ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম-তাপসকুল শিরোমণি হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) by মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মনেতা, ধর্মপ্রচারক, তাপসকুল শিরোমণি হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর নাম প্রত্যেক মুসলমানের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। তাঁর জীবনী ও কীর্তিগাথা মুসলমানদের হৃদয়ে চিরদিন জীবন্ত হয়ে থাকবে।


একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে বিশ্বজগতে মুসলমানদের কাছে গওসুল আজম হজরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-কে পরম ভক্তি, শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরকাল স্মরণ করবে।
পৃথিবীতে আল্লাহপাকের প্রেরিত নবী-পয়গম্বর এসেছেন এক লাখ বা দুই লাখ চবি্বশ হাজার। অন্যদিকে কামেল পীর, ওলি, দরবেশ, ফকির যে কত এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সব পীর, ফকির, দরবেশ, ওলির সেরা ছিলেন হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। সবাই তাঁকে হজরত বড়পীর সাহেব বলে জানেন, সেরা বড়পীর হওয়া কি সহজ কথা? এ জন্য তাঁকে যে ত্যাগ, সাধনা, কঠোর অধ্যবসায় করতে হয়েছিল তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের প্রায় ৫০০ বছর পর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তখন ইসলাম ধর্ম এক নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। পবিত্র কোরআন ও আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ ভুলে মানুষ বিপথে পা বাড়িয়েছিল। ইসলাম তথা শরিয়ত ও তার হুকুম-আহ্কাম কিছুতেই যেন মুসলমানরা সহ্য করতে পারছিল না। ঠিক এমনি সময় হজরত বড় পীর সাহেব ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন।
হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর বাবার নাম সৈয়দ আবু সালেহ এবং মায়ের নাম বিবি ফাতেমা। হিজরি ৪৭০ সনের পহেলা রমজান তিনি পারস্য দেশের জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট শিশুর মধুর হাসিতে সারা ঘর যেন আলোয় আলোকময় হয়ে উঠল। শিশু বয়সেই তাঁর ভেতরে এমন কিছু লক্ষণ দেখা গেল, যাতে সবাই ভাবল কালে এ ছেলে মহাপুরুষ হবে, পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে পড়তে পাঠানো হলো মক্তবে, কিন্তু প্রথম পাঠেই তিনি আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় দিলেন, যা দেখে তাঁর ওস্তাদজি হলেন অবাক ও বিস্মিত। ১৮ বছর বয়সে মক্তবে পড়া শেষ করে এবার তাঁকে ভর্তি হতে হবে মাদ্রাসায়, তখনকার দিনে বাগদাদ ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ স্থান। একদিন দিন-তারিখ ঠিক করে তাঁর মা তাঁকে পাঠিয়ে দেন বাগদাদে। তখনকার সময় পথচলা ছিল খুবই বিপজ্জনক, পথ চলতে চোর-ডাকাতের ভয়, যাওয়ার সময় মা বলে দিলেন, বাবা আবদুল কাদের, সব সময় আল্লাহপাককে মনে রেখো, কখনো মিথ্যা কথা বলো না। এরপর হজরত আবদুল কাদের (রহ.) একটি কাফেলার সঙ্গে বাগদাদের উদ্দেশে রওনা হলেন। এক রাতে একটি মাঠে তাঁবু ফেলে কাফেলা বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ একদল ডাকাত চড়াও হলো কাফেলার ওপর। কারো হাত ভাঙল, কারো পা ভাঙল। ডাকাতরা হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-কে ছোট ভেবে কিছুই বলল না। হঠাৎ এক ডাকাত ঠাণ্ডা মাথায় বলল, কিহে বৎস, তোমার কাছে কিছু মালমাত্তা আছে কি? আবদুল কাদের বললেন, হ্যাঁ ভাই, আমার কাছে চলি্লশটি সোনার মোহর আছে। ডাকাত বিশ্বাস করতে চাইল না। বালক হজরত আবদুল কাদের বললেন, বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন আমার কাছে ঠিকই ৪০টি সোনার মোহর আছে। ডাকাত বলল, কথা তোমার সত্যিই তো? আচ্ছা, দেখি তো তোমার কথা কতটা সত্য। এই বলে ডাকাত তাঁকে তাদের সর্দারের কাছে নিয়ে হাজির হলো।
তাঁর জামার সেলাই খুলে ঠিকই ৪০টি মোহর পাওয়া গেল। ডাকাত সর্দার বলল, বালক তোমার কাছে যে এত 'স্বর্ণমোহর' আছে, তুমি সে কথা আমাদের অকপটে বলে দিলে? আবদুল কাদের বললেন, আমার মা বলে দিয়েছেন, বাবা, তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলো না, টাকার লোভে আমি কি আমার মায়ের আদেশ লঙ্ঘন করতে পারি? মিথ্যা কথা বলতে পারি? এ কথা শুনে ডাকাত সর্দারের দেহমনে শিহরণ জেগে উঠল এবং বলল, বালক, এ কী কথা শোনালে আজ? প্রাণের ভয়, অর্থের লোভে তুমি সামান্যতম মিথ্যা কথা বলতে পারলে না!
আর আমরা জীবনে কত গুনাহ, অপরাধ, অন্যায় করেছি, মিথ্যা কথা বলেছি, জুয়া, চুরি, ডাকাতি করেছি, অকারণে কত মানুষকে হত্যা করেছি, কত কত পরিবার-পরিজনকে পথের ভিখারি করেছি, হায়, হায়, আমাদের কী উপায় হবে! আল্লাহপাকের কাছে আমি কত বড় পাপী, গুনাহগার, অপরাধী। এ কথা বলে ডাকাত সর্দার হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। হজরত আবদুল কাদের (রহ.) তাঁর হাত ধরে তুলে বললেন, ভাই, আমরা শয়তানের চক্রান্তে পড়ে এসব অন্যায়, অপরাধ, অপকর্ম করেছি। আবদুল কাদের (রহ.) বললেন, এতকাল যা করার করেছ, এখন আর কিছু করার নেই। এখন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে তওবাতিল্লা করে তাঁর কাছে গুনাহ মাফ পেতে পারো। ডাকাত সর্দার হজরত আবদুল কাদের (রহ.)-এর হাত ধরে তওবা করল। অতঃপর তিনি চললেন বাগদাদ শহরে। বিভিন্ন আলেম-ওলামা-দরবেশের কাছ থেকে এলেম অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। এ সময় কখনো তাঁর খাওয়া জুটত, কখনো জুটত না। এমনি দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে বড় বড় আলেম আর দরবেশের কাছে জাহেরি ও বাতেনি ইলম শিখে অল্প দিনেই মহাজ্ঞানী, সাধক ও মহা তাপস, ওলিকুল শিরোমণি হিসেবে সর্বত্র পরিচিত হয়ে উঠলেন, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর যশ-সুখ্যাতি। আল্লাহপাকের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে কঠোর সাধনা-অধ্যবসায়ে নিজের মন-দিল-দেহ আল্লাহপাকের জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিলে আ@ে@@@াৎসর্গ করলেন। তাঁর জীবন-ইতিহাসে পাওয়া যায়, টানা ২৫ বছর তিনি উদাসীন, আত্মভোলায় বিশ্ব সংসার ভুলে মরুমাঠে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমনও শোনা যায়, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এশার সালাতের জন্য যে অজু করতেন, সেই অজুতেই ফজরের সালাত আদায় করতেন। অবশেষে তিনি পেয়েছিলেন দীর্ঘদিনের সাধনার ফল। তিনি আল্লাহপাকের অসীম রহমত লাভ করলেন। ৫২১ হিজরিতে তিনি লোকালয়ে ফিরে এসে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকের দায়িত্ব নিলেন। এ ছাড়া তিনি মাঝেমধ্যে ওয়াজ মাহফিলে দাঁড়িয়ে ইসলামের সুমহান শিক্ষা-দীক্ষা, আমল-আখলাক ও সৌন্দর্য সম্পর্কে উপদেশ দিতেন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের তাগিদ দিতেন।
এতে লাখ লাখ মানুষ তাঁর কাছ থেকে নতুন জীবন লাভ করতে লাগল। তাঁর বলার ভঙ্গি, ভাষার মাধুর্যে মানুষ হতো বিমোহিত। তাঁর বয়স যখন ৫১, তখন তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু সংসারী হয়েও তিনি ছিলেন খাঁটি দরবেশ, সংসারের হাজার কাজ করেও তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদত-বন্দেগি করতে ভুলে যেতেন না। গভীর রাতে তিনি নফল সালাত শেষে আল্লাহপাকের জিকির ও তাসবিহ-তাহলিলে বসে উপাসনা, মোরাকাবা, মোশাহিদা করতেন।
হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানি এই মহাপ্রাণ পীরানে পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ওফাত পান, যা আমরা অতি মর্যাদা, ভাব-গাম্ভীর্যভাবে ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালন করি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বাগদাদ শহরে তাঁর মাজার রয়েছে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ সিরাত মিশন, ঢাকা, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.