ওবামার বিজয় এবং অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন by তারেক শামসুর রেহমান
শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। এটা নিয়ে কম আশঙ্কা ছিল না। জনমত জরিপগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ছিল। তবে ৫ নভেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের এক দিন আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট যে জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল (ওবামার পক্ষে ৫০ ভাগ ভোট, আর রমনির পক্ষে ৪৭ ভাগ ভোট) সেটাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো।
তথাকথিত 'সুইং স্টেট'গুলোর ফলাফলও বারাক ওবামার পক্ষে গেল। আগামী ২০ জানুয়ারি (২০১৩) তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওবামার এই বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কী কোনো নতুন 'বার্তা' বয়ে আনবে? অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিশাল বেকারত্ব, রেকর্ড অতিক্রম করা ঋণ (১৬ ট্রিলিয়ন ডলার), সরকারের অনধিকার চর্চায় অচলপ্রায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাত, সেই সঙ্গে বৈদেশিক নীতিতে ওবামা কী আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবেন? সামনের দিনগুলো ওবামার জন্য যে সুখের হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা সত্য, গেল মাসে এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ চাকরি পেয়েছেন। যেখানে জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি চারজন একটি চাকরির পেছনে দৌড়াচ্ছেন, সেখানে নতুন করে প্রায় দুই লাখ লোকের চাকরি পাওয়া কম কথা নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ থেকে উপকৃত হয়েছে। বারাক ওবামার টার্গেটই ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আর্থিক খাতকে এখন একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা বিখ্যাত কায়রো ভাষণে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'নতুন এক সম্পর্ক' গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উৎখাত করতে গিয়ে জঙ্গিবাদেরই জন্ম হয়েছে সেখানে। লিবিয়া থেকে সিরিয়া- সব জায়গায়ই আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। ওবামার 'আরব বসন্ত' নীতির এটা একটা বড় ব্যর্থতা। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কিংবা লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর সেখানে ইসলামী কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আসাদকে উৎখাত করতে গিয়ে দেখা গেল অস্ত্র চলে গেছে জঙ্গিদের হাতে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 'আরব বসন্ত' তিউনেশিয়া, ইয়েমেন, মিসরে পরিবর্তন ডেকে আনলেও সেখানে কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সমস্যার কোনো সমাধান তিনি বের করতে পারেননি। তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ওবামার পাশাপাশি রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির বক্তব্য এসব ইস্যুতে স্পষ্ট ছিল না। তাঁর অর্থনৈতিক তথা বৈদেশিক নীতি মানুষকে টানতে পারেনি। বরং গর্ভপাতের বিরোধিতা করা, অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া এবং সমকামীদের বিয়ের বিরোধিতা করায় তিনি হিসপানিক ও অভিবাসী আমেরিকানদের ভোট পাননি। তবে রমনি তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছিলেন। ওবামার বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করলেও তিনি নিজে কোনো সুস্পষ্ট নীতি উপস্থাপন করতে পারেননি। বরং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠতা আরব বিশ্বে তাঁর অবস্থানকে অনেক দুর্বল করেছিল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে ১৫টি পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে, যেখানে ওবামা ও রমনির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। নীরব ছিলেন। এ সবের মধ্যে রয়েছে মৃত্যুদণ্ড রদ প্রসঙ্গ, ৫১১৩টি পারমাণবিক ওয়্যারহেডের ভবিষ্যৎ, গুয়ানতানামো বের বন্দি শিবিরের ভবিষ্যৎ ও এই বন্দি শিবিরে নির্যাতনকারীদের বিচার, বাড়ি ব্যবসায় ধসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়ায় ড্রোন বিমান আক্রমণের ভবিষ্যৎ, নূ্যনতম বেতন ১০ ডলারে উন্নীত করা (প্রতি ঘণ্টায় বর্তমানে ৭.২৫ ডলার), ইরানে সম্ভাব্য বিমান আক্রমণের ব্যাপারে অসম্মতি, নির্বাচনী প্রচারণায় যে বিপুল অর্থ দাতাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয় (চাঁদা) তা প্রত্যাখ্যান করা, জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণতা হ্রাসে একটি কমিটমেন্ট, সবার জন্য চাকরির নিশ্চয়তা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুলি্লর ভবিষ্যৎ, লাদেনকে কেন ধরে এনে কোর্টে বিচার করা হলো না ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো সাধারণের মধ্যে আলোচিত হলেও কোনো একটি ইস্যুতেও ওবামা ও রমনির কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। উভয়ই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। অথচ একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে মানুষ এসব বিষয়ে শুনতে চেয়েছিল। তিনটি বিতর্কের একটিতেও তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি।
ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক তথা অভিবাসী আমেরিকানদের ভোট পেয়েছিলেন। এবারও পেলেন। মহিলাদের ভোটও এবার পেলেন। অন্যদিকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রমনি ধনিক শ্রেণীর ভোট পেয়েছেন বটে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের টানতে পারেননি। তাঁর অর্থনৈতিক নীতিতে মানুষ আস্থা রাখতে পারেনি। রমনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ধনী। ধনিক শ্রেণীকেই তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। নির্বাচন শেষ হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। ওবামার জন্য অর্থনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বারবার বলেছেন, চার বছর আগে যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তিনি, তা শেষ করতে আরো চার বছর সময় তাঁর প্রয়োজন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে বটে। কিন্তু অর্থনীতিকে বাগে আনার কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ধনী ও গরিব শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই সেখানে 'আকুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্ম দিয়েছে- যা ইতিমধ্যে প্রায় ৪২০ দিন অতিক্রম করেছে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনার এক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে ওবামাকে। কাজটি সহজ নয়। পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছেন জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১২ সালে এসে তারা ভোগ করেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯.৭ ভাগ গ্রহণ করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। জোসেফ স্ট্রিগলিৎজের মতে শীর্ষে থাকা ওই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Cosino Capitalism। অর্থাৎ জুয়ানির্ভর এক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের অপর পিঠে রয়েছে অন্ধকার এক চিত্র। ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ এক কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরো দেখা যায়। এসব পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। যে সমাজে শতকরা ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ 'ফুড স্ট্যাম্প' (খাদ্য সাহায্য)-এর ওপর নির্ভরশীল, সেই সমাজেই একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল, যেখানে মূল দুজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করেছেন ৬০০ কোটি (কারো কারো মতে ১০০০ কোটি) ডলার। ওবামা বা রমনি আবার নিজের অর্জিত আয় থেকে এই অর্থ ব্যয় করেননি। তাঁরা প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। বড় বড় ব্যবসায়ী তথা করপোরেট হাউসগুলো তাঁদের চাঁদা দেয়। এটা বৈধ। ওই চাঁদার টাকায় তাঁরা নির্বাচন করেন। নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে পারেন না বিধায় তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন না। এবারও প্রায় ২৫ জন তথাকথিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউই থাকতে পারেননি। তাঁদের নামও কেউ জানে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটা সমতা ফিরিয়ে আনা, সবার জন্য চাকরি ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বারাক ওবামার জন্য। মানুষ ওবামার ওপর আস্থা রেখেছে এটা সত্য, কিন্তু সেই আস্থার প্রতি কতটুকু সম্মান তিনি দেখাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ওবামার বিজয় অবশ্য একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে আর সেটি হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বিমান হামলার সম্ভাবনা সীমিত হওয়া। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে সংকট, ওবামা তার সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার ওপরই গুরুত্ব দেবেন। রমনি বিজয়ী হলে হামলার সম্ভাবনা বাড়ত। তবে ওবামার জন্য মধ্যপ্রাচ্য হবে একটি 'টেস্ট কেস'। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন কোনো দেশ থেকেই সুবাতাস আসছে না। 