পদ্মা সেতু প্রকল্প-মূল কাজ শুরু নিয়ে এখনো সংশয় by টিটু দত্ত গুপ্ত ও আরিফুর রহমান
প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ছুটি শেষে কাজে যোগ দিয়েছেন- এমন খবরে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে সাময়িক যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে আশ্বস্ত করা হয়েছে, মসিউর রহমান ছুটিতেই আছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত চলাকালে তিনি ছুটিতেই থাকবেন। সরকারের এমন ব্যাখ্যায় বিশ্বব্যাংক আশ্বস্ত হয়েছে বলে সংস্থার ঢাকা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এমন দাবি করা হয়েছে। এতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আশাবাদ আরো দৃঢ় হয়েছে।
তবে এখন থেকে প্রক্রিয়া শুরু করলেও সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরু করা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো সন্দিহান। তাঁরা বলছেন, প্রক্রিয়াগত জটিলতা ছাড়াও রয়েছে আবহাওয়া ও কারিগরি দিক, যে কারণে আগামী সেপ্টেম্বরের আগে পদ্মায় ভারী ড্রেজার ঢুকতে পারবে না। তবে সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ স্থলভাগের কিছু কাজ যেকোনো সময়ই শুরু করা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে স্বয়ং ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র কার্যক্রম যেখানে থেমে ছিল, সেখান থেকে আবার শুরু করলেও আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের আগে মূল সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। আর নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হলে মূল সেতুর কাজ আরো পিছিয়ে যাবে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেছিলেন, পাইল (সেতুর মূল ভিত্তি) ও নদী শাসন শুকনা মৌসুম ছাড়া করা যায় না। পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় ২৭০টি পাইল বসাতে হবে। মাটির নিচে পাথর কিংবা শক্ত মাটি থাকলে সময় বেশি লাগবে।
গতকাল কালের কণ্ঠকে জামিলুর রেজা বলেন, মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসেও যদি ঠিকাদার চূড়ান্ত করে কার্যাদেশ দেওয়া যায়, তাহলে অক্টোবরের মধ্যে কাজ শুরু করা সম্ভব হতো। কিন্তু এ প্রক্রিয়া আরো পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন এসে ঠিকাদারের বিষয় চূড়ান্ত করার কথা। পাশাপাশি তদন্ত ও প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চলবে কি না, তাও ঠিক করার কথা ওই মিশনের। তবে মিশন কবে আসবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না এবং আমাকে জানানোও হয়নি।'
বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন ঠিক কবে নাগাদ ঢাকা সফরে আসবে, সে বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে কিছু জানা যায়নি। যদিও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ইকবাল মাহমুদ চলতি মাসেই দ্বিতীয় মিশন ঢাকা সফরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন ঢাকায় এসে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও ক্রয়প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদন্ত প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলবে কি না- বিষয়টিও চূড়ান্ত করবে দ্বিতীয় মিশন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত মাসে ঢাকা সফর করে গেলেও এখনো কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। তাই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদন ও দ্বিতীয় মিশনের ঢাকা সফর এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে।
তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, এটি বিশ্বব্যাংকের কোনো মিশন নয়। সংস্থাটির প্রতিনিধিদের সহ-অর্থায়নকারী অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলাপ করে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার কথা ছিল। এডিবি ও জাইকার প্রতিনিধিদল ঢাকা এসে ঘুরে গেলেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা তখন আসেননি। নতুন করে কোনো বিভ্রান্তি এড়াতে সহ-অর্থায়নকারীদের এ সভা ঢাকায় না করে ওয়াশিংটন, টোকিও অথবা ম্যানিলায় আয়োজন করার কথা ভাবা হচ্ছে। তদন্ত ও প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চলার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক রাজি হবে- এমন আভাসও মিলেছে বলে ওই সূত্র জানায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ড. মসিউরের ছুটিতে থাকা না-থাকা নিয়ে গণমাধ্যমের খবরে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে তাঁদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠাতে হবে এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দিতে পারবেন না- সব শেষে বিশ্বব্যাংকের এমন শর্ত মানার পরই সংস্থাটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এক মাস ছুটি শেষে মসিউর কাজে যোগ দিয়েছেন এবং দাপ্তরিক কাজ করছেন- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে এ উদ্বেগের কথা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয়। এর পরই সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থমন্ত্রীও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোনো শর্তেরই ব্যত্যয় ঘটেনি।
ড. মসিউর অফিসে ফিরেছেন বলে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, এর কোনো ভিত্তি নেই এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এর সত্যতাও যাচাই করা হয়নি বলে দাবি করে সরকারের ওই নীতিনির্ধারক জানান, পদ্মা সেতু হোক- এটি যারা চায় না, তারাই গণমাধ্যমে এসব অসমর্থিত খবর ছড়াচ্ছে। এসব খবরে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হলে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে ই-মেইল ও ফোনে যোগাযোগ করে সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। সংস্থাটিকে জানানো হয়, তাদের সঙ্গে যেসব বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে, এর সবই সরকার পালন করেছে এবং এর কোনোটিই ভঙ্গ করা হয়নি।
'শুক্রবারও দিন-রাত ই-মেইল আর ফোনে ছিলাম। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে আমরা কোনো শর্ত ভঙ্গ করিনি,' বললেন ওই নীতিনির্ধারক। বিশ্বব্যাংকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সোমবারে পাঠানো এক ই-মেইলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে তাঁদের আর কোনো সংশয় নেই। তারা আমাদের বলেছে, এ নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় সরকার বিব্রত হয়েছিল। সেতুর কাজ শুরু করার আশা ছেড়ে দিয়ে সরকার এখন বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার ঘোষণাকেই বিজয় হিসেবে দেখছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'এটি মোটেই ঠিক নয়। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে। পদ্মা সেতু হবে এবং বিশ্বব্যাংকও থাকবে আমাদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত।'
কবে নাগাদ বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করবে এবং মূল কাজ কবে শুরু করা সম্ভব হবে- জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করে বলেন, সেতুর মূল কাজ শুরুর আগেও অনেক কাজ করতে হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় তো কিছু লাগবেই।
বিশ্বব্যাংক ও ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনরুজ্জীবনের নজির বিশ্বব্যাংকের খুব বেশি নেই। পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি পুনর্বহাল হলেও নতুন জুড়ে দেওয়া শর্ত নিয়ে একটি সাপ্লিমেন্টারি এগ্রিমেন্ট সম্পাদন করতে হবে। দেরির কারণে প্রকল্প ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করতে হলে সময় ও জটিলতা বাড়বে। এটি এড়িয়েও যদি মোট ব্যয়ের শতাংশ হিসাবে বাড়তি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় তাহলে সময় বাঁচবে।
পদ্মা সেতু কেবল আওয়ামী লীগ সরকারেই প্রকল্প নয়, এটি এর আগের বিএনপি সরকারেরও অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ছিল। ফলে এটি জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি। জাইকার নেতৃত্বে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণের কাজগুলো আগের বিএনপি সরকারই করে রেখেছিল। এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বুঝেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি। বিশ্বব্যাংক নিজেই বলেছে, এটি তাদের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। দেশের ও ঋণদাতা সংস্থাগুলোর জন্য গর্বের এ প্রকল্পটি এখন স্থবির। মূল কাজ কবে শুরু হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সাবেক বিএনপি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদারও।
মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে নাজমুল হুদা বলেন, দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, পদ্মা সেতু হবে। কোন সরকার করবে, সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচন চলে আসছে। বর্তমান সরকার বাকি মেয়াদে পদ্মা সেতু নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই এখন তড়িঘড়ি না করে সরকারের উচিত হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে না পারা এ সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হবে, যার প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। তবে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদের যদি সরকার দূরে রাখে তাহলে বিশ্বব্যাংক হয়তো এগিয়ে আসবে। তখন বর্তমান সরকার অন্তত শুরুটা করতে পারবে।
তবে এখন থেকে প্রক্রিয়া শুরু করলেও সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরু করা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো সন্দিহান। তাঁরা বলছেন, প্রক্রিয়াগত জটিলতা ছাড়াও রয়েছে আবহাওয়া ও কারিগরি দিক, যে কারণে আগামী সেপ্টেম্বরের আগে পদ্মায় ভারী ড্রেজার ঢুকতে পারবে না। তবে সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ স্থলভাগের কিছু কাজ যেকোনো সময়ই শুরু করা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে স্বয়ং ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র কার্যক্রম যেখানে থেমে ছিল, সেখান থেকে আবার শুরু করলেও আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের আগে মূল সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। আর নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হলে মূল সেতুর কাজ আরো পিছিয়ে যাবে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেছিলেন, পাইল (সেতুর মূল ভিত্তি) ও নদী শাসন শুকনা মৌসুম ছাড়া করা যায় না। পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় ২৭০টি পাইল বসাতে হবে। মাটির নিচে পাথর কিংবা শক্ত মাটি থাকলে সময় বেশি লাগবে।
গতকাল কালের কণ্ঠকে জামিলুর রেজা বলেন, মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসেও যদি ঠিকাদার চূড়ান্ত করে কার্যাদেশ দেওয়া যায়, তাহলে অক্টোবরের মধ্যে কাজ শুরু করা সম্ভব হতো। কিন্তু এ প্রক্রিয়া আরো পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন এসে ঠিকাদারের বিষয় চূড়ান্ত করার কথা। পাশাপাশি তদন্ত ও প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চলবে কি না, তাও ঠিক করার কথা ওই মিশনের। তবে মিশন কবে আসবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না এবং আমাকে জানানোও হয়নি।'
বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন ঠিক কবে নাগাদ ঢাকা সফরে আসবে, সে বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে কিছু জানা যায়নি। যদিও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ইকবাল মাহমুদ চলতি মাসেই দ্বিতীয় মিশন ঢাকা সফরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় মিশন ঢাকায় এসে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও ক্রয়প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদন্ত প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলবে কি না- বিষয়টিও চূড়ান্ত করবে দ্বিতীয় মিশন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত মাসে ঢাকা সফর করে গেলেও এখনো কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। তাই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদন ও দ্বিতীয় মিশনের ঢাকা সফর এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে।
তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, এটি বিশ্বব্যাংকের কোনো মিশন নয়। সংস্থাটির প্রতিনিধিদের সহ-অর্থায়নকারী অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলাপ করে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার কথা ছিল। এডিবি ও জাইকার প্রতিনিধিদল ঢাকা এসে ঘুরে গেলেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা তখন আসেননি। নতুন করে কোনো বিভ্রান্তি এড়াতে সহ-অর্থায়নকারীদের এ সভা ঢাকায় না করে ওয়াশিংটন, টোকিও অথবা ম্যানিলায় আয়োজন করার কথা ভাবা হচ্ছে। তদন্ত ও প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চলার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক রাজি হবে- এমন আভাসও মিলেছে বলে ওই সূত্র জানায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ড. মসিউরের ছুটিতে থাকা না-থাকা নিয়ে গণমাধ্যমের খবরে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে তাঁদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠাতে হবে এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দিতে পারবেন না- সব শেষে বিশ্বব্যাংকের এমন শর্ত মানার পরই সংস্থাটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এক মাস ছুটি শেষে মসিউর কাজে যোগ দিয়েছেন এবং দাপ্তরিক কাজ করছেন- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে এ উদ্বেগের কথা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয়। এর পরই সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থমন্ত্রীও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোনো শর্তেরই ব্যত্যয় ঘটেনি।
ড. মসিউর অফিসে ফিরেছেন বলে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, এর কোনো ভিত্তি নেই এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এর সত্যতাও যাচাই করা হয়নি বলে দাবি করে সরকারের ওই নীতিনির্ধারক জানান, পদ্মা সেতু হোক- এটি যারা চায় না, তারাই গণমাধ্যমে এসব অসমর্থিত খবর ছড়াচ্ছে। এসব খবরে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হলে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে ই-মেইল ও ফোনে যোগাযোগ করে সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। সংস্থাটিকে জানানো হয়, তাদের সঙ্গে যেসব বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে, এর সবই সরকার পালন করেছে এবং এর কোনোটিই ভঙ্গ করা হয়নি।
'শুক্রবারও দিন-রাত ই-মেইল আর ফোনে ছিলাম। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে আমরা কোনো শর্ত ভঙ্গ করিনি,' বললেন ওই নীতিনির্ধারক। বিশ্বব্যাংকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সোমবারে পাঠানো এক ই-মেইলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে তাঁদের আর কোনো সংশয় নেই। তারা আমাদের বলেছে, এ নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় সরকার বিব্রত হয়েছিল। সেতুর কাজ শুরু করার আশা ছেড়ে দিয়ে সরকার এখন বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার ঘোষণাকেই বিজয় হিসেবে দেখছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'এটি মোটেই ঠিক নয়। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে। পদ্মা সেতু হবে এবং বিশ্বব্যাংকও থাকবে আমাদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত।'
কবে নাগাদ বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করবে এবং মূল কাজ কবে শুরু করা সম্ভব হবে- জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করে বলেন, সেতুর মূল কাজ শুরুর আগেও অনেক কাজ করতে হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় তো কিছু লাগবেই।
বিশ্বব্যাংক ও ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনরুজ্জীবনের নজির বিশ্বব্যাংকের খুব বেশি নেই। পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি পুনর্বহাল হলেও নতুন জুড়ে দেওয়া শর্ত নিয়ে একটি সাপ্লিমেন্টারি এগ্রিমেন্ট সম্পাদন করতে হবে। দেরির কারণে প্রকল্প ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করতে হলে সময় ও জটিলতা বাড়বে। এটি এড়িয়েও যদি মোট ব্যয়ের শতাংশ হিসাবে বাড়তি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় তাহলে সময় বাঁচবে।
পদ্মা সেতু কেবল আওয়ামী লীগ সরকারেই প্রকল্প নয়, এটি এর আগের বিএনপি সরকারেরও অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ছিল। ফলে এটি জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি। জাইকার নেতৃত্বে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণের কাজগুলো আগের বিএনপি সরকারই করে রেখেছিল। এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বুঝেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি। বিশ্বব্যাংক নিজেই বলেছে, এটি তাদের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। দেশের ও ঋণদাতা সংস্থাগুলোর জন্য গর্বের এ প্রকল্পটি এখন স্থবির। মূল কাজ কবে শুরু হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সাবেক বিএনপি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদারও।
মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে নাজমুল হুদা বলেন, দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, পদ্মা সেতু হবে। কোন সরকার করবে, সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচন চলে আসছে। বর্তমান সরকার বাকি মেয়াদে পদ্মা সেতু নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই এখন তড়িঘড়ি না করে সরকারের উচিত হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে না পারা এ সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হবে, যার প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। তবে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদের যদি সরকার দূরে রাখে তাহলে বিশ্বব্যাংক হয়তো এগিয়ে আসবে। তখন বর্তমান সরকার অন্তত শুরুটা করতে পারবে।
No comments