হৃদয়নন্দন বনে-বারাক ওবামা :গণমানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে...! by আলী যাকের
অবশেষে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হলেন। এই নির্বাচন নিয়ে বাঙালি কি বাংলাদেশি, আমরা সবাই অল্প-বিস্তর উদ্বিগ্ন ছিলাম। কেন উদ্বিগ্ন ছিলাম? প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য একটি ভয়াবহ বাস্তব! এতটাই বাস্তব যে, সে দেশে যদি হাঁচি দেয়, আমাদের দেশের সর্দি লেগে যায়।
কথাটা যতখানি হালকাভাবে বললাম, আসলে হয়তো তত হালকা নয়। তবুও এই তো বাস্তব যে, আজকে সারাবিশ্বই প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ভালো থাকা, না-থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেবল যে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী দেশ তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পরাক্রম ওই দেশকে ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে প্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইংরেজিতে কথা আছে, জোন অব ইনফ্লুয়েন্স। প্রতি দেশেরই প্রভাবের একটি বলয় থাকে। সেই প্রভাব বিস্তারিত হতে হতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এখন বিশ্বের ভূগোলকের সবটাকেই আবৃত করে ফেলেছে। অতএব এহেন অতি পরাক্রমশালী দেশের রাজনীতি অনালোচিত থাকবে, কী অনাগ্রহের সৃষ্টি করবে, সেটা কি ভাবা যায়?
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনের আবেদন সেই ২০০৮ সালের মতোই ছিল ভিন্নমাত্রার। যদিও আমার কথাটি শুনে হয়তো মনে হবে তা বর্ণবাদ আক্রান্ত। তবুও এ কথা বলতেই হয় যে, ২০০৮ সালের আগে পর্যন্ত আমরা কখনও ভাবতেই পারিনি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সাদা মানুষের দেশে একজন কালো মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। সেই তখন যদিও তার অগ্রাভিযানে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, তবু সবারই মনের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস ছিল যে, এই কালো মানুষটি বোধহয় শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না। কিন্তু তিনি জিতেছিলেন। জিতেছিলেন বিশাল ব্যবধানে জন ম্যাককেইনকে হারিয়ে। যা-ই বলি আর না-ই বলি, আমরা সবাই তো অল্পবিস্তর বর্ণবাদী! অতএব সেই সাদা মানুষের দেশে একজন কালো মানুষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, সেটা আমাদের মতো কালো মানুষকে ভারি আহ্লাদিত করেছিল। আমার তো মনে হয়েছিল যে, আমিই বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলাম!
যা হোক, ওই দেশটির এবারের নির্বাচনের বিষয়ে একটু আলোচনা করার দরকার বলেই আমি মনে করছি। এবারের নির্বাচনে প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী ওবামার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এর নানাবিধ কারণ আছে। ওবামা নিজেই তার প্রথমবারের নির্বাচনী প্রচারে সাধারণ মানুষের মনে আশা-আকাঙ্ক্ষার যে ঢেউ তুলেছিলেন, তা তার নির্বাচনে সহায়ক হয়েছিল বটে কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা তার জন্য খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি বিশ্বময় মন্দার সময় জর্জ বুশের ফেলে রেখে যাওয়া আমেরিকা নামক একটি ভাঙা নৌকার হাল ধরেছিলেন। ফলে ২০০৯-এ এসেই তার সেই বিখ্যাত স্লোগান,Yes, we can... বা হ্যাঁ, আমরা পারি, রূপান্তরিত হয়েছিল, Yes, we perhaps can. অর্থাৎ 'হ্যাঁ, আমরা বোধহয় পারি'তে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, যারা অল্প আয়াসে অধিক মুনাফা অর্জন করার স্বপ্ন দেখেন সর্বদাই, তারা প্রচণ্ড অখুশি হয়েছিলেন। এটি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, যখন ওবামার নীতি হয়ে দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, চাকরিজীবী কিংবা বেকার ও অসহায় মানুষকে আরও বেশি করে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, তাদের আয়কর কমিয়ে দেওয়া, তাদের অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সংস্থানে এগিয়ে আসা। অনেকেই হয়তো জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত শ্বেতাঙ্গরা কখনোই কোনো প্রগতিশীল ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। অতি রক্ষণশীল ডানপন্থি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তো বলতেনই যে, প্রগতিশীল এবং প্রগতিবাদীরা শয়তানের সহচর। এরকম একটি দেশে বারাক ওবামা বোধহয় প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি জনসমক্ষে বলেছেন, Equal