আন্তর্জাতিক-ওবামা আমেরিকাকে পাল্টে দিলেন by পিটার ফস্টার

পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে চার বছর আগে ওবামা প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই পরিবর্তন কিন্তু এলো, তবে চার বছর পর। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রমনিকে হারিয়ে নারী, সংখ্যালঘু ও তরুণ-তরুণীদের প্রগতিশীল জোটের নেতা হিসেবে ওবামার বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনটি সম্পন্ন হলো।


যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবয়বের এই যুগান্তকারী পরিবর্তনকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ওবামার ওপরই বর্তেছে। বস্তুত আমেরিকা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ওবামা কতটি ইলেক্টোরাল ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হলেন অথবা ২ শতাংশেরও কম পপুলার ভোট পেয়ে তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে এই পরিবর্তনকে ধরা যাবে না। ঘাটতি নিয়ে কী করা হবে, অভিবাসন বা শিক্ষার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কী করা হবে তার চেয়েও বড় কথা, এবারের নির্বাচনী ফলাফল দৃষ্টে মনে হয় মুক্তমনা-উদার জোট মার্কিন রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
সারাদেশের ভোটের ধরন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিরাট দেশটির শহর এবং উপকূলীয় এলাকার বাইরে শহরতলি ও গ্রাম এখনও রক্ষণশীলদের পক্ষে। রমনির পরাজয়ে তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ওবামা যদিও তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে চেষ্টা করেছেন, তবুও তারা তাদের রাগ পুষে রাখবেন। ওবামা বক্তৃতায় নতুন ভিশনের কথা বলতে গিয়ে পরাজিতের রাজনৈতিক ভিশনকেই তুচ্ছ করে দেখিয়েছেন। ওবামা তার বক্তব্যে সাধারণ, কঠিন পরিশ্রমী, খোদা ভীরু আমেরিকানদের মনোতুষ্টির জন্য একটি বাক্যও বলেননি। শ্বেতাঙ্গদের অনেকেই এখনও শহরতলি ও গ্রামে বাস করেন। তবে অন্য বর্ণের জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছেন তারা। এখন বাস্তবতা হলো, হিস্পানিক ভোটাররা নির্বাচকমণ্ডলীর ১০ শতাংশের বেশি। ওবামা তাদের ভোটের ৭০ শতাংশ পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট কৃষ্ণাঙ্গ ভোটের ৯৩ শতাংশ লাভ করেন। আর এশীয় ভোটারদের ভোট পান তিনি ৭০ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে ১২ শতাংশ বেশি ভোট পান রমনির চেয়ে ওবামা।
তরুণ ভোটারদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে তাদের ভোটের দুই-তৃতীয়াংশই গেছে ওবামার ঝুলিতে। তারা মোট ভোটারের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গত বছরই প্রথম এখানকার নবজাতকদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ পিতা-মাতার চেয়ে অশ্বেতাঙ্গ পিতা-মাতার সন্তানের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। এই প্রবণতাই দেখিয়ে দেয় রিপাবলিকানরা আর হিস্পানিক ভোটারদের অগ্রাহ্য করে তাদের নীতি-কর্মসূচি নিলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এবারের ভোটেও সেটা প্রমাণ হয়েছে। অভিবাসনবিরোধী অবস্থান গ্রহণের কারণে তাদের মধ্যে রিপাবলিকানদের সমর্থন একবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই পরিবর্তনের প্রভাবটা টের পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য ভার্জিনিয়াতে ওবামার দু'বারই ভালো ফল করা থেকে। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ও ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপকভাবে ভোট প্রদানের প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, এক সময়ের রিপাবলিকান রাজ্যে পরিবর্তনটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এটা আমেরিকার রাজনৈতিক চেহারাকে পাল্টে দিচ্ছে। ওবামার জোট ভবিষ্যৎ এক নতুন আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করছে। তরুণ, অপেক্ষাকৃত তামাটে চেহারার, ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে মাথা ঘামানো এক উদার আমেরিকা আমাদের সামনে উঠে আসছে।
মঙ্গলবার রিপাবলিকানের পরাজয় নতুন ইলেক্টোরাল বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচণ্ড জোয়ার সৃষ্টি হলেও তারা আর কখনোই সর্বর্োচ্চ ২৯২ আসনের বেশি ইলেক্টোরাল ভোট জিততে পারবেন না। যত সময় গড়িয়ে যেতে থাকবে রিপাবলিকান পার্টির ইলেক্টোরাল ভোটের সর্বোচ্চ সংখ্যা আরও কমতে থাকবে। এটা নিশ্চয়ই তাদের পার্টির ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কাজনক। শুধু জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তার ওপর আরও অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে, যেগুলো রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। পর্যালোচনায় গেলে রিপাবলিকানরা দেখতে পাবেন যে, রিগান আমলে যে রাজস্ব সংক্রান্ত রক্ষণশীল ও সুসমাচার মতবাদে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের মধ্যে যে জোট গড়ে উঠেছিল, সেটা হালে পানি পাচ্ছে না। তাদের এখন ভোটযুদ্ধে জিততে হলে কর্মসূচিকে আরও মডারেট করতে হবে। টেক্সাস, ফ্লোরিডা ও আরিজোনার মতো রাজ্যে লাতিনো জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে। না হয় এসব রাজ্য থেকে তারা মুছে যাবে। এভাবে সংখ্যালঘুরা গণহারে একটি দলকে বয়স, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে ভোট দিয়ে যাবে আর অন্য দল সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবে, শুধু তা কি হয়! আমেরিকার অর্ধেক মানুষ যখন মনে করছে যে, সমকামীদেরও অন্যদের মতো বিয়েসহ সব বিষয়ে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এবার সমকামী টমি বালডউইনকে উইসকনসিনের সিনেটর পদে নির্বাচিত করেছে, তখন এ বিষয়েও রিপাবলিকানদের মুখ ঘুরিয়ে থাকায় লাভ হবে না।
ওবামা এবার অবিবাহিত মায়েদের অনেক ভোট পেয়েছেন। তাদের বিষয়েও রিপাবলিকান পার্টি পুরনো ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে থেকে লাভ পাবে না। আসলে রিপাবলিকান পার্টিকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে উলি্লখিত বিষয়গুলোসহ আরও অনেক বিষয়ে তাদের নীতি ও কর্মকৌশল পরিবর্তন করতেই হবে।
অভিবাসন বিষয় দিয়েই রিপাবলিকান পার্টি তাদের নীতি পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এখন আগের মতো ট্যালেন্টরা অনেক বেশি হারে আমেরিকা আসছে না। এসব ট্যালেন্ট চীন, ভারত, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের নতুন আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে পুরনো নীতি আঁকড়ে থাকার অর্থ দেশেরও ক্ষতি করা।
এ বিষয়ে পরিবর্তন যে দরকার তা মুখে মুখে অনেকেই স্বীকার করেন। কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এই অভিবাসন নীতি সংস্কারের বিষয়টি কংগ্রেসে দুই বছর ধরে ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ওবামার বিজয়। ওবামা যেসব বিষয়ে সংস্কার সাধন করতে চান রিপাবলিকানরা সেসব বিষয়ে ছাড় দেবেন, নাকি আগের মতোই অচলাবস্থা সৃষ্টি করে পরিবর্তনকে আটকাতে চেষ্টা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে রিপার্বিলকানদের দেশ এবং নিজেদের স্বার্থেই সমঝোতার রাস্তায় আসা উচিত।

পিটার ফস্টার :যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত টেলিগ্রাফের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সম্পাদক
টেলিগ্রাফ থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.