ঘা শুকায়, শুকায় না আঘাত by মোফাজ্জল করিম
না, পারলাম না, মাসখানেক চেষ্টা করলাম মুখটা সেলাই করে রাখতে। পাছে আবার কার পা মাড়িয়ে দিই, পাছে কোন দেবতা রুষ্ট হন, এই কার্তিকের শেষে কার ডবকা ডবকা ধানের শীষগুলোতে মই দিয়ে ফেলি, সেই ভয়ে ভেবেছিলাম জবান খুলব না; কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন অহর্নিশ জ্বালিয়ে মারছে : হেই ব্যাটা,
এরা না তোর সন্তানতুল্য, এরা না নবীন, এদের সুবুদ্ধি-কুবুদ্ধি কিছুই পাকেনি এখনো, এদের ওপর রাগ করলে কি চলে। অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকিস না, তোর অভিজ্ঞতার ধূলিমলিন, ছেঁড়া ঝুলি থেকে দেখ্ না দু-চারটি কানাকড়ি বেরোয় কি না।
কাদের কথা বলছি? হ্যাঁ, যাদের কথা বলছি, আজকের লেখাটি শুধু তাদের জন্য। শুধু তারাই যদি পড়ে এ লেখাটি, তবে 'শ্রম সার্থক মনে করব'। তারা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের সেই সব প্রশাসন-কর্মকর্তা, যারা কাজ করছে 'মাঠে'... জেলা-উপজেলা-বিভাগে। পারলে লেখাটির শিরোনামের নিচে লিখে দিতাম : 'কেবলমাত্র মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কর্মকর্তাদের জন্য', যেভাবে আগে দেখতাম কোনো কোনো সাময়িকী বা বই-পুস্তক পিনাবদ্ধ করে মলাটের ওপর ছেপে দেওয়া হতো : 'কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য'। আমার এসব উত্তরসূরি সহকর্মী আমার চেয়ে বয়সে যতই নবীন হোক না কেন, কোনো বিচারেই তাদের অর্বাচীন বলা যাবে না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাদের কারো কারো কাজকর্ম দেখে রীতিমতো ধন্দে পড়ে যাই।
আচ্ছা, ডিসি সাহেব, ইউএনও সাহেব- তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তোমরা একটু ভেবেচিন্তে উত্তর দাও তো। তোমরা যখন সারা দিনের দৌড়াদৌড়ি-ছোটাছুটি, মিটিং-সিটিং, লেখালেখি-ফোনাফোনি, তেলাতেলি, একে ধরো-ওকে বান্ধো ইত্যাদির পর বিধ্বস্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে একটু ভাবতে চেষ্টা করো, সেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাদের জন্য, কিসের জন্য এই রক্ত জল করা পরিশ্রম করলে, তখন কী মনে হয়? তখন কি মনে হয় না, তোমার সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তোমার জেলার বা উপজেলার মানুষ? তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আপদ-বিপদ, উন্নতি-অবনতি- এগুলো নিয়েই তো একজন প্রশাসকের জীবন। তোমাকে সরকার তোমার দায়িত্বাধীন এলাকার শীর্ষপদে পদায়িত করেছে। একটু ভেবে দেখো, তোমার ওপর কতটুকু আস্থা স্থাপন করেছে সরকার, রাষ্ট্র। সঙ্গে সঙ্গে জনগণের কত প্রত্যাশা তোমার কাছে। এটা নতুন কিছু নয়। ইসলামের প্রথম যুগে, এমনকি তারও আগে, ইউরোপে, ভারতবর্ষে বা মিসরে যখনই কোথাও কোনো আঞ্চলিক শাসনকর্তাকে প্রেরণ করা হতো, তখন তাঁর আনুগত্য, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার ওপর প্রেরণকারীর আস্থা ও বিশ্বাস যেমন থাকত অগাধ, তাঁর কাছে সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের প্রত্যাশাও থাকত তেমনি সীমাহীন। সেই শাসনকর্তা ছিলেন সার্বভৌম শাসক বা নরপতির প্রতিনিধি ও তাঁকে প্রদত্ত সব ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী। তিনি সার্বভৌম শাসকের ফরমান বা আইনি ক্ষমতাবলে নিজ এলাকায় ছিলেন সর্বেসর্বা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
