তেলের জন্য যুদ্ধ by ড. তারেক শামসুর রেহমান
লিবিয়ায় যেকোনো মুহূর্তে পশ্চিমা সামরিক অভিযান শুরু হতে পারে। জাতিসংঘ অনুমতি দিয়েছে। নতুন মোড় নিয়েছে লিবিয়া সংকট। লিবিয়ার সংকট যতই ঘনীভূত হচ্ছে, ততই একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর তা হচ্ছে, তেলের জন্যই মূলত এ যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের অভিমত তা-ই।
বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকার তেলের বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আর এ জন্য যুদ্ধটা বড় প্রয়োজন। আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তেলের রিজার্ভ রয়েছে লিবিয়ায়। রিজার্ভের পরিমাণ ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ব্যারেল। রিজার্ভের এই পরিমাণ মিসরের রিজার্ভের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের যে রিজার্ভ রয়েছে, তার চাইতে দুই গুণেরও বেশি রিজার্ভ রয়েছে লিবিয়ায়। বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো (আইওসি) এখন তেলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বে যে তেল ও গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে তার ৬০ ভাগের মালিক হচ্ছে আইওসি। এমনকি বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের যে বিশাল পাইপলাইন নেটওয়ার্ক রয়েছে, তারও মালিক আইওসি। আইওসি এত শক্তিশালী যে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তারা সরকার পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে। এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তেল এখন বড় ব্যবসা। ১৯৯৭ সালে ব্যারেলপ্রতি যে তেলের মূল্য ছিল মাত্র ২০ ডলার, লিবিয়া সংকটের কারণে সেই তেলের মূল্য এখন ১১০ ডলারে উঠেছে। এখন লিবিয়ার তেলের নিয়ন্ত্রণ যদি নেওয়া যায়, তাহলে এ থেকে বড় মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। আর এ লক্ষ্যেই তারা এগোচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে লিবিয়ায় ব্যারেলপ্রতি তেলের মূল্য এক ডলারের সমতুল্য। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ওই তেলের মূল্য ১১০ ডলার। আর এ কারণেই সংকট সৃষ্টি করে কৃত্রিম উপায়ে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে তেলের রিজার্ভ ৬৬ দশমিক ২ ভাগ থেকে ৭৫ দশমিক ৯ ভাগ। এর মধ্যে এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ৫৬ ভাগ তেলের রিজার্ভ। আফ্রিকায় রয়েছে ৯ ভাগ, ইউরোপ-এশিয়ায় সাত ভাগ, উত্তর আমেরিকায় ১৬ ভাগ, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় আট ভাগ। ইউরোপে তেলের রিজার্ভ মাত্র এক ভাগ। আফ্রিকায় যে তেল রয়েছে তার বড় রিজার্ভ লিবিয়ায় (৪৬.৪ বিলিয়ন, কারো মতে ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল) নাইজেরিয়ায় রয়েছে ৩৭.২ বিলিয়ন, আলজেরিয়ায় ১২.২ বিলিয়ন, আর অ্যাঙ্গোলায় ৯.৩ বিলিয়ন ব্যারেল। তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়াকে আইওসি কিভাবে একটি গরিব দেশে পরিণত করেছিল, তার ইতিহাস অনেকেই জানেন। তেলসম্পদ থাকা সত্ত্বেও নাইজেরিয়ার দারিদ্র্য কমেনি। বরং আইওসি সেনানায়কদের হাত করে (যেমন জেনারেল সানি আবাচা) দেশটির তেলসম্পদ নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। লিবিয়ার পরিস্থিতিও সেদিকে যাচ্ছে। স্মরণ করা যাক ইরাকের করুণ ইতিহাস। বিশ্বের দ্বিতীয় তেল রিজার্ভ ইরাকে। এ সম্পদের মালিক এখন আর ইরাকের জনগণ নয়। এর মালিক এখন আইওসি। ২০০৩ সালের যুদ্ধ আইওসিকে সেই সুযোগটিই করে দিয়েছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। ইরাক তার বড় প্রমাণ।
লিবিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। ওবামা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, গাদ্দাফির পতন নিশ্চিত করাই তাঁর লক্ষ্য। ইউরোপের দেশগুলোরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে লিবিয়ায়। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় আইওসি (ফ্রান্সের ঞড়ঃধষ, ইতালির ঊঘও, স্পেনের জঊচঝঙখ) লিবিয়ায় তেল উত্তোলন ও রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। লিবিয়া যে তেল রপ্তানি করে (অর্থাৎ বিক্রি করে), এর ২৫ ভাগ একা উৎপাদন করে ঊঘও (প্রতিদিন দুই লাখ ৪৪ হাজার ব্যারেল)। আর প্রতিদিন যে গ্যাস উৎপাদন হয় (দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট) তা গবষষরঃধয গ্যাসকেন্দ্র থেকে ৎেববহংঃৎবধস চরঢ়বষরহব-এর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের ওপারে সিসিলির (ইতালি) গেলা ও এন্মা বন্দরে সরবরাহ করা হয়। সংগত কারণে তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ থাকবে লিবিয়ার ব্যাপারে। ইতিমধ্যে ইইউ নেতারা গাদ্দাফিবিরোধীদের রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট হোসে ম্যানুয়েল বারোসো ওবামার সুরে সুর মিলিয়ে গাদ্দাফির পদত্যাগ দাবি করেছেন। হিলারি ক্লিনটন চলতি সপ্তাহেই যাচ্ছেন পূর্ব লিবিয়ায়। সেখানে তিনি গাদ্দাফিবিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিবিরোধী গ্রুপকে সমর্থন করছে। মনে রাখতে হবে, লিবিয়ার তেলকূপগুলোর ৮০ ভাগই পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার অর্থ হচ্ছে, তেলসম্পদের ওপর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এই তেলসম্পদের ওপরই যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গেল বছর দুটি মার্কিন আইওসি শেভরন ও অঙ্েিডন্টাল লিবিয়ায় তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিল। এখন তারাই আবার ফিরে আসছে। পূর্বাঞ্চল যদি সত্যি সত্যিই আলাদা হয়ে যায়, তাহলে তেলসম্পদের ওপর লিবিয়ান ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের কর্তৃত্ব আর থাকবে না। আইওসি এটাও চাইছে। কেননা বিশ্বের ১০০টি তেল কম্পানির মধ্যে লিবিয়ার ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের অবস্থান ২৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিতে আরো একটা বিষয় কাজ করছে। আর তা হচ্ছে, লিবিয়ায় চীনের প্রভাব কমানো। ইরানের মতো লিবিয়ার তেল সেক্টরে চীনের যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের সরকারি ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লিবিয়ায় তেল উত্তোলনে নিয়োজিত। লিবিয়া যে তেল রপ্তানি করে তার ১১ ভাগ যায় চীনে। চীনে তেলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। যে কারণে আফ্রিকায় চীনের (যেমন সুদানে) বিনিয়োগ অনেক বেশি। প্রায় ৩০ হাজার চীনা বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক লিবিয়ায় তেল উত্তোলনে জড়িত ছিল। এদের উদ্ধারের জন্য চীন ভূমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনীর একটি ইউনিটকে পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। লিবিয়ায় চীনের প্রভাব যদি কমানো যায়, তাহলে আইওসির জন্য তেলসম্পদ পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়া অনেক সহজ।
লিবিয়ার সংকট স্পষ্টতই সমগ্র আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র মাত্রই জানেন, ১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলনে আফ্রিকাকে বিভক্ত করা হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় তখন বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চলে। একুশ শতকে নতুন এক আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। কঙ্গো, রুয়ান্ডা কিংবা আইভরিকোস্টে ফ্রান্সের স্বার্থ ও প্রভাব থাকলেও, এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রও তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন লিবিয়ায় একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। কেননা লিবিয়াকে বলা হয় এ অঞ্চলে যাওয়ার 'গেটওয়ে'। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ফ্রেঞ্চ-ভাষী তিউনিসিয়ায় সরকারের পতন ঘটেছে। আর আলজেরিয়ায়ও সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে আফ্রিকায় অঋজওঈঙগ নামে নতুন একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী নাইজার ও সাদের প্রাকৃতিক সম্পদের (কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, ক্রোসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্লুটোনিয়াম) ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে নাইজারের ইউরেনিয়াম সম্পদ দেশটিকে 'লিবিয়ার মতো একটি পরিস্থিতির' দিকে ভবিষ্যতে ঠেলে দিতে পারে। আজ লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। যে অঞ্চল একসময় ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ, একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী চরিত্রের নতুন একটি রূপ।
বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছিল একটা ধারণাপত্র জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংবং, যেখানে বলা হয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা। আফগানিস্তান ও ইরাকের পর এখন লিবিয়া। আফগানিস্তান ও ইরাকে এখনো যুদ্ধ চলছে। আর যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে দেশ দুটিতে। আর তাতে লাভবান হচ্ছে কিছু ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। ইরাকে যেমনটি হয়েছিল। তেল বিক্রি করে দেশটির পুনর্গঠন। ঠিক তেমনটিই হতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। লিবিয়ার তেলসম্পদ (ইতালি, ফ্রান্স আর জার্মানির ৮৫ ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে) তাই যুদ্ধকে উস্কে দিয়েছে। এতে লিবিয়া ভাগ হয়ে গেলে আমি অবাক হব না। এ যুদ্ধে লিবিয়ার জনগণ উপকৃত হবে না। সেখানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং এতে লাভবান হবে বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো। আর আমরা, উন্নয়নশীল বিশ্ব এতে ক্ষতিগ্রস্ত হব। কেননা উচ্চমূল্যে আমাদের তেল কিনতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে তেলের রিজার্ভ ৬৬ দশমিক ২ ভাগ থেকে ৭৫ দশমিক ৯ ভাগ। এর মধ্যে এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ৫৬ ভাগ তেলের রিজার্ভ। আফ্রিকায় রয়েছে ৯ ভাগ, ইউরোপ-এশিয়ায় সাত ভাগ, উত্তর আমেরিকায় ১৬ ভাগ, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় আট ভাগ। ইউরোপে তেলের রিজার্ভ মাত্র এক ভাগ। আফ্রিকায় যে তেল রয়েছে তার বড় রিজার্ভ লিবিয়ায় (৪৬.৪ বিলিয়ন, কারো মতে ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল) নাইজেরিয়ায় রয়েছে ৩৭.২ বিলিয়ন, আলজেরিয়ায় ১২.২ বিলিয়ন, আর অ্যাঙ্গোলায় ৯.৩ বিলিয়ন ব্যারেল। তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়াকে আইওসি কিভাবে একটি গরিব দেশে পরিণত করেছিল, তার ইতিহাস অনেকেই জানেন। তেলসম্পদ থাকা সত্ত্বেও নাইজেরিয়ার দারিদ্র্য কমেনি। বরং আইওসি সেনানায়কদের হাত করে (যেমন জেনারেল সানি আবাচা) দেশটির তেলসম্পদ নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। লিবিয়ার পরিস্থিতিও সেদিকে যাচ্ছে। স্মরণ করা যাক ইরাকের করুণ ইতিহাস। বিশ্বের দ্বিতীয় তেল রিজার্ভ ইরাকে। এ সম্পদের মালিক এখন আর ইরাকের জনগণ নয়। এর মালিক এখন আইওসি। ২০০৩ সালের যুদ্ধ আইওসিকে সেই সুযোগটিই করে দিয়েছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। ইরাক তার বড় প্রমাণ।
লিবিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। ওবামা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, গাদ্দাফির পতন নিশ্চিত করাই তাঁর লক্ষ্য। ইউরোপের দেশগুলোরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে লিবিয়ায়। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় আইওসি (ফ্রান্সের ঞড়ঃধষ, ইতালির ঊঘও, স্পেনের জঊচঝঙখ) লিবিয়ায় তেল উত্তোলন ও রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। লিবিয়া যে তেল রপ্তানি করে (অর্থাৎ বিক্রি করে), এর ২৫ ভাগ একা উৎপাদন করে ঊঘও (প্রতিদিন দুই লাখ ৪৪ হাজার ব্যারেল)। আর প্রতিদিন যে গ্যাস উৎপাদন হয় (দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট) তা গবষষরঃধয গ্যাসকেন্দ্র থেকে ৎেববহংঃৎবধস চরঢ়বষরহব-এর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের ওপারে সিসিলির (ইতালি) গেলা ও এন্মা বন্দরে সরবরাহ করা হয়। সংগত কারণে তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ থাকবে লিবিয়ার ব্যাপারে। ইতিমধ্যে ইইউ নেতারা গাদ্দাফিবিরোধীদের রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট হোসে ম্যানুয়েল বারোসো ওবামার সুরে সুর মিলিয়ে গাদ্দাফির পদত্যাগ দাবি করেছেন। হিলারি ক্লিনটন চলতি সপ্তাহেই যাচ্ছেন পূর্ব লিবিয়ায়। সেখানে তিনি গাদ্দাফিবিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিবিরোধী গ্রুপকে সমর্থন করছে। মনে রাখতে হবে, লিবিয়ার তেলকূপগুলোর ৮০ ভাগই পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার অর্থ হচ্ছে, তেলসম্পদের ওপর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এই তেলসম্পদের ওপরই যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গেল বছর দুটি মার্কিন আইওসি শেভরন ও অঙ্েিডন্টাল লিবিয়ায় তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিল। এখন তারাই আবার ফিরে আসছে। পূর্বাঞ্চল যদি সত্যি সত্যিই আলাদা হয়ে যায়, তাহলে তেলসম্পদের ওপর লিবিয়ান ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের কর্তৃত্ব আর থাকবে না। আইওসি এটাও চাইছে। কেননা বিশ্বের ১০০টি তেল কম্পানির মধ্যে লিবিয়ার ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের অবস্থান ২৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিতে আরো একটা বিষয় কাজ করছে। আর তা হচ্ছে, লিবিয়ায় চীনের প্রভাব কমানো। ইরানের মতো লিবিয়ার তেল সেক্টরে চীনের যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের সরকারি ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লিবিয়ায় তেল উত্তোলনে নিয়োজিত। লিবিয়া যে তেল রপ্তানি করে তার ১১ ভাগ যায় চীনে। চীনে তেলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। যে কারণে আফ্রিকায় চীনের (যেমন সুদানে) বিনিয়োগ অনেক বেশি। প্রায় ৩০ হাজার চীনা বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক লিবিয়ায় তেল উত্তোলনে জড়িত ছিল। এদের উদ্ধারের জন্য চীন ভূমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনীর একটি ইউনিটকে পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। লিবিয়ায় চীনের প্রভাব যদি কমানো যায়, তাহলে আইওসির জন্য তেলসম্পদ পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়া অনেক সহজ।
লিবিয়ার সংকট স্পষ্টতই সমগ্র আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র মাত্রই জানেন, ১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলনে আফ্রিকাকে বিভক্ত করা হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় তখন বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চলে। একুশ শতকে নতুন এক আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। কঙ্গো, রুয়ান্ডা কিংবা আইভরিকোস্টে ফ্রান্সের স্বার্থ ও প্রভাব থাকলেও, এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রও তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন লিবিয়ায় একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। কেননা লিবিয়াকে বলা হয় এ অঞ্চলে যাওয়ার 'গেটওয়ে'। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ফ্রেঞ্চ-ভাষী তিউনিসিয়ায় সরকারের পতন ঘটেছে। আর আলজেরিয়ায়ও সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে আফ্রিকায় অঋজওঈঙগ নামে নতুন একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী নাইজার ও সাদের প্রাকৃতিক সম্পদের (কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, ক্রোসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্লুটোনিয়াম) ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে নাইজারের ইউরেনিয়াম সম্পদ দেশটিকে 'লিবিয়ার মতো একটি পরিস্থিতির' দিকে ভবিষ্যতে ঠেলে দিতে পারে। আজ লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। যে অঞ্চল একসময় ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ, একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী চরিত্রের নতুন একটি রূপ।
বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছিল একটা ধারণাপত্র জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংবং, যেখানে বলা হয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা। আফগানিস্তান ও ইরাকের পর এখন লিবিয়া। আফগানিস্তান ও ইরাকে এখনো যুদ্ধ চলছে। আর যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে দেশ দুটিতে। আর তাতে লাভবান হচ্ছে কিছু ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। ইরাকে যেমনটি হয়েছিল। তেল বিক্রি করে দেশটির পুনর্গঠন। ঠিক তেমনটিই হতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। লিবিয়ার তেলসম্পদ (ইতালি, ফ্রান্স আর জার্মানির ৮৫ ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে) তাই যুদ্ধকে উস্কে দিয়েছে। এতে লিবিয়া ভাগ হয়ে গেলে আমি অবাক হব না। এ যুদ্ধে লিবিয়ার জনগণ উপকৃত হবে না। সেখানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং এতে লাভবান হবে বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো। আর আমরা, উন্নয়নশীল বিশ্ব এতে ক্ষতিগ্রস্ত হব। কেননা উচ্চমূল্যে আমাদের তেল কিনতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments