শেকড়ের ডাক-মৃত্যুর ফাঁদ পাতা ভুবনে by ফরহাদ মাহমুদ
কবি দেখেছিলেন, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। আর এখন আমরা দেখছি যেন মৃত্যুরই ফাঁদ পাতা ভুবনে। জ্যৈষ্ঠ মাসে মিষ্টি ফল খেতে কার না ইচ্ছা করে? কিন্তু লিচু খেয়ে ১৩টি শিশু মারা যাওয়ার পর অনেকের মন থেকেই সম্ভবত ফল খাওয়ার সাহস উবে গেছে। বিশেষ করে নিজের সন্তানদের মুখে মৌসুমি ফল তুলে দিতে গিয়ে আতঙ্কিত হচ্ছেন তাঁরা।
আম দেখলেই মনে পড়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট্ট শিশুটির কথা। পোকার আক্রমণ থেকে আম বাঁচাতে তার বাবা গাছে কীটনাশক স্প্রে করেছিলেন। কিছুক্ষণ পর ছোট্ট শিশুটি গেল আমগাছের তলায়। কুড়িয়ে পাওয়া আমটি সে মজা করেই খেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুটিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। কিন্তু সে রকম বিষ তো আমরা প্রতিনিয়ত খাচ্ছি। ফল, সবজি, তরিতরকারির জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার পর খাওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিতে হয়। কীটনাশকভেদে সেই সময় নানা রকম। কোনোটা সাত দিন, কোনোটা এক মাস কিংবা কোনোটা আরো বেশি। অথচ জানা যায়, আগের দিন কীটনাশক দিয়ে পরের দিন তা বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। আমরাও সেগুলো কিনে খাচ্ছি। হয়তো শিশুটির মতো একেবারে আমরা মারা যাচ্ছি না। কিন্তু লিভার, কিডনি বিকল হওয়াসহ শরীরের নানা রকম ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা স্লো পয়জনিংয়ের শিকার হচ্ছি। মাছ, দুধ, মাংস, ফল বা শাকসবজিতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। ফরমালিনও একটি মারাত্মক বিষ। মাত্র এক আউন্স পরিমাণ খেলে একজন মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে। সেই ফরমালিনে মাছ বা ফল ডুবিয়ে রেখে পরে তা বাজারে আনা হয়। আমরাও কিনে নিয়ে খাই। কী করব? খেতে তো হবে! কার্বাইড, ইউরিয়া, পোড়া মবিল, ট্যানারির বর্জ্য, চক পাউডার, বিষাক্ত কাপড়ের রং- কত কিছুই না আমরা খাচ্ছি নানা রকম খাবারের সঙ্গে। তার ফলও ফলছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মারা যাওয়া ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে রেসপিরেটরি ফেইলিওর বা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে বিষক্রিয়া। এ তথ্য দিয়েছে সরকারেরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন, নভেম্বর ২০০৯-এ বলা হয়েছে, হাসপাতালগুলোতে এই বয়সের ১২.৩ শতাংশই মারা যায় ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং ১১ শতাংশ মারা যায় বিষক্রিয়ায়। শুধু এগুলোই নয়, বাড়ছে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও।
গত ২৯ আগস্ট 'দেশে সিলিকোসিসের সংক্রমণ' শিরোনামে কালের কণ্ঠে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে পাথর ও সিরামিক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগটি ব্যাপক হারে দেখা দিচ্ছে। উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া কাজ করার দরুন নিঃশ্বাসের সঙ্গে পাথরের ধূলিকণা ফুসফুসে চলে যাচ্ছে। ফলে ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। গত জুন থেকে সেখানে কাজ করছে একটি চিকিৎসক দল। জানা গেছে, কেবল বুড়িমারীতেই গত এক বছরে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৭ জন। আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক শ। সারা দেশেই এ ধরনের হাজার হাজার অনিরাপদ কারখানা রয়েছে। সেগুলোতে কত শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কে জানে? তার চেয়ে বড় কথা, বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকা ঢাকা মহানগরীতে বাতাসে ধূলিকণা ও দূষণের মাত্রা নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক সমীক্ষায়ও বায়ুদূষণকে রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়, আমাদের শহরগুলোর বায়ুদূষণ ২০ থেকে ৮০ শতাংশ কমানো গেলে বছরে এক হাজার ২০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার জীবন বাঁচানো যেত। পাশাপাশি আট কোটি থেকে ২৩ কোটি পর্যন্ত রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এড়ানো যেত। বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যে দেখা যায়, বায়ুদূষণজনিত কারণে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও অসুখ-বিসুখের ১০ শতাংশই হয় বায়ুদূষণের কারণে। ক্রনিক ব্রংকাইটিস, পালমোনারি এমফাইসেমা, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুতে থাকা বস্তুকণার ওপর ভিত্তি করে নানা ধরনের বিষক্রিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। হৃদরোগের আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কেবল মৃত্যু দিয়ে হিসাব করা যায় না। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে কত শতাংশ মানুষ মারা গেল, সেটি যেমন একটি বড় ব্যাপার; তেমনি বড় ব্যাপার হচ্ছে, আরো কত শতাংশ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে তাদের কর্মক্ষমতা হারাল তা নির্ণয় করা। আর কত শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালগুলোতে যায়? কাজেই সরকারি হাসপাতালগুলোর পর্যবেক্ষণ বাস্তবতার চিত্র কতটুকু ধারণ করতে পেরেছে, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আর কত শতাংশ মানুষ অর্থের অভাবে চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাচ্ছে, তা-ই বা কে জানে? তাদের হিসাব তো কোনো হাসপাতালের পরিসংখ্যানে পাওয়া যাবে না।
বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা, তারপর বৃদ্ধরা। কারণ সদ্য পৃথিবীতে আসা শিশুটিকে এর পরিবেশের সঙ্গে খাপখাওয়াতেই অনেক বেগ পেতে হয়। সেখানে তাকে যদি আমরা ফেলে দিই ভয়াবহ দূষিত এক পরিবেশে, তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে সে বাতাস থেকে বিষ টেনে নেবে, শ্বাসনালির সংক্রমণ হবে, ফুসফুস অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং আসার পর পরই একসময় বিদায় নেবে পৃথিবী থেকে। আমরা কি তেমন পরিবেশের দিকেই টেনে নেব আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের? বৃদ্ধদেরও শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ও দৃঢ়তা কমে আসে। খুব সহজেই তাঁরা কাবু হয়ে পড়েন। তাঁরাও বায়ুদূষণের সহজ শিকারে পরিণত হন। বায়ুদূষণে আক্রান্তরা শিশু অবস্থায় যেমন মারা যায়, তেমনি শিশু বয়স থেকে আক্রান্ত হয়ে ১১ বা তদূর্ধ্ব বয়সে গিয়েও মারা যায়।
বায়ুদূষণের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যানবাহন। তা সত্ত্বেও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে ছোট যানবাহনের সংখ্যা। এতে পরিবেশদূষণ যেমন বেশি হয়, তেমনি সড়কগুলোর ধারণ ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায় যানবাহনের সংখ্যা। শুরু হয় যানজট। এতেও বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। যানজটের কারণে একই দূরত্ব অতিক্রম করতে জ্বালানি পোড়াতে হয় অনেক বেশি। সারা দেশেই বাড়ছে ডিজেলচালিত নছিমন-করিমন জাতীয় গাড়ির সংখ্যা, যেগুলোর ইঞ্জিন গাড়ি চালানোর জন্য তৈরিই হয়নি। এগুলোর পরিবেশদূষণের মাত্রাও অনেক বেশি। কার্বন ডাই-অক্সাইড তো বটেই, এগুলো থেকে সরাসরি হাইড্রোকার্বনও (জ্বালানি ঠিকমতো না পোড়ার ফলে যে অবশিষ্টাংশ বেরিয়ে আসে) নির্গত হয়। গ্রামগঞ্জে এখন অহরহ এ ধরনের যান চলাচল করতে দেখা যায়। এগুলোতে যেহেতু আধুনিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকে না, তাই এগুলোর দুর্ঘটনার হারও অনেক বেশি।
মৃত্যুর ফাঁদ পাতা ভুবনে মৃত্যুর আরো অনেক ফাঁদেই আমরা প্রতিদিন ধরা পড়ছি। জলোচ্ছ্বাসসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায়ের মতো মৃত্যুবরণ, অবহেলাজনিত সড়ক দুর্ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণে চোর-ডাকাতের হাতে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ- আরো কত কী? অথচ এ সব কিছুকে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় এনে নাগরিকদের সুস্থ জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেওয়াটা রাষ্ট্রের অবশ্য পালনীয় একটি কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরের মতোই এখনো এসব ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদাসীন।
লেখক : সাংবাদিক
No comments