ব্রিটিশ আমল থেকে এই ভূখণ্ডে সাধারণ মানুষ তাঁকে 'মাই-বাপ' বলে জানে। (এক প্রজাপীড়ক অত্যাচারী প্রশাসককে নাকি তার এলাকার লোকেরা বলেছিল, হুজুর, আপনি আমাদের মাই-বাপ, আমরা তো কুত্তার বাচ্চা। আপনি যা হুকুম করবেন তা-ই মাথা পেতে নেব।) যা হোক, মানুষের এই যে অকুণ্ঠ নির্ভরতা, এই প্রত্যয়, নিরাপত্তালাভের এই যে নিশ্চিত বিশ্বাস, এর মর্যাদা দিতে না জানলে প্রশাসকের আসনে বসাই উচিত নয়। এসব কথা তোমরা সবাই জানো। চাকরিতে যোগদান করার পর হাজার বার হাজার কণ্ঠে এসব কথা তোমরা শুনেছো। এবং বস্তুতপক্ষে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তোমরা তোমাদের এলাকার সাধারণ-অসাধারণ, ধনী-গরিব সব শ্রেণীর মানুষের ডাকে সাড়া দিচ্ছো, নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছো তাদের কল্যাণের জন্য। ঠিক কি না? আর করবে নাই বা কেন? এটাই তো তোমাদের কাজ। আমাদের চাকরির শুরুতে ট্রেনিং পিরিয়ডের সময় লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে আমাদের সিনিয়র একজন বিখ্যাত সিভিল সার্ভেন্ট (সিএসপি) ড. তারিক সিদ্দিকী আমাদের ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। ক্লাস কামাই করলে কিংবা অন্য কোনোভাবে কাজে ফাঁকি দিলে 'হার্ড টাস্কমাস্টার' ড. সিদ্দিকী খুব রেগে যেতেন। একদিন রেগে গিয়ে পুরো ক্লাসকে তিনি শুনিয়ে দিলেন, জেন্টেলমেন, রিমেম্বার, ইউ আর পেইড ফর দিস। অর্থাৎ, বক্তৃতার কচকচানি শুনতে ভালো লাগে না, তাই ক্লাসে আসতে চাও না, কিন্তু মিয়ারা মনে রেখো, এই ক্লাসে আসার জন্য তোমরা বেতন পাচ্ছো। (অতএব, বেতনের পয়সাটা হালাল করে খাও)।
তাহলে জানতে পারি কি, কেন সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা, এমনকি রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত রামুর বৌদ্ধমন্দিরগুলোর ওপর আক্রমণ হানার জন্য যখন পাঁয়তারা চলছে, উসকানিমূলক মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-বক্তৃতা হচ্ছে, ভালো-মন্দ, ধনী-গরিব, এমনকি সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতকারী নির্বিশেষে 'জগতের সকল মানুষ সুখী হোক' বলে যে মানুষগুলো অহোরাত্র গৌতম বুদ্ধের শরণ প্রার্থনা করছে, সেই অতি নিরীহ, শান্ত-ভদ্র, 'অহিংসা পরম ধর্ম'- এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত নগণ্যসংখ্যক মানুষের যখন প্রাণসংহারের শঙ্কা দেখা দিল, তখন কঙ্বাজারের ডিসি তুমি, রামুর ইউএনও তুমি কেন 'খবরদার-খবরদার-খবরদার হো' বলে লোক-লশকর নিয়ে তোমাদের পুলিশ বাহিনী প্রধানসহ ছুটে গেলে না? কেন প্রয়োজনবোধে আরো ফোর্স চেয়ে পাঠালে না? পৃথিবীর সব বৌদ্ধ তো আর আরাকানের রামদা-লাঠি-বল্লমে সজ্জিত মুসলমান নিধনকারী উন্মাদ বৌদ্ধ নয়। এই ক্ষমাহীন নির্লিপ্ততার কী জবাব দেবে তোমরা?
তোমাদের র্যাব লিমনকে গুলি মারতে পারে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে তোমাদের পুলিশ। আর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি পুড়িয়ে যারা ছাই করল, লুণ্ঠন করল অসংখ্য অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বিশ্বের দরবারে অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে মুসলমানপ্রধান দেশ এক অপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে, সেই দেশের মুখে চিরদিনের জন্য যে দুর্বৃত্তরা লেপন করল কলঙ্ককালিমা, তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করল না তারা। তোমরা কেউ সেদিন ছুটে গেলে না তোমার বৌদ্ধ ভাইবোনের পাশে, বললে না : ভয় নেই ভাই, ভয় নেই বোন, আমি যতক্ষণ এই জেলার ডিসি আছি, ততক্ষণ কোনো মায়ের পুত তোমাদের বা তোমাদের মন্দিরের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সব কয়টাকে ঠেঙ্গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেব। পারলে না বলতে? তোমরা কি ভয় পেয়েছিলে? না কি তোমাদের কাছে ডিসি মানে শুধু 'মাননীয় জেলা প্রশাসক', শুধু ফুলের মালা এবং তৈলমর্দন গ্রহণ ও প্রদান? তোমরা কি অপেক্ষায় ছিলে মন্ত্রী সাহেব বা এমপি সাহেবের নির্দেশের? তা-ই যদি হয় তাহলে কিছু মনে করো না, প্রতি মাসে তোমাদের বেতনের একটা বড় অংশ তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। (আশা করি পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এখনো আসেনি। তবে বলা যায় না, যা দেখছি চারপাশে...।)
হায়, আমাদের জনসাধারণ আপদে-বিপদে তাহলে আর কার কাছে যাবে? নিরপেক্ষতার, সাহসিকতার, তেজস্বিতার ঐতিহ্যবাহী ডিসি নামক সেই অতি মর্যাদাশীল ইনস্টিটিউশনটির এ কী করুণ পরিণতি! এ কী ক্লীবত্ব তার! লোকে চিরকাল জেনে-বুঝেই যাকে 'হুজুর মাই-বাপ' (ডিসি-রা কি উভয়লিঙ্গ? আমাকে যখন কেউ মাই-বাপ বলত, আমি বলতাম, ভাই, একটা ডাকুন, হয় মাই, না হলে বাপ, একসঙ্গে দুটো বলে অযথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।) বলে এসেছে, তাদের সেই পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল কি তাহলে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? তোমার বস্ এমপি সাহেব (বাই দ্য ওয়ে, জনান্তিকে বলে রাখি, ইনি কোনোকালেই কিন্তু আমাদের বস্ ছিলেন না।), বড় বস্ মন্ত্রী সাহেব (তোমার 'দুর্ভাগ্যক্রমে' তোমার এলাকা থেকে যদি কেউ মন্ত্রী বা পাতিমন্ত্রী হয়ে থাকেন), বিরোধী সাহেবরা ... এরা সবাই তো আছেন যাঁর যাঁর তালে। প্রথম দুজন তো তেল ছাড়া কিছু বোঝেন না। তাঁদের মুখের লব্জ হচ্ছে : 'রাখেন আপনার আইন। এই এলাকায় আমি যা বলব সেটাই আইন।' এখানেই আমার 'দুইখান কথা আছে।' এ ধরনের পরিস্থিতিতে তোমাকে অত্যন্ত পলাইটলি বাট ফার্মলি, খুবই বিনীতভাবে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে, না বলতে পারতে হবে। তুমি বলবে, তাহলে তো স্যার, পরদিনই মনপুরা না হয় খাগড়াছড়িতে বদলি। আর এর চেয়েও খারাপ ... ওএসডি হয়ে প্রশাসনের দেবদাস সেজে সচিবালয়ের বারান্দায় বারান্দায় 'ম্যাঁয় আওয়ারা হুঁ ...' গাইতে হবে বাকি জীবন। হলে হবে। তাই বলে কি তোমার সারা জীবন অতিকষ্টে লালিত স্ফটিকশুভ্র বিবেকটিকে জবাই করবে নাকি? আর শোনো, ইজ্জত এবং জিল্লতির মালিক আল্লাহ : 'ও তুইয্যু