'আরব বসন্ত' সেখানে সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন এক সংকটের- জঙ্গিবাদের উত্থান। আত্মঘাতী বোমাবাজি সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। ওবামার বৈদেশিক নীতির এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে পুরনো প্রেসিডেন্টকে নতুনভাবে পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু অর্থনীতির মন্দাভাব তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, বৈদেশিক নীতিতে 'সফলতা' পাবেন কি না, বিশ্বে একটি স্থিতিশীলতা তিনি উপহার দিতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক তথা অভিবাসী আমেরিকানদের ভোট পেয়েছিলেন। এবারও পেলেন। মহিলাদের ভোটও এবার পেলেন। অন্যদিকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রমনি ধনিক শ্রেণীর ভোট পেয়েছেন বটে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের টানতে পারেননি। তাঁর অর্থনৈতিক নীতিতে মানুষ আস্থা রাখতে পারেনি। রমনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ধনী। ধনিক শ্রেণীকেই তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। নির্বাচন শেষ হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। ওবামার জন্য অর্থনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বারবার বলেছেন, চার বছর আগে যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তিনি, তা শেষ করতে আরো চার বছর সময় তাঁর প্রয়োজন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে বটে। কিন্তু অর্থনীতিকে বাগে আনার কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ধনী ও গরিব শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই সেখানে 'আকুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্ম দিয়েছে- যা ইতিমধ্যে প্রায় ৪২০ দিন অতিক্রম করেছে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনার এক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে ওবামাকে। কাজটি সহজ নয়। পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছেন জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১২ সালে এসে তারা ভোগ করেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯.৭ ভাগ গ্রহণ করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। জোসেফ স্ট্রিগলিৎজের মতে শীর্ষে থাকা ওই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Cosino Capitalism। অর্থাৎ জুয়ানির্ভর এক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের অপর পিঠে রয়েছে অন্ধকার এক চিত্র। ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ এক কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরো দেখা যায়। এসব পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে না। বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। যে সমাজে শতকরা ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ 'ফুড স্ট্যাম্প' (খাদ্য সাহায্য)-এর ওপর নির্ভরশীল, সেই সমাজেই একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল, যেখানে মূল দুজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করেছেন ৬০০ কোটি (কারো কারো মতে ১০০০ কোটি) ডলার। ওবামা বা রমনি আবার নিজের অর্জিত আয় থেকে এই অর্থ ব্যয় করেননি। তাঁরা প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। বড় বড় ব্যবসায়ী তথা করপোরেট হাউসগুলো তাঁদের চাঁদা দেয়। এটা বৈধ। ওই চাঁদার টাকায় তাঁরা নির্বাচন করেন। নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে পারেন না বিধায় তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন না। এবারও প্রায় ২৫ জন তথাকথিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউই থাকতে পারেননি। তাঁদের নামও কেউ জানে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটা সমতা ফিরিয়ে আনা, সবার জন্য চাকরি ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বারাক ওবামার জন্য। মানুষ ওবামার ওপর আস্থা রেখেছে এটা সত্য, কিন্তু সেই আস্থার প্রতি কতটুকু সম্মান তিনি দেখাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ওবামার বিজয় অবশ্য একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে আর সেটি হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বিমান হামলার সম্ভাবনা সীমিত হওয়া। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে সংকট, ওবামা তার সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার ওপরই গুরুত্ব দেবেন। রমনি বিজয়ী হলে হামলার সম্ভাবনা বাড়ত। তবে ওবামার জন্য মধ্যপ্রাচ্য হবে একটি 'টেস্ট কেস'। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন কোনো দেশ থেকেই সুবাতাস আসছে না। 'আরব বসন্ত' সেখানে সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন এক সংকটের- জঙ্গিবাদের উত্থান। আত্মঘাতী বোমাবাজি সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। ওবামার বৈদেশিক নীতির এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে পুরনো প্রেসিডেন্টকে নতুনভাবে পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু অর্থনীতির মন্দাভাব তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, বৈদেশিক নীতিতে 'সফলতা' পাবেন কি না, বিশ্বে একটি স্থিতিশীলতা তিনি উপহার দিতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments