গভীর সমুদ্রে প্রাণ গেল ৮২ জনের-আর কত দিন এমন জীবন দেওয়া!

আবারও নির্মমভাবে সমুদ্রে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হলো ৮২ জন ভাগ্যান্বেষী মানুষ, যারা দালালদের খপ্পরে পড়ে কর্মসংস্থানের আশায় পাড়ি দিয়েছিল মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ১০টায় টেকনাফের সমুদ্র উপকূল থেকে ১১০ জন ভাগ্যান্বেষী যাত্রীকে বোঝাই করে যে ট্রলারটি মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করেছিল, তার ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ৪০ জনের।


হতভাগ্য যাত্রীদের হৈচৈ ও প্রতিবাদ শোনেনি দালালচক্র। প্রায় ডুবুডুবু অবস্থায় মহেশখালিয়াপাড়া সৈকত থেকে ট্রলারটি যাত্রা করে এক মাইল দূরে গভীর সাগরের সাতবাইন নামক স্থানে গিয়ে উল্টে যায়। মাত্র ২৮ জন ছাড়া আর সবাই গভীর সমুদ্রে নিখোঁজ হয়েছে। এ মানুষগুলোর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে দালালরা অবৈধ পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। নিঃসন্দেহে এই মানুষগুলোর মৃত্যুর জন্য দায়ী ওই দালালচক্র, যারা হয়তো বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।
মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের সাগরে সলিল সমাধির ঘটনা এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বেশ কয়েকবার এভাবে জীবন দিতে হয়েছে হতভাগ্য ভাগ্যান্বেষীদের। এই মানুষগুলো কতটা অসহায় এবং তথ্যবঞ্চিত তা অনুমেয়। সরকার মালয়েশিয়ায়ই বৈধ পথে জনশক্তি পাঠাতে ৪০ হাজার টাকাও লাগবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে বারবার জনগণকে সতর্কও করা হয়েছে। কিন্তু এই মানুষগুলো রয়ে গেছে অনেকটাই অন্ধকারে। তারা এ কথাও জানে না, মালয়েশিয়ায় ভাগ্যক্রমে পৌঁছানো গেলেও বৈধ কাগজপত্রের অভাবে তাদের জন্য যে বিপদ অপেক্ষা করছে তা-ও তাদের ভয়ানক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন করে তুলতে পারে।
মানুষের জীবন কি গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির মতো যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পরও দায়িত্ব পালনকারী কারো কোনো বিকার লক্ষ করা যাবে না? কখনো আফ্রিকার জঙ্গলে, কখনো ভূমধ্যসাগরে, কখনো রাশিয়ার বরফের মাঝে প্রচণ্ড কষ্টে থেকে প্রাণ হারাচ্ছে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া বাংলাদেশিরা। দিনের পর দিন এক শ্রেণীর দালাল মিথ্যা কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়ে নিরীহ কর্মসংস্থান-প্রত্যাশী নারী-পুরুষকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ পরিণতির দিকে; মৃত্যুও ঘটছে অনেকের। কিন্তু জীবন হরণকারী দালালরা থেকে যাচ্ছে অধরা। লক্ষ করা গেছে, এ ধরনের শত শত অপরাধীর কাউকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি কোনো সরকার। ফলে এ ধরনের দালালদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আমরা চাই, মানুষের জীবনের ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করে নিছক ব্যক্তিস্বার্থে ও অর্থলিপ্সা চরিতার্থ করতে যারা এ অপরাধ করে যাচ্ছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, যাতে এ ধরনের কাজ থেকে অন্যরাও বিরত থাকে। সেই সঙ্গে দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হোক, যাতে এসব অবৈধ দালালের কথা বিশ্বাস করে মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন না করে। উপকূলসহ দেশের সীমান্ত অঞ্চলে নজরদারি বৃদ্ধি করাও জরুরি। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ লোক প্রেরণ করতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কিছু লোক সহযোগিতা করে থাকে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। তাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করাও সরকারের একটি অপরিহার্য কাজ। সরকারকে এখনই সতর্ক হতে হবে, আর এমন নির্মম মৃত্যুর একটি ঘটনাও যেন না ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.