মানতাশাউ ও তুযিল্লু মানতাশাউ বিয়াদিকাল খাইর। ইন্নাকা আ'লা কুলি্লশ্ শাইইন কাদির।' (আল কোরআন : সুরা আলে ইমরান, আয়াত ২৬। বাংলা অনুবাদ : যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মান দাও, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করো। তোমার হাতেই কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সব ব্যাপারে সর্বক্ষমতার অধিকারী।) তিনি (আল্লাহ রাব্বুল আলামিন) যা করেন তাঁর বান্দার কল্যাণের জন্যই করেন। এই বিশ্বাসটাকে বুকের ভেতর অনির্বাণ শিখার মতো জ্বালিয়ে রাখো না কেন, দেখবে, অন্যায়কারীর, ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর সব আস্ফালন তুচ্ছ মনে হচ্ছে তোমার কাছে। আর সেই জনপ্রিয় গানটির কথাগুলোই বা স্মরণ করো না কেন : এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে/এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরও কাছে। সব সময় মনে বিশ্বাস রাখবে, যেভাবে চলছে সেভাবে চিরদিন চলবে না, চলতে পারে না। চললে পরে সুশাসন, সুবিচার তো দূরের কথা, পুরো জাতিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিছু মনে করো না, উপদেশের 'ডোজ' হয়তো 'ওভারডোজ' হয়ে যাচ্ছে। তবু রোগের লক্ষণ বুঝে ডাক্তারদের কখনো কখনো ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিতে দেখেছি। মানসিক প্রশান্তিলাভের জন্য একটি কথা তোমাদের ভেবে দেখতে বলি। আজকাল ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, কারণে-অকারণে যেখানে মানুষের জীবন সমানে বাজে খরচ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে তুমি-আমি যে এখনো এই পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করছি, সেটা কি কম বড় নিয়ামত? একাত্তরে আমাদেরই কিছু কিছু বিরল মেধার অধিকারী সহকর্মী কি খানসেনাদের হাতে প্রাণ দেননি? ওটা তো সেদিন তুমিও হতে পারতে, আমিও হতে পারতাম। কাজেই বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে চলবে, নোয়াবে না। 'যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে' : (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। (আগে আমি আমার কনিষ্ঠ সহকর্মীদের বলতাম, বাঘের বাচ্চার মতো চলবে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ডার্টি জোকটা শোনার পর থেকে আর বলি না। এখন বলি : 'হিম্মত না হার, প্রভুকো পুকার/ওহি তেরি নাইয়া লাগায়েঙ্গে পার।' পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকের একটি হিন্দি ছায়াছবির গান, ছবির নাম 'পান্না'।)
ইস্, বৌদ্ধমন্দির আক্রমণ যদি তোমরা ঠেকাতে পারতে তাহলে, ডিসি সাহেব-ইউএনও সাহেব এক মন্দিরের কারণে কত লাখ মানুষের মনোমন্দিরে যে তোমরা চিরস্থায়ী ঠাঁই করে নিতে পারতে! আর যদি ঠেকাতে নাও পারতে, তবু তোমাদের প্রচেষ্টার জন্য লোকে বলত, আমাদের ডিসি সাহেব বেচারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে; কিন্তু কী করব, আমাদের কপাল মন্দ। তোমরা এখন হয়েছো খলনায়ক, অথচ ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার কী অপূর্ব সুযোগটা তোমরা হারালে।
আমি জানি, একদিন বৌদ্ধরা 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি' বলে ২৯ সেপ্টেম্বরের ('ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর!) কালো রাত্রির নির্মম তাণ্ডবলীলা ভুলে গিয়ে প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বই জন সৎ লোক, অসাম্প্রদায়িক লোক তাদের পাশে থেকে শক্তি-সাহস জুগিয়ে চলেছে, চলবে।
কিন্তু তার পরও একটি কথা থেকে যায়। যে আঘাত আমার শরীরে করা হয়, তাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় আমার শরীর। আঘাতকারী তা দেখে হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, নেচে ওঠে পৈশাচিক উল্লাসে। আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট আনন তাকে দেয় নারকীয় আনন্দ। রক্ত ঝরে ঝরে আমার সারা শরীরে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত। তারপর একদিন সেরে ওঠে সে ক্ষত। আমি আবার সুস্থ-সবল হয়ে উঠে দাঁড়াই ধরণীর বুকে।
কিন্তু যে আঘাত লাগে আমার মনে, আমার সমগ্র সত্তায়, মননে- সেটা কি সেরে ওঠে কোনো দিন? না, সারে না, নিরালোকের সে আঘাত শুকায় না, শুকাতে পারে না।
ঘা শুকায়, শুকায় না আঘাত। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বৌদ্ধদেরও ক্ষত হয়তো শুকাবে, আঘাত শুকাবে না।
০৫.১১.১২
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
কাদের কথা বলছি? হ্যাঁ, যাদের কথা বলছি, আজকের লেখাটি শুধু তাদের জন্য। শুধু তারাই যদি পড়ে এ লেখাটি, তবে 'শ্রম সার্থক মনে করব'। তারা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের সেই সব প্রশাসন-কর্মকর্তা, যারা কাজ করছে 'মাঠে'... জেলা-উপজেলা-বিভাগে। পারলে লেখাটির শিরোনামের নিচে লিখে দিতাম : 'কেবলমাত্র মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কর্মকর্তাদের জন্য', যেভাবে আগে দেখতাম কোনো কোনো সাময়িকী বা বই-পুস্তক পিনাবদ্ধ করে মলাটের ওপর ছেপে দেওয়া হতো : 'কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য'। আমার এসব উত্তরসূরি সহকর্মী আমার চেয়ে বয়সে যতই নবীন হোক না কেন, কোনো বিচারেই তাদের অর্বাচীন বলা যাবে না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাদের কারো কারো কাজকর্ম দেখে রীতিমতো ধন্দে পড়ে যাই।
আচ্ছা, ডিসি সাহেব, ইউএনও সাহেব- তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তোমরা একটু ভেবেচিন্তে উত্তর দাও তো। তোমরা যখন সারা দিনের দৌড়াদৌড়ি-ছোটাছুটি, মিটিং-সিটিং, লেখালেখি-ফোনাফোনি, তেলাতেলি, একে ধরো-ওকে বান্ধো ইত্যাদির পর বিধ্বস্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে একটু ভাবতে চেষ্টা করো, সেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাদের জন্য, কিসের জন্য এই রক্ত জল করা পরিশ্রম করলে, তখন কী মনে হয়? তখন কি মনে হয় না, তোমার সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তোমার জেলার বা উপজেলার মানুষ? তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আপদ-বিপদ, উন্নতি-অবনতি- এগুলো নিয়েই তো একজন প্রশাসকের জীবন। তোমাকে সরকার তোমার দায়িত্বাধীন এলাকার শীর্ষপদে পদায়িত করেছে। একটু ভেবে দেখো, তোমার ওপর কতটুকু আস্থা স্থাপন করেছে সরকার, রাষ্ট্র। সঙ্গে সঙ্গে জনগণের কত প্রত্যাশা তোমার কাছে। এটা নতুন কিছু নয়। ইসলামের প্রথম যুগে, এমনকি তারও আগে, ইউরোপে, ভারতবর্ষে বা মিসরে যখনই কোথাও কোনো আঞ্চলিক শাসনকর্তাকে প্রেরণ করা হতো, তখন তাঁর