মত দ্বিমত-উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা গ্রহণযোগ্য নয় by এম এম আকাশ
কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এক পক্ষ বলছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলন করলে এই জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব। অন্য পক্ষ বলছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশিদের স্বার্থই বেশি রক্ষিত হবে। তবে উভয় পক্ষ সময়ক্ষেপণ না করে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে এখানে একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও একজন অর্থনীতিবিদের লেখা প্রকাশ করা হলো।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কয়লার যে মজুদ আছে, তা কীভাবে উত্তোলন করে বিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি অমীমাংসিত বিতর্ক চলছে। ‘তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সুস্পষ্ট ঘোষিত অবস্থান হচ্ছে, ‘রপ্তানি না, বিদেশি মালিকানা না এবং উন্মুক্ত পদ্ধতির খনন না’। এ ব্যাপারে তারা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলনে নিয়োজিত আছে। এ আন্দোলনে একাধিক লোক শহীদ হয়েছেন, বহু লোক পঙ্গু হয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন। তাঁদের আন্দোলনের কারণেই এশিয়া এনার্জি নামের বিদেশি কোম্পানিটি ফুলবাড়িতে এখন পর্যন্ত সামান্য রয়্যালটির বিনিময়ে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটিয়ে বিপুল কয়লাসম্পদ রপ্তানি করতে সক্ষম হয়নি। এ জন্য ফুলবাড়ির জনগণকে অভিনন্দন জানাই। তাঁদের সংগ্রাম এমন মাত্রায় উপনীত হয়েছিল যে তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উভয়েই ফুলবাড়ির সংগ্রামী জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে কোথাও আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ের কোনো চেষ্টা তাঁরা করবেন না।
মনে হয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ‘জ্বালানিসম্পদ’ ও ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’র সভার তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করেন বলেই একাধিকবার এমন কথাও বলেছেন যে সীমিত অনবায়নযোগ্য জ্বালানিসম্পদ (তা গ্যাস হোক বা কয়লা হোক) দেশের জন্য আগামী ৫০ বছরের (২০৫০) মজুদ রেখেই রপ্তানি করা হবে, তার আগে নয়। এ জন্য তাঁকে বৈদেশিক শক্তি অতীতে ক্ষমতায় পর্যন্ত যেতে দেয়নি—এ রকম গুরুতর অভিযোগও তিনি একাধিকবার করেছেন। এ থেকে অনুমিত হয় যে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কয়লা রপ্তানির বিরুদ্ধেই হয়তো অবস্থান গ্রহণ করবে। যদিও বর্তমান সরকারের অংশীদার রাশেদ খান মেননের অনবায়নযোগ্য সম্পদ রপ্তানিবিরোধী একটি বিল এখন পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে সংসদে উত্থাপনের অপেক্ষায় লাইনবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছে। ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ প্রধান যুক্তি হচ্ছে, ‘উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি, রপ্তানি ও বিদেশি মালিকানার’ বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও এগুলো পরস্পর পরিপূরক এবং একটি বৈদেশিক স্বার্থ প্রণোদিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী ‘প্যাকেজ ডিল’ মাত্র। তাদের মতে, উন্মুক্ত খননের জন্য এশিয়া এনার্জির মতো বিদেশি কোম্পানিরা উন্মুখ হয়ে আছে এই কারণে যে এতে একসঙ্গে এত বিপুল পরিমাণে কয়লা উত্তোলন সম্ভব হবে যে তখন উদ্বৃত্ত কয়লা রপ্তানি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো গতি থাকবে না।
ভূগর্ভস্থ বা সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বর্তমান কৌশলে তুলনামূলকভাবে অনেক কম কয়লাই উত্তোলন সম্ভব হয় এবং ওই অল্প মাত্রার কয়লা পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করলে তার সবটুকুই দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য। সে জন্যই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির এই পদ্ধতি তারা অন্য কোথাও অনুসরণে রাজি নয়। দেশের বাইরে উচ্চ দামে কয়লা রপ্তানির মাধ্যমে মুনাফার সর্বোচ্চকরণই তাদের উদ্দেশ্য। সে জন্যই তারা সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা স্বল্পতম সময়ে দ্রুততম কায়দায় উত্তোলন সম্পন্ন করতে চায়। তাই এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম আমি যেটা বলতে চাই যে খাল কেটে কুমির আনলে তাকে ভবিষ্যতে আমরা আর ঠেকাতে পারব না। চুক্তিতে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, চুক্তির বিভিন্ন ধারা যে পরে তারা অনায়াসে লঙ্ঘন করতে সক্ষম তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। বিশেষ করে যে দেশের জ্বালানিসম্পদমন্ত্রী একটি ‘মার্সিডিজ’ গাড়ির বিনিময়ে দুটি গ্যাসফিল্ডকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দিতে পারেন সে দেশের জনগণের সংগ্রাম ছাড়া জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার আর কী গ্যারান্টি থাকতে পারে?
কেউ দাবি করতে পারেন যে আমি অনাবশ্যকভাবে বিষয়টির রাজনৈতিকীকরণ করছি। নিছক ‘টেকনিক্যাল’ এবং ‘ইকোনমিক’ বিবেচনা থেকেই বিষয়টি দেখা উচিত। এ প্রসঙ্গে আমার মত হচ্ছে, ‘টেকনিক্যাল’ ও ‘ইকোনমিক’ বিবেচনায়ও একাধিক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আমি পণ্ডিত নই। কিন্তু যে কেউ ধৈর্য ধরে পণ্ডিতদের লেখাগুলো সংগ্রহ করে যদি পাঠ করেন, তাহলে এ বিষয়ে প্রচুর খুঁটিনাটি জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করে বুঝতে পারবেন কেন এ বিষয়ে ‘তিনবার ভাবতে হবে’!
আমি এশিয়া এনার্জি প্রস্তাবিত ‘ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্পের’ মূল্যায়নের জন্য ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বরে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত ‘এক্সপার্ট কমিটি’র মতামতের সারসংক্ষেপ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।
‘কয়লা খনির জন্য প্রদর্শিত এলাকার পরিমাণ ৭৮.৫৪ বর্গকিলোমিটার। এটি পুরো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এশিয়া এনার্জির দাবি করা জায়গার (১৭৯.১২ বর্গকিলোমিটার) একাংশ মাত্র। অবশ্য, কতগুলো পরিবার এই প্রকল্পের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা তারা দেখাতে ব্যর্থ হয়। এই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এশিয়া এনার্জি ৪০ হাজার দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা হবে এক লাখ ২৯ হাজার ৪১৭। তা ছাড়া, যত সময় যাবে জনসংখ্যা বাড়ার কারণে তত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। অধিকন্তু, উন্মুক্ত খনির কারণে ভূগর্ভস্থ পানি বের করে আনলে আক্রান্ত হবে প্রায় ৩১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই প্রক্রিয়াতে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে। এই কারণে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াবে।’
চাষযোগ্য জমি হ্রাস, মরুকরণ, আর্সেনিক বৃদ্ধি এবং বিপুলসংখ্যক জনগণকে প্রতিস্থাপনের বিনিময়ে উন্মুক্ত খনন তাই অর্থনৈতিকভাবেই অলাভজনক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু অর্থনৈতিক হিসাব ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে—স্থানাভাবে তা আর এখানে উল্লেখ করছি না। [আগ্রহী পাঠক দেখুন, আনু মুহাম্মদ, ‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প: কার লাভ, কার ক্ষতি’ উন্নয়নের রাজনীতি, সূচিপত্র প্রকাশনী, ২০০৮]
এ কথা ঠিক যে পৃথিবীতে অনেক জায়গায়ই এখন কয়লা ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। গ্যাসের ব্যবহারও হচ্ছে, তবে কয়লা ও গ্যাসের মধ্যে কয়লাকে ‘ডার্টি ফুয়েল’ বলা হলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের কয়লার প্রতিই আগ্রহ বেশি। কিন্তু কয়লা উত্তোলনে প্রধান অসুবিধা হচ্ছে, যদি আপনি ট্র্যাডিশনাল সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে যান তাহলে আপনি খুব কম কয়লাই উত্তোলন করতে পারবেন, কারও কারও মতে মোট মজুদের মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসবে, যদিও এতে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। আর যদি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যান তাহলে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন সম্ভব হবে ঠিকই কিন্তু দেশভেদে, অঞ্চলভেদে নানা মাত্রার ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এখানে কি কোনো অর্থনৈতিক ট্রেড অফ সম্ভব? সেটাই আজ মুখ্য প্রশ্ন।
কোনো গোঁড়ামি-পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ধানি তিন ফসলি জমির যে প্রাধান্য রয়েছে সেখানে জনগণের যে সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কয়লা খনির স্তরের গভীরতার যে মাত্রা, সেখানে পানির স্তরের যে গভীরতার মাত্রা, সেখানে জনগণের ঘনবসতির যে ঘনত্ব বিদ্যমান, তাতে সব মিলিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রশ্ন আসে, অন্য কোনো দেশে কি প্রয়োজনের তীব্রতার কারণে এসব বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ কখনো করা হয়নি? আমি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দৃষ্টান্ত থেকে শুধু এটুকু বলব, ভারতে চালু উন্মুক্ত কয়লা খনিগুলোর গভীরতা বর্তমানে ১০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু ফুলবাড়ীর যে কয়লা স্তর তা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি গভীর। প্রফেসর নুরুল ইসলামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০ থেকে ৩৩০ মিটার হচ্ছে তার রেঞ্জ। তা ছাড়া জনবসতির ঘনত্বও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
সুতরাং এমনকি ‘টেকনিক্যাল’ ও ‘অর্থনৈতিক’ (সামগ্রিক সামাজিক পরিবেশগত লাভক্ষতির নিরিখে) উভয় বিবেচনায়ই ফুলবাড়ি অঞ্চলে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে একটি বিষয়ে আমি একমত যে কয়লা আমাদের উত্তোলন করতে হবে এবং সে জন্য পরীক্ষামূলকভাবে উপযুক্ত পদ্ধতি আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। সে জন্য উন্মুক্ত খননের বিকল্প নানা পদ্ধতির কথা বা উন্নততর সুড়ঙ্গ পদ্ধতির কথাও (যেখানে বেশি হারে কয়লা তোলা সম্ভব) আমাদের ভাবতে হবে।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কয়লার যে মজুদ আছে, তা কীভাবে উত্তোলন করে বিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি অমীমাংসিত বিতর্ক চলছে। ‘তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সুস্পষ্ট ঘোষিত অবস্থান হচ্ছে, ‘রপ্তানি না, বিদেশি মালিকানা না এবং উন্মুক্ত পদ্ধতির খনন না’। এ ব্যাপারে তারা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলনে নিয়োজিত আছে। এ আন্দোলনে একাধিক লোক শহীদ হয়েছেন, বহু লোক পঙ্গু হয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন। তাঁদের আন্দোলনের কারণেই এশিয়া এনার্জি নামের বিদেশি কোম্পানিটি ফুলবাড়িতে এখন পর্যন্ত সামান্য রয়্যালটির বিনিময়ে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটিয়ে বিপুল কয়লাসম্পদ রপ্তানি করতে সক্ষম হয়নি। এ জন্য ফুলবাড়ির জনগণকে অভিনন্দন জানাই। তাঁদের সংগ্রাম এমন মাত্রায় উপনীত হয়েছিল যে তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উভয়েই ফুলবাড়ির সংগ্রামী জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে কোথাও আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ের কোনো চেষ্টা তাঁরা করবেন না।
