বাউল নির্যাতন-সালিশনামার জোরেই কি অপরাধী পার পেয়ে যাবে? by আবু সাঈদ খান
পাংশার ঘটনাটি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ, ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্বীকৃত। এখানে সব ধর্মের, সব মতের মানুষের স্ব-স্ব বিশ্বাস অনুযায়ী চলার অধিকার রয়েছে। তা সংরক্ষণ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য।
আশার কথা এই যে, বাউল নির্যাতনের এই ঘটনায় সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের পাশাপাশি হাইকোর্টও রুল জারি করেছেন\'
কলহ-বিবাদ নিষ্পত্তি নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ। এটি হতে পারে আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় অথবা আদালতের বাইরে বিশিষ্টজনের উদ্যোগে। আদালতের বাইরে কলহ-বিবাদ নিষ্পত্তির উদ্যোগকে ছোট করে দেখা যায় না। তবে সেই উদ্যোগ যদি হয় কোনো ঘৃণ্য অপরাধকে আড়াল করার বা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, তবে তা সমর্থনযোগ্য নয়, বরং নিন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে গত ১৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার পাংশায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিমের নেতৃত্বে একটি সমঝোতা সালিশের উল্লেখ করা যায়।
ওই সালিশে পাংশা উপজেলার রামনগর গ্রামে ২৮ জন বাউলকে লাঞ্ছিত করা এবং তাদের গোঁফ ও চুল কেটে দেওয়ার অপরাধে দায়ের করা মামলা তুলে নেওয়াসহ ৬ পয়েন্টের একটি আপসনামা তৈরি হয়।
সংবাদপত্রের বিবরণে জানা যায়, ২০ বছর ধরে রামনগর গ্রামের ফকির মোহাম্মদ আলী শাহ'র বাড়িতে লালনভক্তদের সাধুসঙ্গ হয়ে আসছে। গত ৫ এপ্রিল দু'দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বাউলরা এতে যোগ দেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে যখন তারা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন, তখন স্থানীয় কিছু লোক তাদের ওপর চড়াও হয়। তাদের লাঞ্ছিত করে, চুল ও গোঁফ কেটে দেয় এবং তাদের মসজিদে নিয়ে গান না গাওয়ার জন্য তওবা করানো হয়। এ ঘটনার পর ফকির মোহাম্মদ আলী শাহ সব বাউলকে নিয়ে পাংশা থানায় যান এবং একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ১৯ এপ্রিল সংসদ সদস্যের উদ্যোগে তৈরি আপসনামা অনুযায়ী ঘটনার শিকার বাউলরা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। এ প্রসঙ্গে বাদী ফকির মোহাম্মদ আলী বলেছেন, সালিশে সম্মত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। ক্ষমতাসীনদের দোর্দণ্ডপ্রতাপের মুখে আসলেই আপস ছাড়া কোনো উপায় ছিল তাদের? চাপের মুখেই তাদের আপসনামায় স্বাক্ষর করতে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। আমরা জানি, কুষ্টিয়ার মাওলানা আফসার উদ্দিন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গত শতকের চলি্লশ দশকে 'বাউল খেদা' ধ্বনি দিয়ে বাউলদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। এর আগে মাওলানা রেয়াজউদ্দিনসহ অনেকেই বাউলদের ধ্বংস করার ফতোয়া দিয়েছিলেন; কিন্তু বাউলদের অস্তিত্ব বিনাশ করতে পারেননি। সব বাধা পেরিয়ে বাউলরা টিকে আছে এবং তাদের কর্মধারা অব্যাহত রেখেছে।
এর পেছনে রয়েছে বাউলদের মানবিক চেতনা ও আত্মপ্রত্যয়। বাউলরা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় থেকে এসে একত্রিত হয়। ধর্মীয় গণ্ডির ঊধর্ে্ব উঠে মানবতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়। তারা কয়েকশ' বছর ধরে গ্রাম-বাংলাজুড়ে জাতপাতের বিরুদ্ধে মানবতার বাণী প্রচার করে চলেছেন। আমাদের লোকায়ত জীবনে যে মানবিক উদারতার পরিচয় মেলে, বাউলরা তার পথিকৃৎ।
