আলোকের এই ঝরনাধারায় (শেষ পর্ব)-স্বাধীন বাংলাদেশের গন্ধ শরীরে মেখে by আলী যাকের

সেই নিউ মার্কেট থেকে ব্যাগ হাতে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ওয়ারীতে এসে পড়েছি, লক্ষ করিনি। আর সামান্য দূরেই নারিন্দা, যেখানে ভাইয়া, আমার বড় ভাই সস্ত্রীক ও সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে বাস করেন। হাটখোলা রোডে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এক রিকশাওয়ালা আমায় জিজ্ঞেস করলেন রিকশায় চড়ব কি না।


আমার পকেটে টাকা-পয়সা বেশি ছিল না। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কত নেবেন? জবাবে রিকশাওয়ালা বললেন, 'আপনার যা খুশি দিয়েন। কোথায় যাবেন?' আমি রিকশায় চড়ে বসলাম। বললাম, নারিন্দা যাব। নারিন্দায় নির্দিষ্ট গলির ভেতরে ঢুকে রিকশাওয়ালার হাতে ভারতীয় দুটি টাকা দিয়ে বললাম, আমার কাছে পয়সা খুবই কম। সে একগাল হেসে দ্রুত রিকশা নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। সামনেই ভাইয়ার বাড়ি। একটি দ্বিতল ভবনের দোতলায় তাঁরা থাকেন। তখন রাত ৮টা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দোতলার দরজায় করাঘাত করলাম। ভাইয়া নিজেই দরজা খুললেন। আমাকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে স্থাণু হয়ে গেলেন। তারপর জড়িয়ে ধরলেন, দীর্ঘদিন পর শত অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দুই ভাই আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। আমাদের দুজনেরই চোখ দিয়ে তখন বাঁধভাঙা অশ্রু ঝরছে। ভাবি আমার ভাতিজিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলেন। ওর নাম রাখা হয়েছে তিথি। আমি ভাবিকেও জড়িয়ে ধরলাম। ভাবি বললেন, ভেতরে এসে আগে বস, তারপর দেখা যাবে। রাত ১০টার দিকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হলো। আমার ও ভাইয়ার- উভয়ের মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটছে। নানাজনের খবর নিচ্ছি তখন। কে কোথায় আছে, কেমন আছে ইত্যাদি। আমাদের কথা যেন ফুরাতেই চায় না। সেই আমার মায়ের সংসারে যেমন হতো, খাবার টেবিলে সবাই বসে খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আড্ডা চালিয়ে যেতাম। এঁটো হাত শুকিয়ে যেত, কিন্তু আড্ডা থামত না। রাত ১১টায় আবার কেন যেন ঢাকার রাস্তায় নামার নেশা আমাকে বাইরে টেনে আনল। ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু পয়সা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়লাম। হাঁটতে লাগলাম। এবারে টিপু সুলতান রোড হয়ে নবাবপুরের দিকে। দেখলাম, পথে অনেক বিধ্বস্ত দোকানপাটও খোলা রয়েছে তখন। সবাই হাসিমুখে গল্প করছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সদরঘাট। এখানেও জনারণ্য। সদরঘাট থেকে একটি রিকশা ধরে পাটুয়াটুলী ও ইসলামপুর হয়ে আরমানিটোলা। সেখান থেকে বংশাল, নবাবপুর হয়ে আবার গুলিস্তান। রাত ৩টা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের গন্ধ শরীরে মেখে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। সে যে কী আনন্দ, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না! এক অপার শান্তিতে মন ভরে গেল। এরপর আমার গন্তব্য মগবাজার মোড়ে ক্যাফে তাজ। সেখানে একা একা বসে স্বাদু মোরগ-পোলাও খেলাম। ক্যাফে তাজ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম উন্মুক্ত আকাশের নিচে। হঠাৎ উত্তর থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপন লাগল যেন শরীরে। এলোমেলো নানা চিন্তা ভিড় করে মনে। এত মানুষের এত ত্যাগ, এত সম্ভ্রমহানি, এত আত্মাহুতি, যার ফসল আমার এই বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকবে তো? অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব তো? যে আদর্শ ও চেতনা নিয়ে, পূর্বাপর কোনো কিছু না ভেবেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, সেই চেতনা অটুট থাকবে তো? তারপর একটা খালি রিকশায় উঠে বসলাম আমার শেষ গন্তব্য নারিন্দায় যাওয়ার জন্য।
সমাপ্ত

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.