মনে হয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ‘জ্বালানিসম্পদ’ ও ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’র সভার তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করেন বলেই একাধিকবার এমন কথাও বলেছেন যে সীমিত অনবায়নযোগ্য জ্বালানিসম্পদ (তা গ্যাস হোক বা কয়লা হোক) দেশের জন্য আগামী ৫০ বছরের (২০৫০) মজুদ রেখেই রপ্তানি করা হবে, তার আগে নয়। এ জন্য তাঁকে বৈদেশিক শক্তি অতীতে ক্ষমতায় পর্যন্ত যেতে দেয়নি—এ রকম গুরুতর অভিযোগও তিনি একাধিকবার করেছেন। এ থেকে অনুমিত হয় যে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কয়লা রপ্তানির বিরুদ্ধেই হয়তো অবস্থান গ্রহণ করবে। যদিও বর্তমান সরকারের অংশীদার রাশেদ খান মেননের অনবায়নযোগ্য সম্পদ রপ্তানিবিরোধী একটি বিল এখন পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে সংসদে উত্থাপনের অপেক্ষায় লাইনবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছে। ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ প্রধান যুক্তি হচ্ছে, ‘উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি, রপ্তানি ও বিদেশি মালিকানার’ বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও এগুলো পরস্পর পরিপূরক এবং একটি বৈদেশিক স্বার্থ প্রণোদিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী ‘প্যাকেজ ডিল’ মাত্র। তাদের মতে, উন্মুক্ত খননের জন্য এশিয়া এনার্জির মতো বিদেশি কোম্পানিরা উন্মুখ হয়ে আছে এই কারণে যে এতে একসঙ্গে এত বিপুল পরিমাণে কয়লা উত্তোলন সম্ভব হবে যে তখন উদ্বৃত্ত কয়লা রপ্তানি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো গতি থাকবে না।
ভূগর্ভস্থ বা সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বর্তমান কৌশলে তুলনামূলকভাবে অনেক কম কয়লাই উত্তোলন সম্ভব হয় এবং ওই অল্প মাত্রার কয়লা পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করলে তার সবটুকুই দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য। সে জন্যই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির এই পদ্ধতি তারা অন্য কোথাও অনুসরণে রাজি নয়। দেশের বাইরে উচ্চ দামে কয়লা রপ্তানির মাধ্যমে মুনাফার সর্বোচ্চকরণই তাদের উদ্দেশ্য। সে জন্যই তারা সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা স্বল্পতম সময়ে দ্রুততম কায়দায় উত্তোলন সম্পন্ন করতে চায়। তাই এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম আমি যেটা বলতে চাই যে খাল কেটে কুমির আনলে তাকে ভবিষ্যতে আমরা আর ঠেকাতে পারব না। চুক্তিতে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, চুক্তির বিভিন্ন ধারা যে পরে তারা অনায়াসে লঙ্ঘন করতে সক্ষম তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। বিশেষ করে যে দেশের জ্বালানিসম্পদমন্ত্রী একটি ‘মার্সিডিজ’ গাড়ির বিনিময়ে দুটি গ্যাসফিল্ডকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দিতে পারেন সে দেশের জনগণের সংগ্রাম ছাড়া জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার আর কী গ্যারান্টি থাকতে পারে?
কেউ দাবি করতে পারেন যে আমি অনাবশ্যকভাবে বিষয়টির রাজনৈতিকীকরণ করছি। নিছক ‘টেকনিক্যাল’ এবং ‘ইকোনমিক’ বিবেচনা থেকেই বিষয়টি দেখা উচিত। এ প্রসঙ্গে আমার মত হচ্ছে, ‘টেকনিক্যাল’ ও ‘ইকোনমিক’ বিবেচনায়ও একাধিক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আমি পণ্ডিত নই। কিন্তু যে কেউ ধৈর্য ধরে পণ্ডিতদের লেখাগুলো সংগ্রহ করে যদি পাঠ করেন, তাহলে এ বিষয়ে প্রচুর খুঁটিনাটি জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করে বুঝতে পারবেন কেন এ বিষয়ে ‘তিনবার ভাবতে হবে’!
আমি এশিয়া এনার্জি প্রস্তাবিত ‘ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্পের’ মূল্যায়নের জন্য ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বরে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত ‘এক্সপার্ট কমিটি’র মতামতের সারসংক্ষেপ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।
‘কয়লা খনির জন্য প্রদর্শিত এলাকার পরিমাণ ৭৮.৫৪ বর্গকিলোমিটার। এটি পুরো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এশিয়া এনার্জির দাবি করা জায়গার (১৭৯.১২ বর্গকিলোমিটার) একাংশ মাত্র। অবশ্য, কতগুলো পরিবার এই প্রকল্পের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা তারা দেখাতে ব্যর্থ হয়। এই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এশিয়া এনার্জি ৪০ হাজার দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা হবে এক লাখ ২৯ হাজার ৪১৭। তা ছাড়া, যত সময় যাবে জনসংখ্যা বাড়ার কারণে তত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। অধিকন্তু, উন্মুক্ত খনির কারণে ভূগর্ভস্থ পানি বের করে আনলে আক্রান্ত হবে প্রায় ৩১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই প্রক্রিয়াতে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে। এই কারণে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াবে।’
চাষযোগ্য জমি হ্রাস, মরুকরণ, আর্সেনিক বৃদ্ধি এবং বিপুলসংখ্যক জনগণকে প্রতিস্থাপনের বিনিময়ে উন্মুক্ত খনন তাই অর্থনৈতিকভাবেই অলাভজনক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু অর্থনৈতিক হিসাব ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে—স্থানাভাবে তা আর এখানে উল্লেখ করছি না। [আগ্রহী পাঠক দেখুন, আনু মুহাম্মদ, ‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প: কার লাভ, কার ক্ষতি’ উন্নয়নের রাজনীতি, সূচিপত্র প্রকাশনী, ২০০৮]
এ কথা ঠিক যে পৃথিবীতে অনেক জায়গায়ই এখন কয়লা ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। গ্যাসের ব্যবহারও হচ্ছে, তবে কয়লা ও গ্যাসের মধ্যে কয়লাকে ‘ডার্টি ফুয়েল’ বলা হলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের কয়লার প্রতিই আগ্রহ বেশি। কিন্তু কয়লা উত্তোলনে প্রধান অসুবিধা হচ্ছে, যদি আপনি ট্র্যাডিশনাল সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে যান তাহলে আপনি খুব কম কয়লাই উত্তোলন করতে পারবেন, কারও কারও মতে মোট মজুদের মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসবে, যদিও এতে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। আর যদি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যান তাহলে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন সম্ভব হবে ঠিকই কিন্তু দেশভেদে, অঞ্চলভেদে নানা মাত্রার ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এখানে কি কোনো অর্থনৈতিক ট্রেড অফ সম্ভব? সেটাই আজ মুখ্য প্রশ্ন।
কোনো গোঁড়ামি-পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ধানি তিন ফসলি জমির যে প্রাধান্য রয়েছে সেখানে জনগণের যে সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কয়লা খনির স্তরের গভীরতার যে মাত্রা, সেখানে পানির স্তরের যে গভীরতার মাত্রা, সেখানে জনগণের ঘনবসতির যে ঘনত্ব বিদ্যমান, তাতে সব মিলিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রশ্ন আসে, অন্য কোনো দেশে কি প্রয়োজনের তীব্রতার কারণে এসব বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ কখনো করা হয়নি? আমি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দৃষ্টান্ত থেকে শুধু এটুকু বলব, ভারতে চালু উন্মুক্ত কয়লা খনিগুলোর গভীরতা বর্তমানে ১০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু ফুলবাড়ীর যে কয়লা স্তর তা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি গভীর। প্রফেসর নুরুল ইসলামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০ থেকে ৩৩০ মিটার হচ্ছে তার রেঞ্জ। তা ছাড়া জনবসতির ঘনত্বও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
সুতরাং এমনকি ‘টেকনিক্যাল’ ও ‘অর্থনৈতিক’ (সামগ্রিক সামাজিক পরিবেশগত লাভক্ষতির নিরিখে) উভয় বিবেচনায়ই ফুলবাড়ি অঞ্চলে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে একটি বিষয়ে আমি একমত যে কয়লা আমাদের উত্তোলন করতে হবে এবং সে জন্য পরীক্ষামূলকভাবে উপযুক্ত পদ্ধতি আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। সে জন্য উন্মুক্ত খননের বিকল্প নানা পদ্ধতির কথা বা উন্নততর সুড়ঙ্গ পদ্ধতির কথাও (যেখানে বেশি হারে কয়লা তোলা সম্ভব) আমাদের ভাবতে হবে।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com
No comments