opportunity সবার জন্য সমান সুযোগের কথা। এবারের নির্বাচনে জেতার পরও তিনি একই কথা বলেছেন একটু ভিন্ন ভাষায়। বলেছেন, আমেরিকা এমন একটি দেশ যেখানে যে কোনো মানুষ নিজের উপযুক্ততায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। বস্তুতপক্ষে তিনি নিজেই তো তার এমন উক্তির বাস্তব রূপ। অতি রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদে উড়ে এসে জুড়ে বসল এক অশ্বেতাঙ্গ প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ_ এটি কল্পনাও করা যায়নি আজ থেকে দুই দশক আগেও। ওবামার গত চার বছরের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বেকার সমস্যার দ্রুত সমাধান। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, এর পেছনে অনেক কারণ ছিল। যেমন, তার ঠিক পূর্ববর্তী জর্জ ডবি্লউ বুশ যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনীতির অব্যবস্থাপনায় একটি বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। সেটি পূরণ করা সহজ ছিল না। এর ওপর 'বোঝার ওপর শাকের আঁটি' হিসেবে ইরাক, আফগানিস্তান এবং আরও একাধিক জায়গায়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়েছিল, তা বিব্রতজনকভাবে দেশটির দুর্গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ কথাও বারাক ওবামা বলেছেন তার বক্তৃতায় একাধিকবার। চাইলেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেননি। এ কারণে অতি রক্ষণশীল, ডানপন্থি রিপাবলিকান মিট রমনি যখন তার প্রার্থিতা পদ ঘোষণা করলেন, তখন গোটা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকা তার পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এবার ওবামার আর বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হলো না। বস্তুতপক্ষে নির্বাচন-সংক্রান্ত সব জরিপেই তাদের দু'জনের জনপ্রিয়তা খুবই কাছাকাছি দেখা গেছে। বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় জরিপে রমনিকে ওবামার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়ই মনে হয়েছে। মিট রমনি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে প্রায় এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহার সঞ্চার করেছিলেন। ভাবটা ছিল এমন যে, এবারে ওই ব্যাটাকে একহাত দেখে নেওয়া যাবে এবং এটা আসলেই সম্ভব হতো যদি সব শ্বেতাঙ্গ ভোটার (৬০-৭০%) তার বিপক্ষে ভোট দিতেন। সেই ক্ষেত্রে বারাক ওবামা এই নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারতেন না।
অনেকেই মনে মনে এই ধারণা পোষণ করে যে, সব অভিবাসী আমেরিকান এককভাবে ওবামাকে নির্বাচিত করেছে। এটা কখনোই সম্ভব ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যায় অভিবাসীর আনুপাতিক সংখ্যা ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। যদি ধরে নিই এদের সবাই বয়স ব্যতিরেকে সে দেশের ভোটার এবং তারা সবাই ওবামাকে ভোট দিয়েছে, তাহলেও কেবল অভিবাসীর ভোটে ওবামা নির্বাচিত হয়েছেন_ এ কথা ভাবাও বোধহয় হাস্যকর। ঠিক একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকান জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। যদি ধরে নিই যে, অভিবাসী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান সবাই একসঙ্গে মিলে ওবামাকে ভোট দিয়েছেন, তাহলেও ওবামার পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব হতো। এরকম একটি পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এ বছর ওবামা কীভাবে এত বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হলেন? বোধ করি এর জবাব নিহিত আছে ওবামারই বিজয়-বক্তৃতার মাঝে। তিনি বলেছেন, 'এই আমেরিকায় সাদা এবং কালো, লাল অথবা নীল, অভিবাসী অথবা দেশজ, লাতিন কিংবা পীতবর্ণ, সমকামী কিংবা অসমকামী সবাই প্রমাণ করেছে যে, সবার ওপরে তারা আমেরিকান।' ঠিক এই রসায়নটিই ধন্বন্তরির মতো কাজ করেছে সাধারণ মানুষের ধ্বজাবাহী বারাক ওবামার পতাকাকে উড্ডীয়মান রাখতে। এ ধরনের আধুনিক, প্রগতিশীল চিন্তাই অনুপ্রাণিত করেছে আমেরিকার সব শ্রেণীর গণমানুষকে ওবামার নির্বাচনে সহায়তা করতে।
