বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীন, বীর প্রতীক সাহসী অধিনায়ক
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভোমরা। সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত। সীমান্তরেখা বরাবর আছে একটি বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ।


১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাতক্ষীরা ও যশোর এলাকার কয়েক স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে একদল মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন ভোমরায়। এরপর তাঁরা আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীনের নেতৃত্বে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন এক কোম্পানির কিছু বেশি।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল বাঁধের ওপরে। তাঁদের এ অবস্থান ছিল বেশ আধিপত্যমূলক। কারণ, বাঁধের ওপর থেকে বাংলাদেশের ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হতো। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাতক্ষীরা জেলায় (তখন মহকুমা) নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তখনও তারা ভোমরায় যায়নি। পরে তারা এ বাঁধ দখল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ২৮ মে শেষ রাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৯ মে) প্রায় দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর ভোমরা বাঁধের অবস্থানে আক্রমণ করে।
পাকিস্তানিরা যেকোনো সময় ভোমরায় আক্রমণ করতে পারে। এ জন্য আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীন সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রস্তুতই থাকতেন। পাকিস্তানিদের উপস্থিতি তিনি সঙ্গে সঙ্গে টের পান। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। এরপর দুই পক্ষে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুলনায় তাঁরা ছিলেন প্রায় অর্ধেক। এতে সালাহউদ্দীন ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিচলিত হননি। তাঁরা অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করেন। তাঁদের বীরত্বে পাকিস্তানিরা পিছিয়ে যায়।
কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুনঃসংগঠিত হয়ে আবার আক্রমণ করে। এর মধ্যে নতুন কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা সেখানে আসে। তাতে পাকিস্তানিদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। সালাহউদ্দীন এবারও সহযোদ্ধাদের নিয়ে সফলতার সঙ্গে আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কয়েকজন সহযোদ্ধা বাঁধের ওপর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গেরিলা কায়দায় সুইপিং গোলাগুলি শুরু করেন। এতে সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টারত বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২৯ মে থেমে থেমে সারা দিন যুদ্ধ চলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এক আক্রমণ চালিয়েও আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দলকে বাঁধ থেকে উচ্ছেদ করতে পারেনি। সারা দিনের এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ অনেকে নিহত এবং ব্যাটালিয়ন অধিনায়কসহ অসংখ্য ব্যক্তি আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও আট-নয়জন আহত হন। নিহত পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের মৃতদেহ পাকিস্তানিরা উদ্ধার করতে পারেনি। মৃতদেহটি সালাহউদ্দীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।
আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে উপ-অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২০৪ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে। এর অবস্থান ছিল ঢাকা সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কয়েক দিন পর ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে ৮ নম্বর সেক্টরের ভোমরা এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে ৫ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০২।
আবু তাহের মো. সালাহউদ্দীন স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার মসজিদা গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন চট্টগ্রাম মহানগরে (ফ্ল্যাট ২০৩, বাড়ি ১৫, সড়ক ১, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি)। তাঁর বাবার নাম জহিরুল ইসলাম চীেধুরী, মা আনোয়ারা বেগম। স্ত্রী দিলরুবা সালাহউদ্দীন। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৫ ও ৮ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.