ইতি-নেতি-সরকারের উচিত খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া by মাসুদা ভাট্টি

বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে, রয়েছে একটি বিরোধী দল, একটি সংসদ-এসবের সরল অর্থ হচ্ছে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিদ্যমান। আর একটু বাড়িয়ে বললে, দেশের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার মৌলিক বিষয় অর্থাৎ বাকস্বাধীনতার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে।


আর এ কারণেই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া জনসভায় দাঁড়িয়ে বলতে পারছেন, 'বিডিআরের হত্যাকাণ্ডের মতো আরো ঘটনা সেনাবাহিনীতে ঘটতে পারে।' আমরা ধরে নিচ্ছি তিনি এ রকম একটি আশঙ্কা করেছেন, নইলে তাঁর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন একটি চরম নেতিবাচক ও ভয়ংকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইতে পারেন না, চাওয়া উচিতও নয়। বিডিআর বিদ্রোহ বা পিলখানা ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভয়ংকর ক্ষত, সন্দেহ নেই। এই ক্ষত ফিরে আসুক কিংবা এর পুনরাবৃত্তি ঘটুক, কোনো সুস্থ বিবেকের পক্ষে তা চাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু খালেদা জিয়া স্পষ্ট করেই মহানগর নাট্যমঞ্চে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে বলেছেন, 'সশস্ত্র বাহিনীতে পিলখানা বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর প্রচ্ছন্ন হুমকির কথাও শোনা যাচ্ছে।' বাক্যটি যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এখানে খালেদা জিয়ার কাছে প্রথম প্রশ্ন-তিনি যদি এ রকম একটি হুমকি সম্পর্কে জেনে থাকেন তাহলে তা প্রশমনে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? নাকি প্রতিপক্ষ সরকারকে ঘায়েল করতে তিনি এ হুমকির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন? তিনি যদি এ ভয়ংকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কার বিষয়টি জানেন এবং প্রকৃতই এমন কিছু ঘটে তাহলে আইনের চোখে তিনিও সমান দোষী হবেন-এ বিষয়টি আশা করি তাঁর জানা। মজার ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে-সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের একটি দল সে কথা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিল। জেনারেল জিয়া সরকারি পদে কর্মরত থেকেও বলেছিলেন, তিনি নিজে অংশ না নিলেও দলটি যদি এগিয়ে যেতে চায় তাতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের কথা জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে না জানানো কিংবা তিনি নিজেও চাইলেই তখন ওই জুনিয়র অফিসারদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রাখতেন কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি এবং বাংলাদেশ দেখেছে পঁচাত্তরের মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। সেই হত্যাকাণ্ডের দায় জিয়াউর রহমান চাইলেও এড়াতে পারবেন না এবং তিনি এর প্রত্যক্ষ বেনিফিশিয়ারিই শুধু নন, তিনি হত্যাকারীদের পুরস্কৃৃত করেছেন, আইন করে হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে হত্যাকারীদের নানা ক্ষেত্রে পুনর্বাসন করেছেন। এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীদের তুলনায় জেনারেল জিয়ার অপরাধ খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ বারবার রাজনীতিবিদ, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে-ষড়যন্ত্র এ-দেশ ও এ-দেশের মানুষ অনেক দেখেছে, আর নয়। এবার ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সবার এগিয়ে আসা উচিত। দুই বছর আগে যখন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে তখন দেশে একটি সদ্য নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। একটি দীর্ঘ অরাজনীতির কাল শেষে কেবলই একটি নির্বাচন হয়েছে এবং সবাই এ নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু বলে রায় দিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে সামান্য রেশন কিংবা কিছু দাবি-দাওয়ার জন্য দেশের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এ রকম একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে, গোয়েন্দা নজর এড়িয়ে হত্যাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনাও করতে পারে, এটা আসলে কতটা বিশ্বাসযোগ্য-এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু সেই বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতরে যে চরম অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, যা মূলত একটি গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হতেই পারত, তা সফলভাবে ঠেকানোই ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের একমাত্র দায়িত্ব এবং আমরা দেখেছি, সরকার দক্ষতার সঙ্গে তা করতে পেরেছে। এ জন্য দেশে-বিদেশে সরকার প্রশংসিত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মতো ভূরাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন কোনো দেশে যদি অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এর প্রভাব দ্রুতই প্রতিবেশী দেশকে প্রভাবিত করবে।
এরপর বিডিআর বিদ্রোহের কারণ ও ঘটনা সম্পর্কে নানাজন নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দেশের প্রচলিত আইনে বিদ্রোহীদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে এবং অনেকেরই নানা মেয়াদে শাস্তিও হয়েছে। এর মধ্যে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, কারাভ্যন্তরে শতাধিক বিডিআর সদস্যের রহস্যজনক মৃত্যু। এ মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারশন্যাল কারাভ্যন্তরে এই মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দল এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছে এবং করেছেও। বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে আজকে বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ থাকলেও একই কাজ করত। জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল একমত হবে, এমন উদাহরণ আমাদের দেশে নেই, কেবল সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির সুযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্র ছাড়া। অন্য সব ক্ষেত্রেই সরকার যা করবে, বিরোধী দল তা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আন্দোলনের হুমকি দেবে এবং কথায় কথায় সরকারকে টেনেহিঁচড়ে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইবে। আর সরকার বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে দেবে না, রাজপথে নামলে পুলিশ দিয়ে পেটাবে এবং কারণে-অকারণে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কাতারে কাতারে জেলে পুরবে-দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ধারাবাহিকতা।
বর্তমান সরকারের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা, শেয়ারবাজারকে কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে বিপর্যয় ডেকে আনা, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ বা গ্যাস সরবরাহ করতে না পারা এবং এ কারণে দেশে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা, প্রশাসনকে গতিশীল করতে না পারা ইত্যাদি দীর্ঘ তালিকা দেওয়া সম্ভব। অন্যদিকে এ সরকারের সাফল্যের তালিকায় বিডিআর বিদ্রোহকে সফলভাবে সামাল দেওয়া, নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ যেমন-শিক্ষানীতি ও শিশুনীতি প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ইতিবাচক ইমেজ প্রতিষ্ঠা উল্লেখযোগ্য। এখন প্রশ্ন হলো, একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশে একটি নির্বাচিত সরকারের পক্ষে কতটা যোগ্যতা ও সফলতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা সম্ভব? বিশেষ করে এখনো যেখানে কোনো সুষ্ঠু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সামাজিক অস্থিরতা বিগত দশকে কেবল বেড়েছেই, কমেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই যে বিপুল জনসংখ্যা-ভার এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে দেশে দেশে মন্দাভাব এবং সর্বোপরি খাদ্যদ্রব্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া-এসবের প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পড়তে বাধ্য। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের পক্ষে একেবারে সুস্থতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা অসম্ভব। বর্তমান সরকারও দুই বছরের মাথায় এসে এ বিতণ্ডায় পড়েছে। এমতাবস্থায় বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যে যে নতুনতর বিপদের আভাস বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো আতঙ্কের। খালেদা জিয়ার উচিত অবিলম্বে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে বিপদমুক্ত করা। একজন জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশ রক্তপাত কম দেখেনি। গণতন্ত্রের জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার কথা আমাদের নেতারা হরহামেশাই বলেন। কেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র এতটা রুদ্ররূপী 'রক্তখাগি' তা আমার বোধগম্য নয়। খালেদা জিয়ার আমলেই আমরা দেখেছি একের পর এক রাজনৈতিক নেতা মারা যাচ্ছেন গ্রেনেড হামলায়, বিরোধীদলীয় নেতার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় অর্ধশত মানুষ। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে সরকারেরই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তে গঠিত কমিটি যে হাস্যকর তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তা জাতিকে চরম হতাশায় ফেলেছিল। এমনকি দেশব্যাপী বোমা হামলা ঘটানোর কারিগররাও জোট সরকারের কাছে ছিল মিডিয়ার সৃষ্টি। সুতরাং খালেদা জিয়া যখন সশস্ত্র বাহিনীতে ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনার ইঙ্গিত জনগণকে দেন তখন তা যুক্তিগ্রাহ্য ও সিরিয়াসলি গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখে। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করবে এবং এ রকম ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সে জন্য আগে থেকেই পদক্ষেপ নেবে। রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতায় থাকা এবং রক্তপাত মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া অতীতে বাংলাদেশ দেখেছে, আর দেখতে চায় না।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor-ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.