আনুগত্য, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার ওপর প্রেরণকারীর আস্থা ও বিশ্বাস যেমন থাকত অগাধ, তাঁর কাছে সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের প্রত্যাশাও থাকত তেমনি সীমাহীন। সেই শাসনকর্তা ছিলেন সার্বভৌম শাসক বা নরপতির প্রতিনিধি ও তাঁকে প্রদত্ত সব ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী। তিনি সার্বভৌম শাসকের ফরমান বা আইনি ক্ষমতাবলে নিজ এলাকায় ছিলেন সর্বেসর্বা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
ব্রিটিশ আমল থেকে এই ভূখণ্ডে সাধারণ মানুষ তাঁকে 'মাই-বাপ' বলে জানে। (এক প্রজাপীড়ক অত্যাচারী প্রশাসককে নাকি তার এলাকার লোকেরা বলেছিল, হুজুর, আপনি আমাদের মাই-বাপ, আমরা তো কুত্তার বাচ্চা। আপনি যা হুকুম করবেন তা-ই মাথা পেতে নেব।) যা হোক, মানুষের এই যে অকুণ্ঠ নির্ভরতা, এই প্রত্যয়, নিরাপত্তালাভের এই যে নিশ্চিত বিশ্বাস, এর মর্যাদা দিতে না জানলে প্রশাসকের আসনে বসাই উচিত নয়। এসব কথা তোমরা সবাই জানো। চাকরিতে যোগদান করার পর হাজার বার হাজার কণ্ঠে এসব কথা তোমরা শুনেছো। এবং বস্তুতপক্ষে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তোমরা তোমাদের এলাকার সাধারণ-অসাধারণ, ধনী-গরিব সব শ্রেণীর মানুষের ডাকে সাড়া দিচ্ছো, নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছো তাদের কল্যাণের জন্য। ঠিক কি না? আর করবে নাই বা কেন? এটাই তো তোমাদের কাজ। আমাদের চাকরির শুরুতে ট্রেনিং পিরিয়ডের সময় লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে আমাদের সিনিয়র একজন বিখ্যাত সিভিল সার্ভেন্ট (সিএসপি) ড. তারিক সিদ্দিকী আমাদের ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। ক্লাস কামাই করলে কিংবা অন্য কোনোভাবে কাজে ফাঁকি দিলে 'হার্ড টাস্কমাস্টার' ড. সিদ্দিকী খুব রেগে যেতেন। একদিন রেগে গিয়ে পুরো ক্লাসকে তিনি শুনিয়ে দিলেন, জেন্টেলমেন, রিমেম্বার, ইউ আর পেইড ফর দিস। অর্থাৎ, বক্তৃতার কচকচানি শুনতে ভালো লাগে না, তাই ক্লাসে আসতে চাও না, কিন্তু মিয়ারা মনে রেখো, এই ক্লাসে আসার জন্য তোমরা বেতন পাচ্ছো। (অতএব, বেতনের পয়সাটা হালাল করে খাও)।
তাহলে জানতে পারি কি, কেন সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা, এমনকি রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত রামুর বৌদ্ধমন্দিরগুলোর ওপর আক্রমণ হানার জন্য যখন পাঁয়তারা চলছে, উসকানিমূলক মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-বক্তৃতা হচ্ছে, ভালো-মন্দ, ধনী-গরিব, এমনকি সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতকারী নির্বিশেষে 'জগতের সকল মানুষ সুখী হোক' বলে যে মানুষগুলো অহোরাত্র গৌতম বুদ্ধের শরণ প্রার্থনা করছে, সেই অতি নিরীহ, শান্ত-ভদ্র, 'অহিংসা পরম ধর্ম'- এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত নগণ্যসংখ্যক মানুষের যখন প্রাণসংহারের শঙ্কা দেখা দিল, তখন কঙ্বাজারের ডিসি তুমি, রামুর ইউএনও তুমি কেন 'খবরদার-খবরদার-খবরদার হো' বলে লোক-লশকর নিয়ে তোমাদের পুলিশ বাহিনী প্রধানসহ ছুটে গেলে না? কেন প্রয়োজনবোধে আরো ফোর্স চেয়ে পাঠালে না? পৃথিবীর সব বৌদ্ধ তো আর আরাকানের রামদা-লাঠি-বল্লমে সজ্জিত মুসলমান নিধনকারী উন্মাদ বৌদ্ধ নয়। এই ক্ষমাহীন নির্লিপ্ততার কী জবাব দেবে তোমরা?
তোমাদের র্যাব লিমনকে গুলি মারতে পারে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে তোমাদের পুলিশ। আর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি পুড়িয়ে যারা ছাই করল, লুণ্ঠন করল অসংখ্য অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বিশ্বের দরবারে অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে মুসলমানপ্রধান দেশ এক অপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে, সেই দেশের মুখে চিরদিনের জন্য যে দুর্বৃত্তরা লেপন করল কলঙ্ককালিমা, তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করল না তারা। তোমরা কেউ সেদিন ছুটে গেলে না তোমার বৌদ্ধ ভাইবোনের পাশে, বললে না : ভয় নেই ভাই, ভয় নেই বোন, আমি যতক্ষণ এই জেলার ডিসি আছি, ততক্ষণ কোনো মায়ের পুত তোমাদের বা তোমাদের মন্দিরের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সব কয়টাকে ঠেঙ্গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেব। পারলে না বলতে? তোমরা কি ভয় পেয়েছিলে? না কি তোমাদের কাছে ডিসি মানে শুধু 'মাননীয় জেলা প্রশাসক', শুধু ফুলের মালা এবং তৈলমর্দন গ্রহণ ও প্রদান? তোমরা কি অপেক্ষায় ছিলে মন্ত্রী সাহেব বা এমপি সাহেবের নির্দেশের? তা-ই যদি হয় তাহলে কিছু মনে করো না, প্রতি মাসে তোমাদের বেতনের একটা বড় অংশ তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। (আশা করি পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এখনো আসেনি। তবে বলা যায় না, যা দেখছি চারপাশে...।)
হায়, আমাদের জনসাধারণ আপদে-বিপদে তাহলে আর কার কাছে যাবে? নিরপেক্ষতার, সাহসিকতার, তেজস্বিতার ঐতিহ্যবাহী ডিসি নামক সেই অতি মর্যাদাশীল ইনস্টিটিউশনটির এ কী করুণ পরিণতি! এ কী ক্লীবত্ব তার! লোকে চিরকাল জেনে-বুঝেই যাকে 'হুজুর মাই-বাপ' (ডিসি-রা কি উভয়লিঙ্গ? আমাকে যখন কেউ মাই-বাপ বলত, আমি বলতাম, ভাই, একটা ডাকুন, হয় মাই, না হলে বাপ, একসঙ্গে দুটো বলে অযথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।) বলে এসেছে, তাদের সেই পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল কি তাহলে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? তোমার বস্ এমপি সাহেব (বাই দ্য ওয়ে, জনান্তিকে বলে রাখি, ইনি কোনোকালেই কিন্তু আমাদের বস্ ছিলেন না।), বড় বস্ মন্ত্রী সাহেব (তোমার 'দুর্ভাগ্যক্রমে' তোমার এলাকা থেকে যদি কেউ মন্ত্রী বা পাতিমন্ত্রী হয়ে থাকেন), বিরোধী সাহেবরা ... এরা সবাই তো আছেন যাঁর যাঁর তালে। প্রথম দুজন তো তেল ছাড়া কিছু বোঝেন না। তাঁদের মুখের লব্জ হচ্ছে : 'রাখেন আপনার আইন। এই এলাকায় আমি যা বলব সেটাই আইন।' এখানেই আমার 'দুইখান কথা আছে।' এ ধরনের পরিস্থিতিতে তোমাকে অত্যন্ত পলাইটলি বাট ফার্মলি, খুবই বিনীতভাবে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে, না বলতে পারতে হবে। তুমি বলবে, তাহলে তো স্যার, পরদিনই মনপুরা না হয় খাগড়াছড়িতে বদলি। আর এর চেয়েও খারাপ ... ওএসডি হয়ে প্রশাসনের দেবদাস সেজে সচিবালয়ের বারান্দায় বারান্দায় 'ম্যাঁয় আওয়ারা হুঁ ...' গাইতে হবে বাকি জীবন। হলে হবে। তাই বলে কি তোমার সারা জীবন অতিকষ্টে লালিত স্ফটিকশুভ্র বিবেকটিকে জবাই করবে নাকি? আর শোনো, ইজ্জত এবং জিল্লতির মালিক আল্লাহ : 'ও তুইয্যু মানতাশাউ ও তুযিল্লু মানতাশাউ বিয়াদিকাল খাইর। ইন্নাকা আ'লা কুলি্লশ্ শাইইন কাদির।' (আল কোরআন : সুরা আলে ইমরান, আয়াত ২৬। বাংলা অনুবাদ : যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মান দাও, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করো। তোমার হাতেই কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সব ব্যাপারে সর্বক্ষমতার অধিকারী।) তিনি (আল্লাহ রাব্বুল আলামিন) যা করেন তাঁর বান্দার কল্যাণের জন্যই করেন। এই বিশ্বাসটাকে বুকের ভেতর অনির্বাণ শিখার মতো জ্বালিয়ে রাখো না কেন, দেখবে, অন্যায়কারীর, ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর সব আস্ফালন তুচ্ছ মনে হচ্ছে তোমার কাছে। আর সেই জনপ্রিয় গানটির কথাগুলোই বা স্মরণ করো না কেন : এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে/এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরও কাছে। সব সময় মনে বিশ্বাস রাখবে, যেভাবে চলছে সেভাবে চিরদিন চলবে না, চলতে পারে না। চললে পরে সুশাসন, সুবিচার তো দূরের কথা, পুরো জাতিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিছু মনে করো না, উপদেশের 'ডোজ' হয়তো 'ওভারডোজ' হয়ে যাচ্ছে। তবু রোগের লক্ষণ বুঝে ডাক্তারদের কখনো কখনো ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিতে দেখেছি। মানসিক প্রশান্তিলাভের জন্য একটি কথা তোমাদের ভেবে দেখতে বলি। আজকাল ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, কারণে-অকারণে যেখানে মানুষের জীবন সমানে বাজে খরচ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে তুমি-আমি যে এখনো এই পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করছি, সেটা কি কম বড় নিয়ামত? একাত্তরে আমাদেরই কিছু কিছু বিরল মেধার অধিকারী সহকর্মী কি খানসেনাদের হাতে প্রাণ দেননি? ওটা তো সেদিন তুমিও হতে পারতে, আমিও হতে পারতাম। কাজেই বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে চলবে, নোয়াবে না। 'যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে' : (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। (আগে আমি আমার কনিষ্ঠ সহকর্মীদের বলতাম, বাঘের বাচ্চার মতো চলবে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ডার্টি জোকটা শোনার পর থেকে আর বলি না। এখন বলি : 'হিম্মত না হার, প্রভুকো পুকার/ওহি তেরি নাইয়া লাগায়েঙ্গে পার।' পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকের একটি হিন্দি ছায়াছবির গান, ছবির নাম 'পান্না'।)
ইস্, বৌদ্ধমন্দির আক্রমণ যদি তোমরা ঠেকাতে পারতে তাহলে, ডিসি সাহেব-ইউএনও সাহেব এক মন্দিরের কারণে কত লাখ মানুষের মনোমন্দিরে যে তোমরা চিরস্থায়ী ঠাঁই করে নিতে পারতে! আর যদি ঠেকাতে নাও পারতে, তবু তোমাদের প্রচেষ্টার জন্য লোকে বলত, আমাদের ডিসি সাহেব বেচারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে; কিন্তু কী করব, আমাদের কপাল মন্দ। তোমরা এখন হয়েছো খলনায়ক, অথচ ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার কী অপূর্ব সুযোগটা তোমরা হারালে।
আমি জানি, একদিন বৌদ্ধরা 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি' বলে ২৯ সেপ্টেম্বরের ('ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর!) কালো রাত্রির নির্মম তাণ্ডবলীলা ভুলে গিয়ে প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বই জন সৎ লোক, অসাম্প্রদায়িক লোক তাদের পাশে থেকে শক্তি-সাহস জুগিয়ে চলেছে, চলবে।
কিন্তু তার পরও একটি কথা থেকে যায়। যে আঘাত আমার শরীরে করা হয়, তাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় আমার শরীর। আঘাতকারী তা দেখে হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, নেচে ওঠে পৈশাচিক উল্লাসে। আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট আনন তাকে দেয় নারকীয় আনন্দ। রক্ত ঝরে ঝরে আমার সারা শরীরে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত। তারপর একদিন সেরে ওঠে সে ক্ষত। আমি আবার সুস্থ-সবল হয়ে উঠে দাঁড়াই ধরণীর বুকে।
কিন্তু যে আঘাত লাগে আমার মনে, আমার সমগ্র সত্তায়, মননে- সেটা কি সেরে ওঠে কোনো দিন? না, সারে না, নিরালোকের সে আঘাত শুকায় না, শুকাতে পারে না।
ঘা শুকায়, শুকায় না আঘাত। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বৌদ্ধদেরও ক্ষত হয়তো শুকাবে, আঘাত শুকাবে না।
০৫.১১.১২
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
No comments