ফের টাকা নিচ্ছে যুবক by আবুল কাশেম
যুবক কমিশন গঠনের পর ছয় বছর কেটে গেছে। প্রতারিত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি সরকার। এ অবস্থায় কমিশন যখন যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ জোরদার করছে, তখনই জানা গেল যুবকের কর্মকর্তারা জমি দেওয়ার নাম করে আবারও টাকা নিচ্ছেন।
যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম যুবকের নতুন প্রতারণা রোধে সহায়তা চেয়ে পুলিশ সুপারদের (এসপি) চিঠি দিয়েছেন। নতুন করে টাকা নেওয়ার কথা এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন যুবকের নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুম। প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে দাবি করে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, বুকিং মানি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা, সঙ্গে দলিল খরচ নেওয়া হচ্ছে। যুবকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।
এদিকে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ৫০টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। কমিশনের অনুরোধ পাওয়ার পর এর আইনি দিক খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৬ সালে কমিশন গঠনের পর যুবক নতুন করে কোনো ব্যাংক হিসাব খুলে থাকলে তাও খুঁজে বের করে জব্দ করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে কমিশন। সরকারের কাছে যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করার ক্ষমতাও চেয়েছে কমিশন।
যুবকের গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, যুবকের পুরনো ৫০টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার বিষয়ে আইনগত জটিলতা পরীক্ষা করে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ২০০৬ সালে যুবক কমিশন গঠন করার পর যুবকের উদ্যোক্তারা যেসব ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করছেন, সেগুলো খুঁজে বের করে জব্দ করার জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে শিগগিরই অনুরোধ করা হবে।
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, 'যুবকের উদ্যোক্তারা নিজেদের লোকজনের মাধ্যমে জমি দেওয়ার নাম করে আবারও টাকা নেওয়া শুরু করেছেন। যুবক যাতে নতুন করে মানুষের সঙ্গে আর কোনো প্রতারণা করতে না পারে, সেজন্য সারা দেশের পুলিশ সুপারদের কাছে চিঠি লিখে সহযোগিতা চেয়েছি। এ ছাড়া যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করার ক্ষমতা সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে।'
এক প্রশ্নের উত্তরে যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, যুবকের যেসব জমি আছে, সেগুলোতে তারা নিজেরাই ভেজাল করে রেখেছে। বেশিরভাগ জমিই বন্ধক দেওয়া। আর সাভারে তাদের নামে কোনো জমি নেই।
যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিটি গত ২৮ মে দেশের সব পুলিশ সুপারদের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, 'গ্রাহকদের জমাকৃত অর্থ পরিশোধ করতে হলে যুবকের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি এবং প্রাপ্ত অর্থ থেকে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে যুবকের সম্পত্তির স্বত্ব-দখল যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত গ্রাহকগণ সম্পদ হারিয়ে যখন নিঃস্ব ও অসহায়ত্বের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে সময় যুবক সংস্থার উদ্যোগ ও উৎসাহে তাদের বিশ্বস্ত ও অনুগত কর্মচারী দ্বারা আবারও জমি দেওয়ার নাম করে গ্রাহকদের নিকট থেকে টাকা সংগ্রহের অপতৎপরতা চালাচ্ছে।'
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১৬ এপ্রিল যুবকের নামে পরিচালিত ৫০টি ব্যাংক হিসাবের স্থিতি জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করে কমিশন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) গত ৩ মে যুবকের গ্রাহকদের স্বার্থে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী ৩০ দিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে অনুরোধ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে অনুরোধ করে। ইনটেলিজেন্স ইউনিট এ সম্পর্কে আইনগত জটিলতা হবে কি না, তা জানতে চায় কমিশনের কাছে। এরপর গত ২৯ মে কমিশনের চেয়ারম্যান সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে চিঠি দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, কমিশনের কোনো আইনজীবী নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার মাধ্যমে কমিশন কাজ করছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীর মাধ্যমে জটিলতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর যুবকের ৫০টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার অনুরোধ জানান।
'বুকিং মানি নিচ্ছি' : মামলা আছে বলে গ্রেপ্তারের ভয়। বঞ্চিত গ্রাহকরাও বাগে পেলে ছাড়বে না। তাই গা-ঢাকা দিয়েই থাকেন যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) উদ্যোক্তারা। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলেও ধরেন না তাঁরা। এ অবস্থায় যুবকের নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুমের ই-মেইলে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়। এরপর তিনি নিজেই কালের কণ্ঠের এ প্রতিনিধির মোবাইল ফোনে কল দেন। জানান নিজেদের অবস্থান, কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। তিনি বলেন, যুবকের ব্যাংক হিসাব জব্দ বা কমিশনকে যুবকের সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা দেওয়া হলেই মামলা করবেন উদ্যোক্তারা। এমনকি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ৫৭ শতাংশ শেয়ারসহ বেহাত হওয়া সম্পদ উদ্ধারেও সময়মতো আইনের আশ্রয় নেবেন তাঁরা।
যুবকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'আমাদের যে প্লটগুলো আছে, সেগুলো এখন সদস্যদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। বুকিং মানি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা করে নিচ্ছি। আর সঙ্গে নিচ্ছি দলিল খরচ। দলিলের প্রকৃত খরচের চেয়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা বেশি নিচ্ছি, ঘুষ দিতে হচ্ছে তাই। এই টাকা নেওয়াকে কমিশন যদি বলে আমরা আবারও গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছি- তা ঠিক নয়।'
হোসাইন আল মাসুম দাবি করেন, কমিশন লাগবে না, তাঁরা নিজেরাই গ্রাহকদের অর্থ ফেরত বা সমন্বয় করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ''যুবকের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার চার বছর পর 'মরা কঙ্কালে'র ওপর কমিশন গঠন করা হয় ২০০৬ সালে। ড. ফরাসউদ্দিন কমিশনের পর নতুন কমিশন করা হয়েছে। এ ছয় বছরে কোনো গ্রাহকই অর্থ পায়নি, সেবাও পায়নি। যুবকের ব্যবসাও হয়নি। গ্রাহকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু টাকা নিচ্ছি। এভাবেই গ্রাহকদের অর্থের সমন্বয় করছি। আর এ ক্ষেত্রে কমিশন আমাদের কোনো সহায়তাও করছে না।''
ধানমণ্ডির জমি বিক্রি করে দেওয়ার কথা স্বীকার করে হোসাইন আল মাসুম বলেন, 'তা না হলে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেব কিভাবে।' যুবকের অনেক সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, গ্রাহকের বিনিয়োগের অর্থের চেয়ে এখন যুবকের সম্পত্তির মূল্য কম। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, বিএনপির চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমান ও বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর রোষানলে পড়ে সংস্থাটি কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে।
সাভার প্রকল্প থেকে জমি অন্যদের নামে দিয়ে দেওয়া সম্পর্কে মাসুম বলেন, 'সংকটে পড়ার সময় সাভারে আমাদের ৮০০ থেকে ৮৫০ বিঘা জমি ছিল রেজিস্ট্রি করা। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বায়না করা ১০০ বিঘা রেজিস্ট্রি করি। পরে জেলখানায় চলে গেলাম। তখন স্থানীয় দায়িত্বশীল গ্রাহকরা ৪০০ থেকে ৪৫০ বিঘা দলিল না হওয়া জমি নকল করে অন্য নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে ফেলে।'
ধানমণ্ডির জমি বিক্রি করে দেওয়ার কথা স্বীকার করে মাসুম বলেন, 'আমরা বিক্রি করছি। কমিশনও তা জানে। ফরাসউদ্দিন সাহেবও জানেন। যিনি কিনেছেন তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেই কিনেছেন। বিক্রি না করলে ক্যাশ পাব না। তাহলে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেব কিভাবে? আবার কিনছিও। ৬০০ কোটি টাকার বেশি গ্রাহকদের পরিশোধ করেছি। এর মধ্যে ৪০০ কোটি টাকা সমন্বয় করেছি তিন হাজার ৬৫৬টি প্লটের বিপরীতে। আর বাকি ২০০ কোটি টাকা নগদ সমন্বয় করেছি। এর মধ্যে ১৬৫ কোটি টাকা কোন কোন গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে, এর তালিকাও কমিশনে পাঠিয়েছি।'
হোসাইন আল মাসুমের এসব কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সাভারে কার্যত তাঁদের কোনো জমি নেই। কারণ, তাঁদের জমির অবস্থান যেমন নেই, তেমনি মালিকানার কাগজপত্রও নেই। কমিশনের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'সব ভুয়া'।
No comments