স্পেনের অমর কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার জীবন ও কবিতার মধ্য দিয়ে গভীর ধারায় বয়ে গেছে মৃত্যু। কবিতার পাশাপাশি তাঁর জীবনও হয়ে উঠেছিল এ সময়ের এক দর্পণ। সাজ্জাদ শরিফ ভাষান্তরিত লোরকার নির্বাচিত কবিতার প্রকাশিতব্য বই রক্ত ও অশ্রুর গাথা থেকে কিছু অংশ। -মৃত্যুর পটে এক কবি
ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা বলেছিলেন, ‘কবি সব সময়েই চূড়ান্ত অর্থে নৈরাজ্যবাদী। তিনি শুধু তার ভেতরে জেগে ওঠা তিনটি প্রবল কণ্ঠস্বরই মন দিয়ে শোনেন: সব রকম আগাম সতর্কবার্তাসহ মৃত্যুর কণ্ঠস্বর, প্রেমের কণ্ঠস্বর আর শিল্পের কণ্ঠস্বর।’ লোরকার কবিতা মাত্রেই প্রেম ও শিল্পের জয়ধ্বনি। কিন্তু জীবনের আনন্দে উদ্ভাসিত এই কবির কাছে মৃত্যু এত অনিবার্য হয়ে উঠবে কেন? এর কোনো সহজ উত্তর নেই। শুধু মৃত্যুকে উন্মিলিত হতে দেখা যায় বিচিত্রভাবে, তাঁর কবিতায় যেমন, জীবনেও।
জীবনের একেবারে সূচনাপর্বের এক কবিতা ‘ছোট চত্বরের গাথা’ দিয়ে শুরু মৃত্যুর সঙ্গে লোরকার বোঝাপড়া। এই কবিতা মৃত্যুলিপ্ত এক সংলাপনাট্য। এখানে একদল শিশুর সঙ্গে কথা হচ্ছে কবির। শিশুরা তাঁকে অনুযোগ করছে, কেন তিনি ওদের ফেলে চলে গিয়েছিলেন দূরে। নানা প্রশ্নে কবির মন বুঝে নিতে চাইছে তারা। কবি ওদের বলছেন, তিনি চলে গিয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া ঘণ্টাধ্বনির খোঁজে, হয়তো মরণের ওপারে। কেন? শিশুবেলার আনন্দের উপাদানগুলো ফিরিয়ে আনতে। শিশুরাও মৃত্যুর এক প্রতিস্পর্ধী উপাদান লোরকার কবিতায়। জীবনের শেষে যেমন শারীরিক মৃত্যু হয় আমাদের, শিশুবেলারও তো মৃত্যু ঘটে যায় প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে। সেই মৃত্যুকে পেরিয়ে শিশুবয়সের আনন্দসম্ভার তা হলে কীভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? কবি কী করে তা পারবেন? লোরকার প্রস্তাব, সেটি পাওয়া সম্ভব ‘কবিদের পথরেখা’ ধরে এগিয়ে গিয়ে তবেই। তিনি মনে করেন, এটি কবিদেরই এক কাজ, মৃত্যুর অধিকার থেকে জীবনকে উদ্ধার করা।
সূচনাপর্বের এই কবিতায় লোরকা যেন পুরো কবিজীবনব্যাপী নিজেরই এক ব্রত পালনের কথা ঘোষণা করে রাখলেন। এ মৃত্যু সত্তার ছোট ছোট অজস্র মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে আমাদের জীবনের ভেতরে ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু একই সঙ্গে এ কবিতায় লোরকা, যেন বা আলগোছে, লিখে রাখলেন তাঁর নিজের ভবিতব্যময় মৃত্যুরও এক পূর্ব-আলেখ্য।
লোরকার বন্ধু ও শিল্পী সালভাদোর দালি যা বলেছেন, তাতে মনে হয়, মৃত্যুকে যেন লোরকা উদ্যাপনই করতেন, রীতিমতো শারীরিকভাবে। তাঁর মৃত্যুকে, অন্তত মৃত্যুভয়কে, পেরিয়ে যাওয়ার জন্য এ যেন এক মায়াবী ক্রীড়া, এক ভুডু ম্যাজিক। দালি লিখেছেন:
লোরকা দিনে অন্তত পাঁচবার তার মৃত্যুর কথা বলত। রাতে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কয়েকজন মিলে তাকে ‘বিছানায় সোপর্দ করতাম’, সে ঘুমাতে যেতে পারত না। শেষ পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়েও সে কবিতা নিয়ে তার চরম অতিলৌকিক আলাপটি—যে আলাপ সম্পর্কে কোনো শতাব্দীরই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই—অন্তহীনভাবে টেনে লম্বা করে রাখার কোনো একটা উপায় খুঁজে বেড়াত। প্রায় সব সময়েই সে তার কথা শেষ করত মৃত্যু, বিশেষ করে ওর নিজের মৃত্যু দিয়ে।
লোরকা যা কিছু বলেছে, বিশেষ করে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে, তার সবটাই হয় সে গেয়ে শুনিয়েছে, নয়তো অভিনয়ে রূপ দিয়েছে। সবটুকুই সে করে দেখিয়েছে। ‘দ্যাখো,’ সে বলত, ‘আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে কেমন দেখাবে!’ এই বলে ব্যালে নাচের ধাঁচে আড়াআড়ি কিছু একটা করে দেখাত। শেষকৃত্যের সময়, যখন গ্রানাদার ঢালু খাদের গভীরে কফিনটা নেমে যাবে, ওই সময়কার মরদেহের ভঙ্গুর বিচলনের ছবি ফুটে উঠত ওর ভঙ্গিতে। এর পর মরে যাওয়ার দিন কয়েক পরে ওর মুখটা কেমন দেখাবে, সে আমাদের সেটা করে দেখাত। তখন ওর চেহারায়, যা এমনিতে খুব সুদর্শন ছিল না, নতুন এক সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ত, এমনকি তা অসম্ভব লাবণ্যমণ্ডিত হয়ে উঠত। তারপর আমাদের ওপরে তার কেমন প্রভাব পড়ল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ও মুচকি মুচকি হাসত। দর্শক-শ্রোতাদের ওপর নিরঙ্কুশ কাব্যিক আধিপত্য স্থাপনের জয়োল্লাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠত ওর মুখ।
এই মৃত্যুরই এক ভয়ংকর নিয়তি নিষ্ঠুর আঘাত হানল লোরকার নিজের জীবনে।
লোরকার জন্মবছরে স্পেনের রাজনৈতিক নিয়তিও এক ঝঞ্ঝামুখর পথে যাত্রার সূচনা করে। স্পেন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে এ বছর পরাজিত হয় স্পেন। এর পর থেকে সামরিক অভ্যুত্থান, রাজতন্ত্রের পুনরুত্থান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশটি চলতে থাকে এলোমেলোভাবে। ১৯২৯ সালে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা গেলে প্রগতিপন্থীদের সমর্থিত দ্বিতীয় রিপাবলিক ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা নানা ষড়যন্ত্রে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার আবহাওয়া তৈরি করে রাখে। স্পেনের সাবেক উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রী ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো নাৎসি জার্মানির অ্যাডল্ফ্ হিটলার ও ফ্যাসিবাদী ইতালির বেনিতো মুসোলিনির স্পেনের ক্ষমতা দখল করে নেন। স্পেনে দীর্ঘদিনের জন্য মুক্তির সূর্য গভীর অন্ধকারে ঢলে পড়ে।
ফ্রাংকো ফালাঞ্জিস্ট গুণ্ডারা গৃহযুদ্ধের সূচনাতেই বুদ্ধিজীবীদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের স্লোগান ছিল, ‘বুদ্ধিজীবী নিপাত যাক’। গৃহযুদ্ধের একেবারে শুরুতেই ফ্রাংকোর ফালাঞ্জ বাহিনীর হিংস্রতার শিকার হন ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা।
গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে, ১৯৩৬ সালে, লোরকা বাস করছিলেন মাদ্রিদে। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, ফালাঞ্জিস্টরা তাঁর প্রাণ হরণ করতে পারে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সন্ত্রস্ত লোরকা মাদ্রিদ ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি গ্রানাদায় চলে যান। মাদ্রিদ ছাড়ার দিন তাঁর শেষ সাক্ষাৎ হয় বন্ধু রাফায়েল নাদাল ও পাবলো নেরুদার সঙ্গে। নাদাল ও নেরুদা লোরকার মাদ্রিদ ছাড়ার ভিন্ন ভিন্ন দুটি তারিখ উল্লেখ করেছেন। তারিখ নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, কিন্তু তাঁর নিয়তি নিশ্চিত হয়ে ছিল। নেরুদা লিখছেন:
আমার দিক থেকে ঘটনার শুরু ১৯ জুলাই ১৯৩৬-এর রাত থেকে। ববি দেহলানে নামে চিলির এক সম্পদশালী হাসিখুশি মানুষ সিরকো প্রিসের মস্ত এরেনায় কুস্তির আয়োজক ছিলেন। এই ‘খেলা’টির গুরুত্ব সম্পর্কে আমি তাঁকে আমার অনিচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম। খেলাটা যে সত্যিই কত অকৃত্রিম, সেটা উপলব্ধি করার জন্য সে দিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে গারসিয়া লোরকাকে নিয়ে এরেনায় যেতে রাজি করালেন। ব্যাপারটি নিয়ে আমি লোরকার সঙ্গে কথা বললাম। নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেখানে মিলিত হতে রাজি হলাম আমরা। আমরা যাব মুখোশধারী গর্তজীবী, হাবশি জল্লাদ আর অশুভ ওরাংওটাং নামের কুস্তিগিরদের লড়াই উপভোগ করতে।
লোরকা এল না। ওই সময়টাতে সে ততক্ষণে তার মৃত্যুর পথে যাত্রা করেছে। আমাদের পরস্পরের আর দেখা হয়নি: অন্য এক জল্লাদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কাল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। আর এ রকমই ছিল স্পেনের গৃহযুদ্ধ, যা আমার কবিতাকে পাল্টে দেয়। সে পাল্টে যাওয়ার সূচনা একজন কবির অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে।
গ্রানাদায় পৌঁছে লোরকা আশ্রয় নেন তাঁর ফালাঞ্জ-সমর্থক বন্ধু লুইস রোসালেসের বাড়িতে। সপ্তাহ খানেকের মাথায় রামোন রুইস আলোনসো নামে এক লোকের নেতৃত্বে উগ্রপন্থী ফালাঞ্জরা লোরকাকে রোসালেসের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেই শেষ। পরদিন থেকে লোরকার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাঁর অন্তিম প্রহরগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য।
লোরকার শেষ দিনগুলি সম্পর্কে বন্ধু ও চলচ্চিকার লুইস বুনুয়েল লিখেছেন:
একদিন এক রিপাবলিকানের মুখে আমি লোরকার মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম। তিনি কোনোরকমে শত্রুসীমানার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।...
...ফ্রাংকোর আবির্ভাবের চার দিন আগে লোরকা—রাজনীতি নিয়ে যার কিনা কোনো মাথাব্যথাই ছিল না—হঠাৎ তার দেশের বাড়ি গ্রানাদায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
‘ফেদেরিকো,’ অনুনয় করে আমি ওকে বললাম, ‘ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানেই তোমার জন্য নিরাপদ।’
আমাদের কথায় সে মোটেই কান দিল না। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পরদিনই বিদায় নিল। ওর মৃত্যুর খবর ছিল মারাত্মক একটা আঘাতের মতো। আজ পর্যন্ত যত মানুষকে আমি জেনেছি, লোরকা ছিল সবার চেয়ে সেরা। ওর কবিতা বা নাটকের কথা আমি বলছি না। আমি বলছি ব্যক্তি-লোরকার কথা। ও ছিল তার নিজের সেরা শিল্পকর্ম। পিয়ানোতে বসে শোপ্যাঁ বাজাচ্ছে, কি স্বতঃস্ফূর্ত কোনো মূকাভিনয়ের মুদ্রা মেলে ধরছে, বা অভিনয় করছে নাটকের কোনো দৃশ্যে, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। সে পড়ত চমৎকার। তার ছিল আবেগ, তারুণ্য আর আনন্দ। রেসিদেনসিয়ায় ওর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, আমি তখন ছিলাম এক অমার্জিত গ্রাম্য তরুণ, যার আগ্রহ ছিল শুধু খেলায়। আমাকে সে পাল্টে দিয়েছিল। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একেবারে আলাদা একটা জগতের সঙ্গে। সে ছিল এক অগ্নিশিখার মতো।
কখনোই আর ওর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওর মৃত্যু নিয়ে নানা খামখেয়ালি জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি সালভাদোর দালি পর্যন্ত একবার বাজে একটা ইঙ্গিত করে বলেছিল যে এর পেছনে সমকামের কোনো ব্যাপার থেকে থাকতে পারে। সত্য হলো এই যে, লোরকা খুন হয়েছে সে কবি ছিল বলে। গৃহযুদ্ধের সময়কার জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘বুদ্ধিজীবী নিপাত যাক’। সাদা চোখে যা দেখা যায়, তা হলো এই: গ্রানাদায় ফিরে গিয়ে লোরকা কবি রোসালেসের ওখানে ছিল। রোসালেস ছিল ফালাঞ্জিস্ট। লোরকা ও তাদের পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার ধারণা, লোরকা ভেবেছিল ওখানে সে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু আলোনসো নামে কোনো একজনের নেতৃত্বে একদল লোক (কেউ জানে না তারা কারা, জানলেও এখন আর কিছু আসে-যায় না) এক রাতে এসে হাজির হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করল। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে ট্রাকে চড়িয়ে নিয়ে গেল দূরে কোথাও। যন্ত্রণা ও মৃত্যুর ব্যাপারে লোরকা শঙ্কিত বোধ করত। মধ্যরাতে ট্রাকে করে যখন তাকে গুলি করে মারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন যে সে কী অনুভব করছিল, আমি তা কল্পনা করতে পারি। প্রায় সময়েই সে কথা আমি ভাবি।
সেই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবিদার কারও কারও সঙ্গে কথা বলে লোরকার জীবনীকার ইয়ান গিবসন তাঁর মৃত্যুময় শেষ দিনগুলোর একটি ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর তথ্য বা অনুমান অনুযায়ী, ১৯ জুন ১৯৩৬-এ জাতীয়তাবাদী ফালাঞ্জ মিলিশিয়ারা ফুয়েন্তে গ্রান্দে নামে রাস্তার ওপর একটি জায়গায় লোরকাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আরও তিনজন বন্দির সঙ্গে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
লোরকাকে হত্যা করা হয় গৃহযুদ্ধ শুরুর একেবারে দু-তিন দিনের মাথায়। কিন্তু এর মাস তিনেক আগে পাবলো নেরুদাকে ডেকে একটি অদ্ভুত ঘটনা শুনিয়েছিলেন লোরকা। নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথায় সে ঘটনার এক অসামান্য বিবরণ দিয়েছেন:
লোরকা তার মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়েছিল। একবার, তার নাট্যসফরের অল্প কিছু দিন পরে, অদ্ভুত এক অঘটনের কথা বলার জন্য আমাকে সে খবর পাঠাল। তার নাট্যদল লা বাররাকাকে নিয়ে পথ হারিয়ে সে গিয়ে হাজির হয়েছিল কাস্তিইয়ের এক গ্রামে। শহরের প্রান্তে তাঁবু ফেলেছিল তারা। সফরের চাপে মারাত্মক ক্লান্তির কারণে লোরকা ঘুমাতে পারল না। কাকভোরে উঠে একা একা হাঁটতে বেরিয়ে গেল। ঠান্ডা, পর্যটক ও বহিরাগতদের জন্য তুলে রাখা কাস্তিইয়ের ছুরির মতো ধারালো ঠান্ডা। কুয়াশা সাদা সাদা অবয়ব নিচ্ছিল, আর সবকিছুর মধ্যে উসকে দিচ্ছিল এক ভৌতিক আবহ।
জংধরা লোহার একটা বিরাট তোরণ। শুষ্ক পাতার রাশির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা প্রতিমা আর বিধ্বস্ত থাম। পুরোনো একটা জমিদারির প্রবেশদ্বারের সামনে সে থমকে দাঁড়াল। কোনো সামন্ত কাছারিবাড়ির বিরাট বাগানের ফটক। সেই পতিত পটভূমি, সেই প্রহর, সেই হিম আরও তীক্ষ করে তুলল নির্জনতাকে। নিজেকে হঠাৎ চাপগ্রস্ত মনে হলো লোরকার। যেন প্রত্যুষের মধ্য থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসবে, যেন ঘটতে যাচ্ছে কিছু একটা। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকা একটি স্তম্ভের মাথায় লোরকা বসে পড়ল।
ঘাস খেতে খেতে ছোট্ট এক ভেড়া কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এল সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। যেন কুয়াশার এক দেবদূত, নির্জনতাকে মানবিক করে তোলার জন্য শূন্য থেকে এর ভেতরে একটা পাপড়ির মতো ঝরে পড়েছে। কবি তখন আর একলা বোধ করছিল না। আচমকা একদল শুয়োর সেই প্রাঙ্গণে এসে পড়ল। চারটা কি পাঁচটা অন্ধকারের জন্তু। পাশব ক্ষুধা আর পাথরপ্রতিম খুরঅলা আধা বন্য শুয়োর। এরপর লোরকা যা দেখল, তা এক রক্ত হিম করা দৃশ্য। একটা শুয়োর ঝাপিয়ে পড়ল ভেড়াটির ওপর। আর কবির মনে গভীর ত্রাস সঞ্চার করে ভেড়াটিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে খেয়ে ফেলল।
নির্জন স্থানের সেই রক্তাক্ত দৃশ্য লোরকাকে বাধ্য করল তার নাট্যদলটিকে পথে ফিরিয়ে আনতে। গৃহযুদ্ধের তিন মাস আগে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা যখন এই রক্ত হিম করা গল্প আমাকে শুনিয়েছিল, তখনো তার মনে জেগে ছিল সেই বিভীষিকা। পরে আমি ক্রমে ক্রমে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি যে, সেই ঘটনাটি ছিল লোরকার নিজের মৃত্যুরই এক পূর্বদৃশ্য, তার অবিশ্বাস্য বিয়োগকাহিনির এক পূর্বাভাস।
লোরকা যেন নেরুদার বহু আগেই উপলব্ধি করেছিলেন এ কথা। আর সে কারণেই সব রকমের পূর্ব-সতর্কবার্তাসহ মৃত্যুর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কবির সংবেদনশীল মনোযোগ তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল এতটা জরুরি। কবিতার পর কবিতায় লোরকা অবিশ্রাম যা রচনা করে গেছেন, কিছুটা প্রতিসরিত অর্থে, সেটি যেন তাই ‘এক পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি’।
সূচনাপর্বের এই কবিতায় লোরকা যেন পুরো কবিজীবনব্যাপী নিজেরই এক ব্রত পালনের কথা ঘোষণা করে রাখলেন। এ মৃত্যু সত্তার ছোট ছোট অজস্র মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে আমাদের জীবনের ভেতরে ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু একই সঙ্গে এ কবিতায় লোরকা, যেন বা আলগোছে, লিখে রাখলেন তাঁর নিজের ভবিতব্যময় মৃত্যুরও এক পূর্ব-আলেখ্য।
লোরকার বন্ধু ও শিল্পী সালভাদোর দালি যা বলেছেন, তাতে মনে হয়, মৃত্যুকে যেন লোরকা উদ্যাপনই করতেন, রীতিমতো শারীরিকভাবে। তাঁর মৃত্যুকে, অন্তত মৃত্যুভয়কে, পেরিয়ে যাওয়ার জন্য এ যেন এক মায়াবী ক্রীড়া, এক ভুডু ম্যাজিক। দালি লিখেছেন:
লোরকা দিনে অন্তত পাঁচবার তার মৃত্যুর কথা বলত। রাতে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কয়েকজন মিলে তাকে ‘বিছানায় সোপর্দ করতাম’, সে ঘুমাতে যেতে পারত না। শেষ পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়েও সে কবিতা নিয়ে তার চরম অতিলৌকিক আলাপটি—যে আলাপ সম্পর্কে কোনো শতাব্দীরই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই—অন্তহীনভাবে টেনে লম্বা করে রাখার কোনো একটা উপায় খুঁজে বেড়াত। প্রায় সব সময়েই সে তার কথা শেষ করত মৃত্যু, বিশেষ করে ওর নিজের মৃত্যু দিয়ে।
লোরকা যা কিছু বলেছে, বিশেষ করে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে, তার সবটাই হয় সে গেয়ে শুনিয়েছে, নয়তো অভিনয়ে রূপ দিয়েছে। সবটুকুই সে করে দেখিয়েছে। ‘দ্যাখো,’ সে বলত, ‘আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে কেমন দেখাবে!’ এই বলে ব্যালে নাচের ধাঁচে আড়াআড়ি কিছু একটা করে দেখাত। শেষকৃত্যের সময়, যখন গ্রানাদার ঢালু খাদের গভীরে কফিনটা নেমে যাবে, ওই সময়কার মরদেহের ভঙ্গুর বিচলনের ছবি ফুটে উঠত ওর ভঙ্গিতে। এর পর মরে যাওয়ার দিন কয়েক পরে ওর মুখটা কেমন দেখাবে, সে আমাদের সেটা করে দেখাত। তখন ওর চেহারায়, যা এমনিতে খুব সুদর্শন ছিল না, নতুন এক সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ত, এমনকি তা অসম্ভব লাবণ্যমণ্ডিত হয়ে উঠত। তারপর আমাদের ওপরে তার কেমন প্রভাব পড়ল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ও মুচকি মুচকি হাসত। দর্শক-শ্রোতাদের ওপর নিরঙ্কুশ কাব্যিক আধিপত্য স্থাপনের জয়োল্লাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠত ওর মুখ।
এই মৃত্যুরই এক ভয়ংকর নিয়তি নিষ্ঠুর আঘাত হানল লোরকার নিজের জীবনে।
লোরকার জন্মবছরে স্পেনের রাজনৈতিক নিয়তিও এক ঝঞ্ঝামুখর পথে যাত্রার সূচনা করে। স্পেন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে এ বছর পরাজিত হয় স্পেন। এর পর থেকে সামরিক অভ্যুত্থান, রাজতন্ত্রের পুনরুত্থান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশটি চলতে থাকে এলোমেলোভাবে। ১৯২৯ সালে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা গেলে প্রগতিপন্থীদের সমর্থিত দ্বিতীয় রিপাবলিক ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা নানা ষড়যন্ত্রে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার আবহাওয়া তৈরি করে রাখে। স্পেনের সাবেক উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রী ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো নাৎসি জার্মানির অ্যাডল্ফ্ হিটলার ও ফ্যাসিবাদী ইতালির বেনিতো মুসোলিনির স্পেনের ক্ষমতা দখল করে নেন। স্পেনে দীর্ঘদিনের জন্য মুক্তির সূর্য গভীর অন্ধকারে ঢলে পড়ে।
ফ্রাংকো ফালাঞ্জিস্ট গুণ্ডারা গৃহযুদ্ধের সূচনাতেই বুদ্ধিজীবীদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের স্লোগান ছিল, ‘বুদ্ধিজীবী নিপাত যাক’। গৃহযুদ্ধের একেবারে শুরুতেই ফ্রাংকোর ফালাঞ্জ বাহিনীর হিংস্রতার শিকার হন ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা।
গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে, ১৯৩৬ সালে, লোরকা বাস করছিলেন মাদ্রিদে। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, ফালাঞ্জিস্টরা তাঁর প্রাণ হরণ করতে পারে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সন্ত্রস্ত লোরকা মাদ্রিদ ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি গ্রানাদায় চলে যান। মাদ্রিদ ছাড়ার দিন তাঁর শেষ সাক্ষাৎ হয় বন্ধু রাফায়েল নাদাল ও পাবলো নেরুদার সঙ্গে। নাদাল ও নেরুদা লোরকার মাদ্রিদ ছাড়ার ভিন্ন ভিন্ন দুটি তারিখ উল্লেখ করেছেন। তারিখ নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, কিন্তু তাঁর নিয়তি নিশ্চিত হয়ে ছিল। নেরুদা লিখছেন:
আমার দিক থেকে ঘটনার শুরু ১৯ জুলাই ১৯৩৬-এর রাত থেকে। ববি দেহলানে নামে চিলির এক সম্পদশালী হাসিখুশি মানুষ সিরকো প্রিসের মস্ত এরেনায় কুস্তির আয়োজক ছিলেন। এই ‘খেলা’টির গুরুত্ব সম্পর্কে আমি তাঁকে আমার অনিচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম। খেলাটা যে সত্যিই কত অকৃত্রিম, সেটা উপলব্ধি করার জন্য সে দিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে গারসিয়া লোরকাকে নিয়ে এরেনায় যেতে রাজি করালেন। ব্যাপারটি নিয়ে আমি লোরকার সঙ্গে কথা বললাম। নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেখানে মিলিত হতে রাজি হলাম আমরা। আমরা যাব মুখোশধারী গর্তজীবী, হাবশি জল্লাদ আর অশুভ ওরাংওটাং নামের কুস্তিগিরদের লড়াই উপভোগ করতে।
লোরকা এল না। ওই সময়টাতে সে ততক্ষণে তার মৃত্যুর পথে যাত্রা করেছে। আমাদের পরস্পরের আর দেখা হয়নি: অন্য এক জল্লাদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কাল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। আর এ রকমই ছিল স্পেনের গৃহযুদ্ধ, যা আমার কবিতাকে পাল্টে দেয়। সে পাল্টে যাওয়ার সূচনা একজন কবির অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে।
গ্রানাদায় পৌঁছে লোরকা আশ্রয় নেন তাঁর ফালাঞ্জ-সমর্থক বন্ধু লুইস রোসালেসের বাড়িতে। সপ্তাহ খানেকের মাথায় রামোন রুইস আলোনসো নামে এক লোকের নেতৃত্বে উগ্রপন্থী ফালাঞ্জরা লোরকাকে রোসালেসের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেই শেষ। পরদিন থেকে লোরকার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাঁর অন্তিম প্রহরগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য।
লোরকার শেষ দিনগুলি সম্পর্কে বন্ধু ও চলচ্চিকার লুইস বুনুয়েল লিখেছেন:
একদিন এক রিপাবলিকানের মুখে আমি লোরকার মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম। তিনি কোনোরকমে শত্রুসীমানার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।...
...ফ্রাংকোর আবির্ভাবের চার দিন আগে লোরকা—রাজনীতি নিয়ে যার কিনা কোনো মাথাব্যথাই ছিল না—হঠাৎ তার দেশের বাড়ি গ্রানাদায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
‘ফেদেরিকো,’ অনুনয় করে আমি ওকে বললাম, ‘ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানেই তোমার জন্য নিরাপদ।’
আমাদের কথায় সে মোটেই কান দিল না। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পরদিনই বিদায় নিল। ওর মৃত্যুর খবর ছিল মারাত্মক একটা আঘাতের মতো। আজ পর্যন্ত যত মানুষকে আমি জেনেছি, লোরকা ছিল সবার চেয়ে সেরা। ওর কবিতা বা নাটকের কথা আমি বলছি না। আমি বলছি ব্যক্তি-লোরকার কথা। ও ছিল তার নিজের সেরা শিল্পকর্ম। পিয়ানোতে বসে শোপ্যাঁ বাজাচ্ছে, কি স্বতঃস্ফূর্ত কোনো মূকাভিনয়ের মুদ্রা মেলে ধরছে, বা অভিনয় করছে নাটকের কোনো দৃশ্যে, সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। সে পড়ত চমৎকার। তার ছিল আবেগ, তারুণ্য আর আনন্দ। রেসিদেনসিয়ায় ওর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, আমি তখন ছিলাম এক অমার্জিত গ্রাম্য তরুণ, যার আগ্রহ ছিল শুধু খেলায়। আমাকে সে পাল্টে দিয়েছিল। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একেবারে আলাদা একটা জগতের সঙ্গে। সে ছিল এক অগ্নিশিখার মতো।
কখনোই আর ওর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওর মৃত্যু নিয়ে নানা খামখেয়ালি জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি সালভাদোর দালি পর্যন্ত একবার বাজে একটা ইঙ্গিত করে বলেছিল যে এর পেছনে সমকামের কোনো ব্যাপার থেকে থাকতে পারে। সত্য হলো এই যে, লোরকা খুন হয়েছে সে কবি ছিল বলে। গৃহযুদ্ধের সময়কার জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘বুদ্ধিজীবী নিপাত যাক’। সাদা চোখে যা দেখা যায়, তা হলো এই: গ্রানাদায় ফিরে গিয়ে লোরকা কবি রোসালেসের ওখানে ছিল। রোসালেস ছিল ফালাঞ্জিস্ট। লোরকা ও তাদের পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার ধারণা, লোরকা ভেবেছিল ওখানে সে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু আলোনসো নামে কোনো একজনের নেতৃত্বে একদল লোক (কেউ জানে না তারা কারা, জানলেও এখন আর কিছু আসে-যায় না) এক রাতে এসে হাজির হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করল। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে ট্রাকে চড়িয়ে নিয়ে গেল দূরে কোথাও। যন্ত্রণা ও মৃত্যুর ব্যাপারে লোরকা শঙ্কিত বোধ করত। মধ্যরাতে ট্রাকে করে যখন তাকে গুলি করে মারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন যে সে কী অনুভব করছিল, আমি তা কল্পনা করতে পারি। প্রায় সময়েই সে কথা আমি ভাবি।
সেই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবিদার কারও কারও সঙ্গে কথা বলে লোরকার জীবনীকার ইয়ান গিবসন তাঁর মৃত্যুময় শেষ দিনগুলোর একটি ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর তথ্য বা অনুমান অনুযায়ী, ১৯ জুন ১৯৩৬-এ জাতীয়তাবাদী ফালাঞ্জ মিলিশিয়ারা ফুয়েন্তে গ্রান্দে নামে রাস্তার ওপর একটি জায়গায় লোরকাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আরও তিনজন বন্দির সঙ্গে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
লোরকাকে হত্যা করা হয় গৃহযুদ্ধ শুরুর একেবারে দু-তিন দিনের মাথায়। কিন্তু এর মাস তিনেক আগে পাবলো নেরুদাকে ডেকে একটি অদ্ভুত ঘটনা শুনিয়েছিলেন লোরকা। নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথায় সে ঘটনার এক অসামান্য বিবরণ দিয়েছেন:
লোরকা তার মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়েছিল। একবার, তার নাট্যসফরের অল্প কিছু দিন পরে, অদ্ভুত এক অঘটনের কথা বলার জন্য আমাকে সে খবর পাঠাল। তার নাট্যদল লা বাররাকাকে নিয়ে পথ হারিয়ে সে গিয়ে হাজির হয়েছিল কাস্তিইয়ের এক গ্রামে। শহরের প্রান্তে তাঁবু ফেলেছিল তারা। সফরের চাপে মারাত্মক ক্লান্তির কারণে লোরকা ঘুমাতে পারল না। কাকভোরে উঠে একা একা হাঁটতে বেরিয়ে গেল। ঠান্ডা, পর্যটক ও বহিরাগতদের জন্য তুলে রাখা কাস্তিইয়ের ছুরির মতো ধারালো ঠান্ডা। কুয়াশা সাদা সাদা অবয়ব নিচ্ছিল, আর সবকিছুর মধ্যে উসকে দিচ্ছিল এক ভৌতিক আবহ।
জংধরা লোহার একটা বিরাট তোরণ। শুষ্ক পাতার রাশির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা প্রতিমা আর বিধ্বস্ত থাম। পুরোনো একটা জমিদারির প্রবেশদ্বারের সামনে সে থমকে দাঁড়াল। কোনো সামন্ত কাছারিবাড়ির বিরাট বাগানের ফটক। সেই পতিত পটভূমি, সেই প্রহর, সেই হিম আরও তীক্ষ করে তুলল নির্জনতাকে। নিজেকে হঠাৎ চাপগ্রস্ত মনে হলো লোরকার। যেন প্রত্যুষের মধ্য থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসবে, যেন ঘটতে যাচ্ছে কিছু একটা। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকা একটি স্তম্ভের মাথায় লোরকা বসে পড়ল।
ঘাস খেতে খেতে ছোট্ট এক ভেড়া কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এল সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। যেন কুয়াশার এক দেবদূত, নির্জনতাকে মানবিক করে তোলার জন্য শূন্য থেকে এর ভেতরে একটা পাপড়ির মতো ঝরে পড়েছে। কবি তখন আর একলা বোধ করছিল না। আচমকা একদল শুয়োর সেই প্রাঙ্গণে এসে পড়ল। চারটা কি পাঁচটা অন্ধকারের জন্তু। পাশব ক্ষুধা আর পাথরপ্রতিম খুরঅলা আধা বন্য শুয়োর। এরপর লোরকা যা দেখল, তা এক রক্ত হিম করা দৃশ্য। একটা শুয়োর ঝাপিয়ে পড়ল ভেড়াটির ওপর। আর কবির মনে গভীর ত্রাস সঞ্চার করে ভেড়াটিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে খেয়ে ফেলল।
নির্জন স্থানের সেই রক্তাক্ত দৃশ্য লোরকাকে বাধ্য করল তার নাট্যদলটিকে পথে ফিরিয়ে আনতে। গৃহযুদ্ধের তিন মাস আগে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা যখন এই রক্ত হিম করা গল্প আমাকে শুনিয়েছিল, তখনো তার মনে জেগে ছিল সেই বিভীষিকা। পরে আমি ক্রমে ক্রমে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি যে, সেই ঘটনাটি ছিল লোরকার নিজের মৃত্যুরই এক পূর্বদৃশ্য, তার অবিশ্বাস্য বিয়োগকাহিনির এক পূর্বাভাস।
লোরকা যেন নেরুদার বহু আগেই উপলব্ধি করেছিলেন এ কথা। আর সে কারণেই সব রকমের পূর্ব-সতর্কবার্তাসহ মৃত্যুর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কবির সংবেদনশীল মনোযোগ তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল এতটা জরুরি। কবিতার পর কবিতায় লোরকা অবিশ্রাম যা রচনা করে গেছেন, কিছুটা প্রতিসরিত অর্থে, সেটি যেন তাই ‘এক পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি’।
No comments