নিগমানন্দ, গোপীনাথ বা অন্য কেউ by শেখ রোকন
বহুল আলোচিত যোগগুরু স্বামী রামদেবের ততোধিক নাটকীয় 'অনশন' নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিতে যখন ঝড় তুলেছিল; ঠিক সেই সময়ে নিভৃতে প্রাণ ত্যাগ করেছেন আরেক স্বামী নিগমানন্দ। গঙ্গার বুক থেকে তোলা পাথর ভাঙায় খোদ নদী এবং আশপাশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য যে দূষণের শিকার হচ্ছে, তা বন্ধের দাবিতে মৃত্যুর ১১৪ দিন আগে, ১৯ ফেব্রুয়ারি অনশনে বসেছিলেন মাত্র ৩৪ বছর বয়সী এই স্বামী।
মে মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে তিনি কোমায় ছিলেন। ১৩ জুন তিনি যখন উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো পার করছিলেন, পাশেই কালো টাকার বিরুদ্ধে জিহাদে নামা প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হওয়া স্বামী রামদেবকে ফলের রস খাওয়ানো নিয়ে তুলকালাম চলছিল। রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ রামদেবকে নিয়ে উচ্চকিত থাকলেও পাশের কেবিনে থাকা নিগমানন্দের দিকে ফিরেও চাননি। কিন্তু তাতে কি? নদী রক্ষার ইতিহাসে স্বামী নিগমানন্দের নাম নিঃসন্দেহে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বস্তুত যারা কাজ করেন, তারা হৈচৈ করতে চান না। রামদেবরা কাজের চেয়ে হৈচৈ বেশি করে লাভের ঝোল পাতে টানতে চান। আর নিগমানন্দরা প্রাণ বিলিয়ে দেন বিনা বাক্যব্যয়ে। অন্যসব ক্ষেত্রের কথা বাদ; এমন নিঃস্বার্থ কত মানুষ আমাদের স্বার্থপর পৃথিবীতে নদী রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পাশের পশ্চিমবঙ্গেই গোপীনাথের 'গঙ্গাদূষণ রুখতে নীরব আন্দোলন' সম্পর্কে পড়েছিলাম কিছুদিন আগের আনন্দবাজারে। বলাবাহুল্য, গঙ্গা তার গোটা গতিপথে পাড়ে অবস্থিত ২৯টি নগরী, ৭০টি শহর ও হাজার হাজার গ্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় যে ১৩০ কোটি লিটার তরল বর্জ্য এবং আরও ২৬০ মিলিয়ন লিটার শিল্পবর্জ্য গ্রহণ করে, তা পরিষ্কার করার সাধ্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ও সমন্বিত বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ। কিন্তু নবদ্বীপের ওই ভদ্রলোক তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নবদ্বীপের তীর্থক্ষেত্রে সারা বছরই পুণ্যার্থীর ভিড় লেগে থাকে। প্রতিদিন ভোরে যখন শত শত পূজারি গঙ্গার দুই পাড় থেকে ফুল পাতা ঘট ভাসিয়ে দেন বা প্রতিমা বিসর্জন করেন; গোপীনাথ বৈষ্ণব তখন ঝাঁটা, ঝুড়ি ও কোদাল নিয়ে এ-ঘাট সে-ঘাট ঘুরে বেড়ান। এক দশক ধরে তিনি এ কাজ করছেন। না করেছেন পুরস্কারের প্রত্যাশা, না করেছেন সামাজিকতার পরোয়া।
সমকালের এই কলামেই কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম ব্রাজিলের হোসে ক্লদিও রিবেইরো দ্য সিলভার কথা। আমাজোন নদীধারার বনাঞ্চলে অবৈধ উজাড়িকরণ ও দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে গিয়ে তিনি মে মাসের শেষ দিকে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ছয় মাস ধরে নানা হুমকি ও হয়রানি সত্ত্বেও আমাজোন রক্ষায় আপস করেননি। একই কাতারে বলা যায় নদীপ্রেমিক আমেরিকান গ্গ্নেন রস সুটকেকের কথাও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের সাবেল নির্বাহী পরিচালক প্যাট্রিক ম্যাককেলির ভাষায়_ 'গ্গ্নেন হচ্ছেন নদী রক্ষা আন্দোলনকারীদের জন্য অতিপ্রিয় অনুপ্রেরণা ও শিক্ষক এবং নদী ধ্বংসকারী রাজনীতিক ও আমলাদের জন্য একটি কার্যকর কাঁটা।' ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকায় গত দুই দশকের নদী রক্ষা আন্দোলনে গ্গ্নেন হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য নাম। নব্বই দশকের মাঝামাঝি প্যারাগুয়ে-পারানা রিভার সিস্টেম রক্ষায় 'রিয়োস ভিভোস নেটওয়ার্ক' নামে তার আন্দোলন পরিবেশ ও অধিকার রক্ষার ইতিহাসে অবশ্যপাঠ্য। নাওয়া-খাওয়া ভুলে নদীর জন্য দাবড়ে বেড়াতে গিয়েই তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন; কিন্তু দমেননি। ২০১০ সালের গোড়ায় মৃত্যুর পর তাকে নিয়েও লিখেছিলাম সমকালে।
বাংলাদেশের নদীগুলোও ভালো নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগও চলছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে এমনকি কেউ আছেন, যাকে নিয়ে গর্বভরে লিখতে পারি?
skrokon@gmail.com
বস্তুত যারা কাজ করেন, তারা হৈচৈ করতে চান না। রামদেবরা কাজের চেয়ে হৈচৈ বেশি করে লাভের ঝোল পাতে টানতে চান। আর নিগমানন্দরা প্রাণ বিলিয়ে দেন বিনা বাক্যব্যয়ে। অন্যসব ক্ষেত্রের কথা বাদ; এমন নিঃস্বার্থ কত মানুষ আমাদের স্বার্থপর পৃথিবীতে নদী রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পাশের পশ্চিমবঙ্গেই গোপীনাথের 'গঙ্গাদূষণ রুখতে নীরব আন্দোলন' সম্পর্কে পড়েছিলাম কিছুদিন আগের আনন্দবাজারে। বলাবাহুল্য, গঙ্গা তার গোটা গতিপথে পাড়ে অবস্থিত ২৯টি নগরী, ৭০টি শহর ও হাজার হাজার গ্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় যে ১৩০ কোটি লিটার তরল বর্জ্য এবং আরও ২৬০ মিলিয়ন লিটার শিল্পবর্জ্য গ্রহণ করে, তা পরিষ্কার করার সাধ্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ও সমন্বিত বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ। কিন্তু নবদ্বীপের ওই ভদ্রলোক তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নবদ্বীপের তীর্থক্ষেত্রে সারা বছরই পুণ্যার্থীর ভিড় লেগে থাকে। প্রতিদিন ভোরে যখন শত শত পূজারি গঙ্গার দুই পাড় থেকে ফুল পাতা ঘট ভাসিয়ে দেন বা প্রতিমা বিসর্জন করেন; গোপীনাথ বৈষ্ণব তখন ঝাঁটা, ঝুড়ি ও কোদাল নিয়ে এ-ঘাট সে-ঘাট ঘুরে বেড়ান। এক দশক ধরে তিনি এ কাজ করছেন। না করেছেন পুরস্কারের প্রত্যাশা, না করেছেন সামাজিকতার পরোয়া।
সমকালের এই কলামেই কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম ব্রাজিলের হোসে ক্লদিও রিবেইরো দ্য সিলভার কথা। আমাজোন নদীধারার বনাঞ্চলে অবৈধ উজাড়িকরণ ও দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে গিয়ে তিনি মে মাসের শেষ দিকে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ছয় মাস ধরে নানা হুমকি ও হয়রানি সত্ত্বেও আমাজোন রক্ষায় আপস করেননি। একই কাতারে বলা যায় নদীপ্রেমিক আমেরিকান গ্গ্নেন রস সুটকেকের কথাও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের সাবেল নির্বাহী পরিচালক প্যাট্রিক ম্যাককেলির ভাষায়_ 'গ্গ্নেন হচ্ছেন নদী রক্ষা আন্দোলনকারীদের জন্য অতিপ্রিয় অনুপ্রেরণা ও শিক্ষক এবং নদী ধ্বংসকারী রাজনীতিক ও আমলাদের জন্য একটি কার্যকর কাঁটা।' ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকায় গত দুই দশকের নদী রক্ষা আন্দোলনে গ্গ্নেন হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য নাম। নব্বই দশকের মাঝামাঝি প্যারাগুয়ে-পারানা রিভার সিস্টেম রক্ষায় 'রিয়োস ভিভোস নেটওয়ার্ক' নামে তার আন্দোলন পরিবেশ ও অধিকার রক্ষার ইতিহাসে অবশ্যপাঠ্য। নাওয়া-খাওয়া ভুলে নদীর জন্য দাবড়ে বেড়াতে গিয়েই তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন; কিন্তু দমেননি। ২০১০ সালের গোড়ায় মৃত্যুর পর তাকে নিয়েও লিখেছিলাম সমকালে।
বাংলাদেশের নদীগুলোও ভালো নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগও চলছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে এমনকি কেউ আছেন, যাকে নিয়ে গর্বভরে লিখতে পারি?
skrokon@gmail.com
No comments