কেবল বাউলদের বিরুদ্ধে নয়, বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা, ফুটবল খেলা, সঙ্গীতচর্চা, সিনেমা দেখা, টেলিভিশন দেখা, ছবি তোলা, নারী অধিকারসহ বিভিন্ন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধেও ফতোয়াবাজি চলেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারাই প্রগতির কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধেই ফতোয়া জারি করা হয়েছে। মোল্লারা মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, কবি সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন আজাদসহ অনেককে কাফের ও মুরতাদ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের দৃষ্টিতে নারী নেতৃত্বও হারাম। তারা দেশের দুই নেত্রীকে বোরকা পরে অন্তঃপুরে ফিরে যাওয়ার কথাও বলেছেন।
গ্রাম পর্যায়ে এই ফতোয়াবাজ মোল্লাদের দোসর গ্রাম্য মাতবর। গ্রাম্য মাতবররা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে এ ধরনের ফতোয়াবাজদের সহযোগী হয়। আবার নিজেদের স্বার্থে ফতোয়াবাজদের ব্যবহার করে। পরনারী ভোগের বাসনা থেকে 'তিন তালাক ও হিল্লা' বিয়ের ফতোয়া দেওয়ার ঘটনাও কারও অজানা নয়।
গ্রাম-বাংলার ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে স্থানীয় শিক্ষক, ডাক্তার, শিক্ষিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক কর্মীদের সোচ্চার প্রতিবাদ অতীতে ছিল, এখনও আছে। তবে এর সঙ্গে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকদের যোগসাজশ লক্ষণীয়। একাত্তরে ধর্মাশ্রয়ী দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ফতোয়া দিয়েছিল যে, হিন্দুদের সম্পত্তি ও নারী গনিমতের মাল, তা ভোগ করা যাবে। সেদিন জনগণ ফতোয়ায় বিভ্রান্ত হয়নি বরং সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ অস্ত্র হাতে তাদের পদানত করেছিল। আজও এ ফতোয়াবাজদের পেছনে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে যোগাযোগ রয়েছে, তার প্রমাণ অঢেল।
তবে রাজবাড়ীর পাংশার এই অপকর্মে মোল্লাদের সঙ্গে মিলেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সঙ্গত কারণেই যে দলের বাউলদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন থাকার কথা, সে দলের কর্মীরা যখন তাদের লাঞ্ছিত করে চুল-গোঁফ কেটে দেয়, তখন হতবাক না হয়ে পারি না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রবাজি-টেন্ডারবাজির প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে শিবির ঢুকে গেছে। জানি না, পাংশায় বাউল নির্যাতনের ঘটনার পর তিনি কী বলবেন? তবে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে মৌলবাদী রাজনীতি অনুসরণ না করলেও মৌলবাদী মানসিকতার যে ছোঁয়া লেগেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। ৮ এপ্রিলের কালের কণ্ঠে পড়েছি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতিউর রহমান নবাব বলেছেন, 'মুসলিম ধর্মীয় রীতি না মেনে বাউলরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জিন্দা ফয়তা ও এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছিল। এটি এলাকার মুসলমানরা মেনে নিতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে বাউলদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় এলাকার কিছু যুবক তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।'
সাঈদী-আমিনীরা নববর্ষবরণ, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ভাষায় মন্তব্য করেন। এ ক্ষেত্রে পাংশার আওয়ামী কর্মীরা এক কাঠি সরেস। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, বাউলদের চুল-গোঁফও কেটে দিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই মতিভ্রমের কারণ কী? এটি কি তৃণমূল কর্মীদের বিপথগামিতা, না অন্য কিছু? আর যা-ই থাক এর অন্যতম কারণ যে ভোটের রাজনীতি তা বলাই বাহুল্য। এই ভোটের রাজনীতির জন্য ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি মৌলবাদী তোষণনীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সময়ে উভয় দলই মুসলিম সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে ভোট পেতে ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে অশুভ আঁতাত করেছে। বিএনপি এখন জামায়াত-খেলাফত নিয়ে জোটবদ্ধ। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিজেদের ধার্মিক প্রমাণে মরিয়া। পাংশায় বাউল নির্যাতনের ঘটনাটি নিজেদের ধার্মিক জাহির করার মানসিকতা থেকে সৃষ্ট কি-না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ১৯৯৭ সালের নারীনীতি সংশোধন করে নতুন নারীনীতিতে সম্পত্তিতে নারীদের সমঅধিকারের বিষয়টি অগ্রাহ্য করা ধার্মিক হিসেবে নিজেদের পরিচয়কে তুলে ধরার প্রচেষ্টা বলেও মনে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে বিপুলভাবে বিজয়লাভ করেছে, সেটি কিন্তু মৌলবাদীদের ভোটে নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া নতুন প্রজন্ম ও নারী ভোটই ছিল বিজয়ের মূলশক্তি। এই নতুন প্রজন্ম সংস্কারমুক্ত, নারীরা আজ অধিকার সচেতন। অতএব যে দল নারী ও নতুন প্রজন্মকে মর্যাদা ও অধিকার দেবে, মুক্তচিন্তার দ্বার উন্মোচিত করবে_ আগামীতে বিজয় তাদেরই করতলে থাকবে।
পাংশার ঘটনাটি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ, ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্বীকৃত। এখানে সব ধর্মের, সব মতের মানুষের স্ব-স্ব বিশ্বাস অনুযায়ী চলার অধিকার রয়েছে। তা সংরক্ষণ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। আশার কথা এই যে, বাউল নির্যাতনের এই ঘটনায় সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের পাশাপাশি হাইকোর্টও রুল জারি করেছেন। হাইকোর্ট ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চেয়েছেন। ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিচালক, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে সাত দিনের মধ্যে নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নেওয়া আইনানুগ ব্যবস্থার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সাংসদের নেতৃত্বে যে আপসনামাই তৈরি হোক না কেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ এখনও জারি আছে। আইনের শাসনের স্বার্থেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে, সেটিই প্রত্যাশা করি। আর যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে থেকে অপকর্ম করে দলের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে, দল তাদের বর্জন করলে সেটি হবে অনন্য দৃষ্টান্ত।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
কলহ-বিবাদ নিষ্পত্তি নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ। এটি হতে পারে আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় অথবা আদালতের বাইরে বিশিষ্টজনের উদ্যোগে। আদালতের বাইরে কলহ-বিবাদ নিষ্পত্তির উদ্যোগকে ছোট করে দেখা যায় না। তবে সেই উদ্যোগ যদি হয় কোনো ঘৃণ্য অপরাধকে আড়াল করার বা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, তবে তা সমর্থনযোগ্য নয়, বরং নিন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে গত ১৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার পাংশায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিমের নেতৃত্বে একটি সমঝোতা সালিশের উল্লেখ করা যায়।
ওই সালিশে পাংশা উপজেলার রামনগর গ্রামে ২৮ জন বাউলকে লাঞ্ছিত করা এবং তাদের গোঁফ ও চুল কেটে দেওয়ার অপরাধে দায়ের করা মামলা তুলে নেওয়াসহ ৬ পয়েন্টের একটি আপসনামা তৈরি হয়।
সংবাদপত্রের বিবরণে জানা যায়, ২০ বছর ধরে রামনগর গ্রামের ফকির মোহাম্মদ আলী শাহ'র বাড়িতে লালনভক্তদের সাধুসঙ্গ হয়ে আসছে। গত ৫ এপ্রিল দু'দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বাউলরা এতে যোগ দেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে যখন তারা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন, তখন স্থানীয় কিছু লোক তাদের ওপর চড়াও হয়। তাদের লাঞ্ছিত করে, চুল ও গোঁফ কেটে দেয় এবং তাদের মসজিদে নিয়ে গান না গাওয়ার জন্য তওবা করানো হয়। এ ঘটনার পর ফকির মোহাম্মদ আলী শাহ সব বাউলকে নিয়ে পাংশা থানায় যান এবং একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ১৯ এপ্রিল সংসদ সদস্যের উদ্যোগে তৈরি আপসনামা অনুযায়ী ঘটনার শিকার বাউলরা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। এ প্রসঙ্গে বাদী ফকির মোহাম্মদ আলী বলেছেন, সালিশে সম্মত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। ক্ষমতাসীনদের দোর্দণ্ডপ্রতাপের মুখে আসলেই আপস ছাড়া কোনো উপায় ছিল তাদের? চাপের মুখেই তাদের আপসনামায় স্বাক্ষর করতে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। আমরা জানি, কুষ্টিয়ার মাওলানা আফসার উদ্দিন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গত শতকের চলি্লশ দশকে 'বাউল খেদা' ধ্বনি দিয়ে বাউলদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। এর আগে মাওলানা রেয়াজউদ্দিনসহ অনেকেই বাউলদের ধ্বংস করার ফতোয়া দিয়েছিলেন; কিন্তু বাউলদের অস্তিত্ব বিনাশ করতে পারেননি। সব বাধা পেরিয়ে বাউলরা টিকে আছে এবং তাদের কর্মধারা অব্যাহত রেখেছে।
এর পেছনে রয়েছে বাউলদের মানবিক চেতনা ও আত্মপ্রত্যয়। বাউলরা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় থেকে এসে একত্রিত হয়। ধর্মীয় গণ্ডির ঊধর্ে্ব উঠে মানবতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়। তারা কয়েকশ' বছর ধরে গ্রাম-বাংলাজুড়ে জাতপাতের বিরুদ্ধে মানবতার বাণী প্রচার করে চলেছেন। আমাদের লোকায়ত জীবনে যে মানবিক উদারতার পরিচয় মেলে, বাউলরা তার পথিকৃৎ।
কেবল বাউলদের বিরুদ্ধে নয়, বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা, ফুটবল খেলা, সঙ্গীতচর্চা, সিনেমা দেখা, টেলিভিশন দেখা, ছবি তোলা, নারী অধিকারসহ বিভিন্ন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধেও ফতোয়াবাজি চলেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারাই প্রগতির কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধেই ফতোয়া জারি করা হয়েছে। মোল্লারা মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, কবি সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন আজাদসহ অনেককে কাফের ও মুরতাদ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের দৃষ্টিতে নারী নেতৃত্বও হারাম। তারা দেশের দুই নেত্রীকে বোরকা পরে অন্তঃপুরে ফিরে যাওয়ার কথাও বলেছেন।
গ্রাম পর্যায়ে এই ফতোয়াবাজ মোল্লাদের দোসর গ্রাম্য মাতবর। গ্রাম্য মাতবররা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে এ ধরনের ফতোয়াবাজদের সহযোগী হয়। আবার নিজেদের স্বার্থে ফতোয়াবাজদের ব্যবহার করে। পরনারী ভোগের বাসনা থেকে 'তিন তালাক ও হিল্লা' বিয়ের ফতোয়া দেওয়ার ঘটনাও কারও অজানা নয়।
গ্রাম-বাংলার ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে স্থানীয় শিক্ষক, ডাক্তার, শিক্ষিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক কর্মীদের সোচ্চার প্রতিবাদ অতীতে ছিল, এখনও আছে। তবে এর সঙ্গে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকদের যোগসাজশ লক্ষণীয়। একাত্তরে ধর্মাশ্রয়ী দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ফতোয়া দিয়েছিল যে, হিন্দুদের সম্পত্তি ও নারী গনিমতের মাল, তা ভোগ করা যাবে। সেদিন জনগণ ফতোয়ায় বিভ্রান্ত হয়নি বরং সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ অস্ত্র হাতে তাদের পদানত করেছিল। আজও এ ফতোয়াবাজদের পেছনে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে যোগাযোগ রয়েছে, তার প্রমাণ অঢেল।
তবে রাজবাড়ীর পাংশার এই অপকর্মে মোল্লাদের সঙ্গে মিলেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সঙ্গত কারণেই যে দলের বাউলদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন থাকার কথা, সে দলের কর্মীরা যখন তাদের লাঞ্ছিত করে চুল-গোঁফ কেটে দেয়, তখন হতবাক না হয়ে পারি না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রবাজি-টেন্ডারবাজির প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে শিবির ঢুকে গেছে। জানি না, পাংশায় বাউল নির্যাতনের ঘটনার পর তিনি কী বলবেন? তবে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে মৌলবাদী রাজনীতি অনুসরণ না করলেও মৌলবাদী মানসিকতার যে ছোঁয়া লেগেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। ৮ এপ্রিলের কালের কণ্ঠে পড়েছি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতিউর রহমান নবাব বলেছেন, 'মুসলিম ধর্মীয় রীতি না মেনে বাউলরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জিন্দা ফয়তা ও এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছিল। এটি এলাকার মুসলমানরা মেনে নিতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে বাউলদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় এলাকার কিছু যুবক তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।'
সাঈদী-আমিনীরা নববর্ষবরণ, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ভাষায় মন্তব্য করেন। এ ক্ষেত্রে পাংশার আওয়ামী কর্মীরা এক কাঠি সরেস। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, বাউলদের চুল-গোঁফও কেটে দিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই মতিভ্রমের কারণ কী? এটি কি তৃণমূল কর্মীদের বিপথগামিতা, না অন্য কিছু? আর যা-ই থাক এর অন্যতম কারণ যে ভোটের রাজনীতি তা বলাই বাহুল্য। এই ভোটের রাজনীতির জন্য ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি মৌলবাদী তোষণনীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সময়ে উভয় দলই মুসলিম সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে ভোট পেতে ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে অশুভ আঁতাত করেছে। বিএনপি এখন জামায়াত-খেলাফত নিয়ে জোটবদ্ধ। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিজেদের ধার্মিক প্রমাণে মরিয়া। পাংশায় বাউল নির্যাতনের ঘটনাটি নিজেদের ধার্মিক জাহির করার মানসিকতা থেকে সৃষ্ট কি-না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ১৯৯৭ সালের নারীনীতি সংশোধন করে নতুন নারীনীতিতে সম্পত্তিতে নারীদের সমঅধিকারের বিষয়টি অগ্রাহ্য করা ধার্মিক হিসেবে নিজেদের পরিচয়কে তুলে ধরার প্রচেষ্টা বলেও মনে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে বিপুলভাবে বিজয়লাভ করেছে, সেটি কিন্তু মৌলবাদীদের ভোটে নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া নতুন প্রজন্ম ও নারী ভোটই ছিল বিজয়ের মূলশক্তি। এই নতুন প্রজন্ম সংস্কারমুক্ত, নারীরা আজ অধিকার সচেতন। অতএব যে দল নারী ও নতুন প্রজন্মকে মর্যাদা ও অধিকার দেবে, মুক্তচিন্তার দ্বার উন্মোচিত করবে_ আগামীতে বিজয় তাদেরই করতলে থাকবে।
পাংশার ঘটনাটি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ, ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্বীকৃত। এখানে সব ধর্মের, সব মতের মানুষের স্ব-স্ব বিশ্বাস অনুযায়ী চলার অধিকার রয়েছে। তা সংরক্ষণ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। আশার কথা এই যে, বাউল নির্যাতনের এই ঘটনায় সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের পাশাপাশি হাইকোর্টও রুল জারি করেছেন। হাইকোর্ট ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চেয়েছেন। ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিচালক, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে সাত দিনের মধ্যে নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নেওয়া আইনানুগ ব্যবস্থার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সাংসদের নেতৃত্বে যে আপসনামাই তৈরি হোক না কেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ এখনও জারি আছে। আইনের শাসনের স্বার্থেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে, সেটিই প্রত্যাশা করি। আর যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে থেকে অপকর্ম করে দলের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে, দল তাদের বর্জন করলে সেটি হবে অনন্য দৃষ্টান্ত।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments