হতাশ পদ্মাপারের মানুষ by প্রদ্যুৎ কুমার সরকার

দেশের উন্নয়নে পদ্মা সেতু করতে বহু প্রত্যাশা নিয়ে ভিটামাটি, এমনকি বাপ-দাদার কবরের জমি পর্যন্ত দিয়েছিল দুই পারের তিন জেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার। সেই স্বপ্নের সেতুর কাজে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় চরম হতাশা নেমে এসেছে পদ্মাতীরবর্তী এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে।


বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক নির্বাচনী অন্যতম এই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভুক্তভোগী জনগণ সরকারের পাশাপাশি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে বিশ্বব্যাংককে। তাদের মনে এখন চরম বিরক্তি, ক্ষোভ আর ঘৃণা। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তাই নতুন হিসাব কষছে এসব অঞ্চলের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত সেতু নির্মাণের দাবি উঠেছে সব মহল থেকে।
সেতু কর্তৃপক্ষসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নের আশ্বাসের ভিত্তিতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীর উভয় পারে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চারটি অত্যাধুনিক পুনর্বাসন প্রকল্প নির্মাণ সম্পন্ন করেছে সরকার। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি এসব পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল শেষ হয়। এর মধ্যে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাদারীপুরের শিবচরে ৪৬.৪০ একর জমি এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় ৫০.৪৯ একর জমির পুনর্বাসন প্রকল্প দুটিতে এক হাজার ২২৮টি পরিবার আর ৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ৪২.৩৮ ও ৪৪.৫৬ একর জমির নির্মিত পৃথক দুটি প্রকল্পে ৯২৫টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বসবাসের সুযোগ পাবে।
পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি। মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার পদ্মাপারের ২৬টি মৌজার মোট ৯০২.৫৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শিবচরের দুই হাজার ৬৯২টি, জাজিরার দুই হাজার ৫৩৪টি এবং মাওয়ার দুই হাজার ১৯৩টি পরিবারকে মোট ৫৮৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে। এক হিসাবে জানা গেছে, ৮৬ ভাগ অধিগ্রহণ করা জমির টাকা ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে।
অধিগ্রহণ করা জায়গায় চারটি পুনর্বাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও বাকি জায়গায় ক্ষতিপূরণ নেওয়ার পরও বসবাস করছে সেখানকার লোকজন। সেতু হবে কি হবে না এই দ্বন্দ্বে ভুগছে তারা। অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের আশায় ভাটা পড়ায় হতাশা এখানকার সর্বত্র। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার জোরালো শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ সরকারের পাশাপাশি পাঁচ কোটি মানুষের স্বার্থ না দেখায় বিশ্বব্যাংককেও দুষছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ইমরান হোসেন বলেন, 'আমরা কয়েক হাজার পরিবার দেশের ও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে বাড়িঘর, এমনকি বাপ-দাদার কবরও ছাড়তে প্রস্তুত। আশা ছিল সেতু হলে কলকারখানা হব। এলাকার মানুষ কাজ করমু। কিন্তু এহন জীবনডা থমকাইয়া আছে।'
স্থানীয় বাসিন্দা হালিমা বলেন, 'সরকারের আগের মন্ত্রী আবুল হোসেন এলাকায় আইসা অনেক বড় বড় কথা কইত, ঘোষণা দিত। অথচ এহন আসল কাজ কিছুই হই নাই।'
ফেরিঘাটে আটকা বরিশালের আলীম মিয়া তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এই সরকার নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতুর অঙ্গীকার করায় আমরা দক্ষিণাঞ্চলবাসী একচাপা ভোট দিয়েছি। অথচ পদ্মা সেতুর ব্যাপারে তারা মনোযোগী না।' বাগেরহাটের যাত্রী রীতা বেগম বলেন, 'এই সরকারের প্রায় চার বছর গেল। অথচ এখনো ঘাটে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোগান্তিতে থাকতে হয়। পদ্মা সেতুর জন্য এই সরকারকে ভোট দিয়েছি। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু না করতে পারলে আর ভোট দেব না।'
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মনিরুজ্জামান ও নুরুল ইসলাম বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্তরা টাকা পেয়েছে। চারটি পুনর্বাসন প্রকল্পও শেষ পর্যায়ে। এই সেতুর ওপর কোটি কোটি মানুষ নির্ভরশীল হলেও বিশ্বব্যাংক তার কোনো পাত্তা দিল না। বিশ্বব্যাংকের এমন আচরণে এখন ঘৃণা ধরে গেছে।'

No comments

Powered by Blogger.