আমার আজকের এই আলোচনা শেষ করা সম্ভব নয় একটি বিষয় উল্লেখ না করে। আমি লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের মধ্যে অনেকেই ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদিতে বারাক ওবামাকে উল্লেখ করেছেন বারাক হোসেন হিসেবে এবং বারাক হোসেনের নির্বাচনী জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন। আমি মনে করি, এহেন দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। বারাক হোসেনের চেয়ে অনেক বড় মাপের মানুষ বারাক ওবামা, যিনি সব বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী এবং পেশার মানুষের হাতে হাত ধরে পথ চলেন। যে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছিল ২০০৮-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেই হাওয়া আরও গতিশীল হতে শুরু করেছে ২০১২-তে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ এগিয়ে চলেছে সহজিয়া ছন্দে, গণমানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বমানব হিসেবে সামনের দিকে। দরিদ্র বাংলাদেশের এই আমরাও আপনাদের সঙ্গে আছি। অভিনন্দন আপনাদের।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনের আবেদন সেই ২০০৮ সালের মতোই ছিল ভিন্নমাত্রার। যদিও আমার কথাটি শুনে হয়তো মনে হবে তা বর্ণবাদ আক্রান্ত। তবুও এ কথা বলতেই হয় যে, ২০০৮ সালের আগে পর্যন্ত আমরা কখনও ভাবতেই পারিনি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সাদা মানুষের দেশে একজন কালো মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। সেই তখন যদিও তার অগ্রাভিযানে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, তবু সবারই মনের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস ছিল যে, এই কালো মানুষটি বোধহয় শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না। কিন্তু তিনি জিতেছিলেন। জিতেছিলেন বিশাল ব্যবধানে জন ম্যাককেইনকে হারিয়ে। যা-ই বলি আর না-ই বলি, আমরা সবাই তো অল্পবিস্তর বর্ণবাদী! অতএব সেই সাদা মানুষের দেশে একজন কালো মানুষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, সেটা আমাদের মতো কালো মানুষকে ভারি আহ্লাদিত করেছিল। আমার তো মনে হয়েছিল যে, আমিই বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলাম!
যা হোক, ওই দেশটির এবারের নির্বাচনের বিষয়ে একটু আলোচনা করার দরকার বলেই আমি মনে করছি। এবারের নির্বাচনে প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী ওবামার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এর নানাবিধ কারণ আছে। ওবামা নিজেই তার প্রথমবারের নির্বাচনী প্রচারে সাধারণ মানুষের মনে আশা-আকাঙ্ক্ষার যে ঢেউ তুলেছিলেন, তা তার নির্বাচনে সহায়ক হয়েছিল বটে কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা তার জন্য খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি বিশ্বময় মন্দার সময় জর্জ বুশের ফেলে রেখে যাওয়া আমেরিকা নামক একটি ভাঙা নৌকার হাল ধরেছিলেন। ফলে ২০০৯-এ এসেই তার সেই বিখ্যাত স্লোগান,Yes, we can... বা হ্যাঁ, আমরা পারি, রূপান্তরিত হয়েছিল, Yes, we perhaps can. অর্থাৎ 'হ্যাঁ, আমরা বোধহয় পারি'তে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, যারা অল্প আয়াসে অধিক মুনাফা অর্জন করার স্বপ্ন দেখেন সর্বদাই, তারা প্রচণ্ড অখুশি হয়েছিলেন। এটি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, যখন ওবামার নীতি হয়ে দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, চাকরিজীবী কিংবা বেকার ও অসহায় মানুষকে আরও বেশি করে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, তাদের আয়কর কমিয়ে দেওয়া, তাদের অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সংস্থানে এগিয়ে আসা। অনেকেই হয়তো জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত শ্বেতাঙ্গরা কখনোই কোনো প্রগতিশীল ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। অতি রক্ষণশীল ডানপন্থি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তো বলতেনই যে, প্রগতিশীল এবং প্রগতিবাদীরা শয়তানের সহচর। এরকম একটি দেশে বারাক ওবামা বোধহয় প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি জনসমক্ষে বলেছেন, Equal opportunity সবার জন্য সমান সুযোগের কথা। এবারের নির্বাচনে জেতার পরও তিনি একই কথা বলেছেন একটু ভিন্ন ভাষায়। বলেছেন, আমেরিকা এমন একটি দেশ যেখানে যে কোনো মানুষ নিজের উপযুক্ততায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। বস্তুতপক্ষে তিনি নিজেই তো তার এমন উক্তির বাস্তব রূপ। অতি রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদে উড়ে এসে জুড়ে বসল এক অশ্বেতাঙ্গ প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ_ এটি কল্পনাও করা যায়নি আজ থেকে দুই দশক আগেও। ওবামার গত চার বছরের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বেকার সমস্যার দ্রুত সমাধান। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, এর পেছনে অনেক কারণ ছিল। যেমন, তার ঠিক পূর্ববর্তী জর্জ ডবি্লউ বুশ যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনীতির অব্যবস্থাপনায় একটি বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। সেটি পূরণ করা সহজ ছিল না। এর ওপর 'বোঝার ওপর শাকের আঁটি' হিসেবে ইরাক, আফগানিস্তান এবং আরও একাধিক জায়গায়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়েছিল, তা বিব্রতজনকভাবে দেশটির দুর্গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ কথাও বারাক ওবামা বলেছেন তার বক্তৃতায় একাধিকবার। চাইলেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেননি। এ কারণে অতি রক্ষণশীল, ডানপন্থি রিপাবলিকান মিট রমনি যখন তার প্রার্থিতা পদ ঘোষণা করলেন, তখন গোটা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকা তার পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এবার ওবামার আর বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হলো না। বস্তুতপক্ষে নির্বাচন-সংক্রান্ত সব জরিপেই তাদের দু'জনের জনপ্রিয়তা খুবই কাছাকাছি দেখা গেছে। বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় জরিপে রমনিকে ওবামার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়ই মনে হয়েছে। মিট রমনি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে প্রায় এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহার সঞ্চার করেছিলেন। ভাবটা ছিল এমন যে, এবারে ওই ব্যাটাকে একহাত দেখে নেওয়া যাবে এবং এটা আসলেই সম্ভব হতো যদি সব শ্বেতাঙ্গ ভোটার (৬০-৭০%) তার বিপক্ষে ভোট দিতেন। সেই ক্ষেত্রে বারাক ওবামা এই নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারতেন না।
অনেকেই মনে মনে এই ধারণা পোষণ করে যে, সব অভিবাসী আমেরিকান এককভাবে ওবামাকে নির্বাচিত করেছে। এটা কখনোই সম্ভব ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যায় অভিবাসীর আনুপাতিক সংখ্যা ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। যদি ধরে নিই এদের সবাই বয়স ব্যতিরেকে সে দেশের ভোটার এবং তারা সবাই ওবামাকে ভোট দিয়েছে, তাহলেও কেবল অভিবাসীর ভোটে ওবামা নির্বাচিত হয়েছেন_ এ কথা ভাবাও বোধহয় হাস্যকর। ঠিক একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকান জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। যদি ধরে নিই যে, অভিবাসী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান সবাই একসঙ্গে মিলে ওবামাকে ভোট দিয়েছেন, তাহলেও ওবামার পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব হতো। এরকম একটি পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এ বছর ওবামা কীভাবে এত বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হলেন? বোধ করি এর জবাব নিহিত আছে ওবামারই বিজয়-বক্তৃতার মাঝে। তিনি বলেছেন, 'এই আমেরিকায় সাদা এবং কালো, লাল অথবা নীল, অভিবাসী অথবা দেশজ, লাতিন কিংবা পীতবর্ণ, সমকামী কিংবা অসমকামী সবাই প্রমাণ করেছে যে, সবার ওপরে তারা আমেরিকান।' ঠিক এই রসায়নটিই ধন্বন্তরির মতো কাজ করেছে সাধারণ মানুষের ধ্বজাবাহী বারাক ওবামার পতাকাকে উড্ডীয়মান রাখতে। এ ধরনের আধুনিক, প্রগতিশীল চিন্তাই অনুপ্রাণিত করেছে আমেরিকার সব শ্রেণীর গণমানুষকে ওবামার নির্বাচনে সহায়তা করতে।
আমার আজকের এই আলোচনা শেষ করা সম্ভব নয় একটি বিষয় উল্লেখ না করে। আমি লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের মধ্যে অনেকেই ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদিতে বারাক ওবামাকে উল্লেখ করেছেন বারাক হোসেন হিসেবে এবং বারাক হোসেনের নির্বাচনী জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন। আমি মনে করি, এহেন দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। বারাক হোসেনের চেয়ে অনেক বড় মাপের মানুষ বারাক ওবামা, যিনি সব বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী এবং পেশার মানুষের হাতে হাত ধরে পথ চলেন। যে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছিল ২০০৮-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেই হাওয়া আরও গতিশীল হতে শুরু করেছে ২০১২-তে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ এগিয়ে চলেছে সহজিয়া ছন্দে, গণমানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বমানব হিসেবে সামনের দিকে। দরিদ্র বাংলাদেশের এই আমরাও আপনাদের সঙ্গে আছি। অভিনন্দন আপনাদের।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments