সময়ের প্রতিধ্বনি-আরব বিশ্বে রাজনৈতিক সুনামি এবং বাংলাদেশের শ্রমবাজার by মোস্তফা কামাল
আরব বিশ্বজুড়ে এখন রাজনৈতিক সুনামি চলছে। সেই সুনামি আঘাত হানছে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এর ঢেউ লাগতে শুরু করেছে। আন্দোলনের ভয়ে তটস্থ আলজেরিয়া, জর্দান, ইয়েমেন, মরক্কো, বাহরাইন, এমনকি সৌদি আরবও।
তিউনিসিয়ায় বেন আলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সুনামি শুরু হয়। তাতে ঝরে পড়েন বেন আলী। তারপর আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে মিসরে। মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতনের পর সে দেশে আপাতত ঝড় থেমে গেলেও সংকট এখনো রয়ে গেছে। এরই মধ্যে গভীর সংকটে পড়েছে লিবিয়া।
লিবিয়ায় রাজনৈতিক সংকট এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে জনগণের তোপের মুখে যেকোনো মুহূর্তে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে; যদিও তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে হুংকার দিয়ে বলেন, 'হয় আমাকে সমর্থন করো, না-হলে কারো স্বপ্নসাধ পূরণ হবে না। আমি পুরো লিবিয়া জ্বালিয়ে দেব।' তিনি অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দেওয়ারও হুমকি দেন এবং তাঁর সমর্থকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেই ঘোষণা যে পুরোটাই ফাঁপা, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ছাড়া আর সবই আন্দোলনকারীদের দখলে চলে গেছে। সে দেশের সেনাবাহিনীর বড় অংশ আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সিভিল প্রশাসনও সরকারকে খুব একটা সহযোগিতা করছে না। লিবিয়ার কয়েকজন মন্ত্রী এবং নিউ ইয়র্ক, ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশে নিযুক্ত লিবীয় রাষ্ট্রদূত পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা আর একনায়ক গাদ্দাফির পক্ষে কাজ করতে চান না। তাঁরা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
জনগণের ওপর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে লিবিয়ার পদত্যাগী বিচারমন্ত্রী মুস্তাফা আবদেল জলিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। লিবিয়ার এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, সেখানে প্রশাসন বলতে কিছু নেই। প্রতিদিনই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাদ্দাফির সমর্থকদের সংঘর্ষ হচ্ছে। তাঁর সমর্থকরা আন্দোলনকারী ছাড়াও বিদেশিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। তবে গাদ্দাফির সমর্থকদের এখনো সেনাবাহিনীর একটি অংশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে গাদ্দাফি মনে করছেন, তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত টিকে যাবেন। কিন্তু আন্দোলনের গতিধারা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি টিকতে পারবেন না।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত শনিবার সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া এ সিদ্ধান্তে তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। একই দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের জন্য গাদ্দাফির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মিসরের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক আগামী নির্বাচন (অক্টোবর) পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। এসব বলে তিনি কালক্ষেপণের একটা চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সময়টা পার করতে পারলেই তিনি বেঁচে যাবেন। আন্দোলনকারীরা হয়তো তাঁর চালাকি বুঝতে পেরেছিল, তাই তারা তাঁকে আর সময় দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছেন।
হোসনি মুবারকের পলায়নের মধ্য দিয়ে মিসরে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও সংকট কাটেনি। সেখানে সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের বেশির ভাগ মানুষ হোসনি মুবারকের সমর্থক। একজন ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও প্রশাসনে এখনো মুবারকের ছায়া। এটা আন্দোলনকারীরাও টের পাচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদেরও কিছুই করার নেই। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতেই হবে।
অবশ্য সবার দৃষ্টি এখন প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ার দিকে। গাদ্দাফির ৪১ বছরের মসনদ কখন ভেঙে খানখান হবে, এর অপেক্ষায় আছে আন্দোলনকারীরা। গাদ্দাফি যতই তর্জন-গর্জন করছেন, আন্দোলনকারীরা ততটাই ফুঁসে উঠছে। আর এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সে দেশের সাধারণ মানুষ এবং সেখানে কর্মরত বিদেশিরা। আতঙ্ক আর ভয়ের মধ্যে তাঁদের সেখানে দিন কাটছে। তাঁরা পালাবারও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সরকারি হিসাব মতে, লিবিয়ায় প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। তাঁদের সহযোগিতার জন্য সেখানে কেউ নেই। লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি নিজের বাসা ছেড়ে দূতাবাসে উঠেছেন। সেখানে দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের জীবনও সঙ্গিন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি কী তা আমরা এখনো জানি না। সরকার বাংলাদেশিদের সেখানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেছে।
সরকার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের সঙ্গে আলোচনা করলেও তারা কোনো সহযোগিতাই করতে পারছে না। আইওএম বলেছে, তাদের পক্ষেও লিবিয়ায় প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে সেখানে মানুষের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কী? নিশ্চয়ই করণীয় আছে। আরো কয়েকটি দেশের নাগরিক সেখানে আটকা পড়েছে। কেবল আমেরিকান নাগরিকদের সে দেশের সামরিক বাহিনীর বিশেষ বিমানে করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশের নাগরিকরা এখনো সেখানে অবস্থান করছে। সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা করতে পারে।
এখন অবস্থাটা এমন, সবাই যেন সমাধান খুঁজছে। কিন্তু কোনো সহজ সমাধান পাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ধৈর্যধারণ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু যেসব পরিবারের সদস্যরা লিবিয়ায় আটকা পড়েছে, কেবল তারাই বুঝতে পারে ধৈর্যধারণ করা কত কঠিন!
প্রিয় পাঠক, আপনারাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল, 'বাংলাদেশিরা মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন।' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাদ্দাফি-বিরোধী সহিংস বিক্ষোভের কারণে লিবিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশিদের প্রতিবেশী মিসর তার ভূখণ্ডে ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আরেকটি খবর বেরিয়েছে, সরকার বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে লিবিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশিদের একটা গতি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ৬০ হাজার বাংলাদেশির আশ্রয় সেখানে মিলবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এ কাজটি সমন্বয়ের জন্য যে জনবল দরকার তা সেখানে নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিসর, লিবিয়া ও মরক্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশ থেকেও অতিরিক্ত জনবল পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের কাছে তথ্য আছে, লিবিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার পর সেখানে ব্যাপক উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছিল। অবকাঠামো, যোগাযোগ ও শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হওয়ায় সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা তৈরি হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে লক্ষাধিক কর্মীর চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হতো। সেখানে কয়েক হাজার কর্মী যাওয়াও শুরু করেছিল। এরই মধ্যে ঘটে অঘটন।
তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার রাজনৈতিক সংকটে থমকে গেছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য। এরপর আফ্রিকান মুসলিম দেশগুলো। আকস্মিক রাজনৈতিক সুনামি বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আরব দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সিরিয়া, মিসর, বাহরাইন, লিবিয়া ও জর্দানে ৫৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন। এসব দেশে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ লাখের বেশি জনশক্তি রপ্তানি করা হয়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনশক্তি রপ্তানি তো দূরের কথা, হাজার হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে আসতে হতে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রেমিট্যান্স আয়ের ওপর। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রবাসীরা পাঠিয়ে থাকেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও অশনি সংকেত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠক ডাকা উচিত। দল-মত নির্বিশেষে সবার পরামর্শক্রমে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। যেসব দেশ আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি করে তারা কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, সেটাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি করে। এসব দেশ থেকেও অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই বসে নেই। কারণ ওইসব দেশের নাগরিকরাও লিবিয়ায় আটকা পড়েছেন। তাদের জনশক্তি রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়েছে। কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করবে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। যদিও অনেকে মিসর, লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও কামনা করছেন। কেউ কেউ এখনই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের প্রতি অনুরোধ, এসব দিবাস্বপ্ন না দেখে বাস্তবতায় ফিরে আসুন এবং অসহায় ও বিপদে পড়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
লিবিয়ায় রাজনৈতিক সংকট এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে জনগণের তোপের মুখে যেকোনো মুহূর্তে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে; যদিও তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে হুংকার দিয়ে বলেন, 'হয় আমাকে সমর্থন করো, না-হলে কারো স্বপ্নসাধ পূরণ হবে না। আমি পুরো লিবিয়া জ্বালিয়ে দেব।' তিনি অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দেওয়ারও হুমকি দেন এবং তাঁর সমর্থকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেই ঘোষণা যে পুরোটাই ফাঁপা, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি ছাড়া আর সবই আন্দোলনকারীদের দখলে চলে গেছে। সে দেশের সেনাবাহিনীর বড় অংশ আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সিভিল প্রশাসনও সরকারকে খুব একটা সহযোগিতা করছে না। লিবিয়ার কয়েকজন মন্ত্রী এবং নিউ ইয়র্ক, ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশে নিযুক্ত লিবীয় রাষ্ট্রদূত পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা আর একনায়ক গাদ্দাফির পক্ষে কাজ করতে চান না। তাঁরা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
জনগণের ওপর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে লিবিয়ার পদত্যাগী বিচারমন্ত্রী মুস্তাফা আবদেল জলিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। লিবিয়ার এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, সেখানে প্রশাসন বলতে কিছু নেই। প্রতিদিনই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাদ্দাফির সমর্থকদের সংঘর্ষ হচ্ছে। তাঁর সমর্থকরা আন্দোলনকারী ছাড়াও বিদেশিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। তবে গাদ্দাফির সমর্থকদের এখনো সেনাবাহিনীর একটি অংশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে গাদ্দাফি মনে করছেন, তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত টিকে যাবেন। কিন্তু আন্দোলনের গতিধারা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি টিকতে পারবেন না।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত শনিবার সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া এ সিদ্ধান্তে তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। একই দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের জন্য গাদ্দাফির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মিসরের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক আগামী নির্বাচন (অক্টোবর) পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। এসব বলে তিনি কালক্ষেপণের একটা চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সময়টা পার করতে পারলেই তিনি বেঁচে যাবেন। আন্দোলনকারীরা হয়তো তাঁর চালাকি বুঝতে পেরেছিল, তাই তারা তাঁকে আর সময় দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছেন।
হোসনি মুবারকের পলায়নের মধ্য দিয়ে মিসরে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও সংকট কাটেনি। সেখানে সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের বেশির ভাগ মানুষ হোসনি মুবারকের সমর্থক। একজন ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও প্রশাসনে এখনো মুবারকের ছায়া। এটা আন্দোলনকারীরাও টের পাচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদেরও কিছুই করার নেই। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতেই হবে।
অবশ্য সবার দৃষ্টি এখন প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ার দিকে। গাদ্দাফির ৪১ বছরের মসনদ কখন ভেঙে খানখান হবে, এর অপেক্ষায় আছে আন্দোলনকারীরা। গাদ্দাফি যতই তর্জন-গর্জন করছেন, আন্দোলনকারীরা ততটাই ফুঁসে উঠছে। আর এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সে দেশের সাধারণ মানুষ এবং সেখানে কর্মরত বিদেশিরা। আতঙ্ক আর ভয়ের মধ্যে তাঁদের সেখানে দিন কাটছে। তাঁরা পালাবারও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সরকারি হিসাব মতে, লিবিয়ায় প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। তাঁদের সহযোগিতার জন্য সেখানে কেউ নেই। লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি নিজের বাসা ছেড়ে দূতাবাসে উঠেছেন। সেখানে দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের জীবনও সঙ্গিন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি কী তা আমরা এখনো জানি না। সরকার বাংলাদেশিদের সেখানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেছে।
সরকার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের সঙ্গে আলোচনা করলেও তারা কোনো সহযোগিতাই করতে পারছে না। আইওএম বলেছে, তাদের পক্ষেও লিবিয়ায় প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে সেখানে মানুষের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কী? নিশ্চয়ই করণীয় আছে। আরো কয়েকটি দেশের নাগরিক সেখানে আটকা পড়েছে। কেবল আমেরিকান নাগরিকদের সে দেশের সামরিক বাহিনীর বিশেষ বিমানে করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশের নাগরিকরা এখনো সেখানে অবস্থান করছে। সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা করতে পারে।
এখন অবস্থাটা এমন, সবাই যেন সমাধান খুঁজছে। কিন্তু কোনো সহজ সমাধান পাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ধৈর্যধারণ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু যেসব পরিবারের সদস্যরা লিবিয়ায় আটকা পড়েছে, কেবল তারাই বুঝতে পারে ধৈর্যধারণ করা কত কঠিন!
প্রিয় পাঠক, আপনারাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল, 'বাংলাদেশিরা মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন।' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাদ্দাফি-বিরোধী সহিংস বিক্ষোভের কারণে লিবিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশিদের প্রতিবেশী মিসর তার ভূখণ্ডে ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আরেকটি খবর বেরিয়েছে, সরকার বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে লিবিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশিদের একটা গতি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ৬০ হাজার বাংলাদেশির আশ্রয় সেখানে মিলবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এ কাজটি সমন্বয়ের জন্য যে জনবল দরকার তা সেখানে নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিসর, লিবিয়া ও মরক্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশ থেকেও অতিরিক্ত জনবল পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের কাছে তথ্য আছে, লিবিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার পর সেখানে ব্যাপক উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছিল। অবকাঠামো, যোগাযোগ ও শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হওয়ায় সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা তৈরি হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে লক্ষাধিক কর্মীর চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হতো। সেখানে কয়েক হাজার কর্মী যাওয়াও শুরু করেছিল। এরই মধ্যে ঘটে অঘটন।
তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার রাজনৈতিক সংকটে থমকে গেছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য। এরপর আফ্রিকান মুসলিম দেশগুলো। আকস্মিক রাজনৈতিক সুনামি বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, আরব দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সিরিয়া, মিসর, বাহরাইন, লিবিয়া ও জর্দানে ৫৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন। এসব দেশে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ লাখের বেশি জনশক্তি রপ্তানি করা হয়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনশক্তি রপ্তানি তো দূরের কথা, হাজার হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে আসতে হতে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রেমিট্যান্স আয়ের ওপর। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রবাসীরা পাঠিয়ে থাকেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও অশনি সংকেত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠক ডাকা উচিত। দল-মত নির্বিশেষে সবার পরামর্শক্রমে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। যেসব দেশ আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি করে তারা কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, সেটাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি করে। এসব দেশ থেকেও অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই বসে নেই। কারণ ওইসব দেশের নাগরিকরাও লিবিয়ায় আটকা পড়েছেন। তাদের জনশক্তি রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়েছে। কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করবে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। যদিও অনেকে মিসর, লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও কামনা করছেন। কেউ কেউ এখনই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের প্রতি অনুরোধ, এসব দিবাস্বপ্ন না দেখে বাস্তবতায় ফিরে আসুন এবং অসহায় ও বিপদে পড়া মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments