ফেনী এলাকায় প্রবাহিত!
জনমানসে যেমন বিভ্রান্তি, কর্তৃপক্ষের দিক থেকে নাফ, মাতামুহুরী, শঙ্খ নিয়ে তেমনই উদাসীনতা চোখে পড়ে। এই তিন নদী বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ, কৃষি কিংবা যোগাযোগের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে; পাহাড় ও অরণ্যানীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছবির মতো, ছবি তোলার মতো এই তিন নদী ওই অঞ্চলের পর্যটন প্রসারে কতটা কাজে আসতে পারে; এগুলোর সাংস্কৃতিক মূল্য কী; মূলত সমভূমির এই দেশে গুটিকয়েক পাহাড়ি নদীর জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা_ এসব তো রয়েছেই। এই তিন 'আন্তঃসীমান্ত' নদীর যে কৌশলগত গুরুত্ব, সে ব্যাপারে আমাদের কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন?
আমাদের ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রবাহিত। আর তিনটি প্রবেশ করেছে মিয়ানমার থেকে। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে কত আলোচনা, সমীক্ষা, বৈঠক, সেমিনার, লেখালেখি হচ্ছে বলাই বাহুল্য। অভিন্ন ওইসব নদীর হিস্যা আমরা কতটা পেয়েছি, তা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি বা চেয়েছি_ সেটা ভিন্ন আলোচনা। ফলাফল ও অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন, ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলো আলোচনায় রয়েছে। এগুলোর মন্দ, ভালো, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করি। অন্তত কথা তো বলি! কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন তিন নদী যেন দুয়োরানী। কর্তৃপক্ষ কেবল পানি উন্নয়ন বোর্ড সীমান্ত নদীর তালিকায় নাফ, মাতামুহুরী, শঙ্খের নাম তুলেই দায় সেরেছে। সীমান্তের ঠিক কোন পয়েন্ট দিয়ে নদীগুলো প্রবেশ করেছে, বোঝা মুশকিল। ঠিক কী কারণে এগুলোকে আন্তর্জাতিক নদী বলব, সে প্রশ্ন যদি কেউ করেন_ জবাব পাওয়া ভার। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদী কতটা প্রভাবক গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় বোঝা গেছে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, 'ফারাক্কা ইস্যু' গত চার দশক ধরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কিন্তু মিয়ানমার প্রবাহনী তিন নদীর ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও গরজ নেই।
অনেকের জন্য অবাক করা তথ্য হতে পারে_ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের তিন অভিন্ন নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি, সমঝোতা বা প্রটোকল নেই। কোনো বিরোধ দেখা দিলে কার মাধ্যমে, কীভাবে নিষ্পত্তি হবে_ সেটা নির্দিষ্ট করা নেই। বস্তুত শেখ হাসিনা সরকারের গত মেয়াদে নাফ নদী নিয়ে বিরোধ দেখাও দিয়েছিল। নদীটির একটি চ্যানেলে ক্রস ড্যামের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। সে নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিরোধ এবং এক পর্যায়ে গোলাগুলিও হয়। পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈঠকে বসে এবং মিয়ানমার ড্যাম নির্মাণ বন্ধ করে দেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন_ এমন কয়েকজনের কাছে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেছিলাম যে মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন নদীর ব্যাপারে এমন শূন্যতা কেন? তাদের কেউ কেউ বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে 'পানি বণ্টন' নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বলে প্রটোকল বা যৌথ কমিশনের প্রয়োজন হয়নি। তার মানে, নদী হচ্ছে নিছক পানিপ্রবাহ_ এমন সংকীর্ণ ধারণার কারণেই নাফ-শঙ্খ নিয়ে যৌথ কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি! অথচ ক্রস ড্যাম নিয়ে আলোচ্য বিরোধটিই এমন ধারণার বিপক্ষে জ্বলন্ত উদাহরণ। সীমান্ত পিলার মেরামত করার জন্যও কি সাড়ে চার দশক পর একটি সম্পূরক চুক্তি করতে হচ্ছে না?
কেবল নদীর পানি ও সম্পদ ভাগাভাগী, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন নয়; গত কয়েক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নদীর 'অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা' দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। তিন অভিন্ন নদী নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সে ধরনের আলোচনা শুরুর এটাই প্রকৃত সময়। আর কিছু না হোক, কৌশলগত কারণেও তো নদী তিনটি নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার অবকাশ নেই। যে কয়টি দেশ এখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রাসী হয়ে উঠছে, মিয়ানমার সেগুলোর একটি। খোদা না খাস্তা, এই তিন যৌথ নদীর উজানে যদি দেশটি একক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ফেঁদেই বসে, তখন আমরা কী করব? আলোচনা বা দরকষাকষির জন্য নূ্যনতম আইনি ভিত্তিই তো নেই! নাফ নদীতে সীমান্ত পিলার মেরামতের ব্যাপারে সম্পূরক চুক্তি স্বাক্ষরের টেবিলেই কি বিষয়টি উপস্থাপন করা যায় না!
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments