চারদিক-চলছে খেলা বাড়ির পাশের মাঠে! by নির্লিপ্ত নয়ন
এই মেঘ এই রোদ্দুর। কখনো ভিজে একশা, আবার কখনো বা প্রচণ্ড দাবদাহে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা—এর মধ্যেও থেমে নেই কেউ। সবাই ছুটছে। প্রকৃতির বিচিত্র লীলার মাঝে মানুষের নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততায় টান পড়েনি এতটুকু; বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন এক উন্মাদনা—বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০। সবাই এখন ফুটবল উত্তেজনায় বিভোর।
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তা ও বাড়ির ছাদগুলোতে তাকালে দেখা যাবে, একই সঙ্গে উড়ছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, জার্মানি—আরও বিভিন্ন দেশের পতাকা। পরিবেশটা এমন, মনে হয় বিশ্বকাপের বর্ণিল আসর সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, যেন আমাদের বাড়ির পাশের কোনো এক মাঠে চলছে এই খেলা!
‘মেসি কি পারবে? ম্যারাডোনা না আবার নতুন কোনো পাগলামি করে বসে, এবারে ব্রাজিলই ফেবারিট, ইতালিকে ভুলে গেলে চলবে না—ফ্যাবিও ক্যানাভারো কিন্তু এই দলেরই কাণ্ডারি।’ অথবা কেউ হয়তো বলবেন, স্পেনের নাম বেমালুম ভুলে গেলে কেন বাপু! ইত্যাকার নানা বিতর্ক, আলোচনা ও উত্তেজনায় সবাই যখন তীব্র ফুটবলজ্বরে আক্রান্ত, সেই জ্বরের দাওয়াই হিসেবে সবাই এখন টিভি সেটের সামনে বসছেন নিয়ম করে। আমাদের দেশের লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ভাবনাকে কলমের মাধ্যমে প্রকাশের খেলায় যাঁরা সদা পারঙ্গম, কাকা কিংবা লুইস ফ্যাবিয়ানোর ফুটবল-জাদু দেখার জন্য তাঁদের কী উদগ্রীব-উত্কণ্ঠা। কীর্তিনাশার কবি মোহাম্মদ রফিক তাই তো বললেন, ‘অন্য সব বাদ। এখন শুধু বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলের এই উত্তাল আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছে। প্রতিদিনই টিভির সামনে বসছি, বিভিন্ন চ্যানেল পুরোনো খেলাগুলো আবার দেখাচ্ছে, দেখছি। ভালোই তো কেটে যাচ্ছে সময়। আমি ব্রাজিলের সমর্থক।’
দল সমর্থনের বিষয়ে অন্য দশজনের মতো লেখকদের অধিকাংশই আর্জেন্টিনা অথবা ব্রাজিলের মধ্যে বিভক্ত। আর্জেন্টিনাকে সমর্থনের পেছনে ‘ম্যারাডোনার সেই কীর্তি’ আর ব্রাজিলের পক্ষে আছে ‘ছন্দময় ফুটবল’—দুই শিবিরের সমর্থকদের অনেকটা এ রকমই যুক্তি। ফুটবল নিয়ে বকবক-এর লেখক আবদুশ শাকুর যেমন বলেন, ‘ব্রাজিল আমার সারা জীবনের দুর্বলতা। ফুটবলকে এরা যেন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এটি অবশ্যই শারীরিক খেলা, কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরা ছন্দময় ফুটবলের মাধ্যমে একে মানসিক খেলার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’
অন্যদিকে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আকাশি-সাদা পতাকার আর্জেন্টিনার পক্ষেই কথা বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ম্যারাডোনা আছে না? আমি ওর দারুণ ভক্ত। ওর জন্যই এই দলকে সমর্থন করি।’ এভাবে কথা বলতে বলতে আগুন পাখি উপন্যাসের রচয়িতা ফিরে যান বর্ধমানে, তাঁর স্মৃতির শৈশবে। বলেন, ‘কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে আমি ছিলাম হায়ারের খেলোয়াড়। খেলতাম রাইটআউট পজিশনে। আশপাশের গ্রাম থেকে আমাকে হায়ার করে নিয়ে যাওয়া হতো ফুটবল খেলার জন্য। বিশ্বকাপ ফুটবলেরই এই ক্ষণে কত কিছুই না মনে পড়ছে আজ।’
ফুটবল প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক লেখকই হূদয় খুঁড়ে বের করেছেন বেদনা নয়, স্মৃতির সুধা। হয়তো তখন তাঁদের মন চলে গেছে গহিন গ্রামে, যেখানে আছে বিস্তীর্ণ এক মাঠ। ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রতি আকৃষ্ট কবি রফিক আজাদের কথায়ও ভেসে ওঠে সেই স্মৃতির প্রভা—‘তেমনভাবে ফুটবল খেলতে কখনোই পারতাম না, তবে একবার খেলতে গিয়ে শরীরে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম—এইটুকু মনে আছে।’
কবি-লেখকদের মনের গোপন কুঠরিতে গোলের খেলা ফুটবল এভাবেই জয়যুক্ত হচ্ছে এখন। কখনো স্মৃতি হাতড়ে ফেরা, কখনো বা ‘গোল’—এই উচ্ছ্বাসময় শব্দটির জন্য অধীর প্রতীক্ষা। এসবের বাইরে দাঁড়িয়ে রাবেয়া খাতুন ও সেলিনা হোসেন—দুই ঔপন্যাসিক বললেন ভিন্ন আরেক কথা, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে দিকে দিকে উড়ছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। সবার মধ্যেই সাজসাজ রব। সবাই মিলে একসঙ্গে প্রিয় দলের খেলা উপভোগের ব্যাকুলতা—এই আনন্দ কি কম!’
যদিও সমর্থনের দিক দিয়ে তাঁদের দুজনেরই প্রথম পছন্দ ব্রাজিলের হলুদ জার্সি; তার পরও সেলিনা হোসেনের কথায় স্পষ্ট হয় অন্য দ্যোতনা, ‘নান্দনিক খেলার জন্য তো বটেই, তবে এটিই একমাত্র নয়, পেলের ব্রাজিলের প্রতি সহমর্মী এই জন্যও যে লাতিন আমেরিকার এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসনের নিগড়ে নিষ্পেষিত ছিল।’
‘রংধনু’ জাতির দেশ হিসেবে খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বের ৩২টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে যে ফুটবল মেলা, তা নিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে, বাড়বে। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিকন্দ্র—কোথায় নেই সাদা-কালো ফুটবলের তেজ। তবু সব তেজের রেখা যেন মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায়, যখন লেখকেরা বলতে শুরু করেন এক দীর্ঘশ্বাসের গল্প। হাসান আজিজুল হক তো খেদ নিয়েই বললেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় সুবিশাল খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় ফুটবল খেলা...এখন সেই মাঠ কই? যেদিকে তাকাই কেবল ইট-পাথরের দালান।’
লেখকের দীর্ঘশ্বাসটি টের পাওয়া যায় বোধ হয়। আবার প্রাবন্ধিক-গল্পকার আবদুশ শাকুরের বক্তব্যে আরেক রকম দীর্ঘশ্বাস জেগে ওঠে, ‘ফুটবল আনন্দের খেলা। তবে এই খেলায়ও দিনে দিনে হিংস্রতা ও হিংসা ঢুকে পড়ছে। কিন্তু খেলায় আনন্দই তো মূল কথা, তাই না?’
ফ্রি-কিক, অফসাইড আর ট্রাইব্রেকারের হাতছানিতে এখন খেলার সেই প্রকৃত আনন্দ-জোয়ারে ভাসতে চাইছে সবাই। বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০ যেন আসলেই শুরু হয়েছে আমাদের বাড়ির পাশের কোনো এক মাঠে। এই তো, এখনই প্রিয় দলের গোল করার আনন্দে উল্লসিত হব আমরা!
‘মেসি কি পারবে? ম্যারাডোনা না আবার নতুন কোনো পাগলামি করে বসে, এবারে ব্রাজিলই ফেবারিট, ইতালিকে ভুলে গেলে চলবে না—ফ্যাবিও ক্যানাভারো কিন্তু এই দলেরই কাণ্ডারি।’ অথবা কেউ হয়তো বলবেন, স্পেনের নাম বেমালুম ভুলে গেলে কেন বাপু! ইত্যাকার নানা বিতর্ক, আলোচনা ও উত্তেজনায় সবাই যখন তীব্র ফুটবলজ্বরে আক্রান্ত, সেই জ্বরের দাওয়াই হিসেবে সবাই এখন টিভি সেটের সামনে বসছেন নিয়ম করে। আমাদের দেশের লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ভাবনাকে কলমের মাধ্যমে প্রকাশের খেলায় যাঁরা সদা পারঙ্গম, কাকা কিংবা লুইস ফ্যাবিয়ানোর ফুটবল-জাদু দেখার জন্য তাঁদের কী উদগ্রীব-উত্কণ্ঠা। কীর্তিনাশার কবি মোহাম্মদ রফিক তাই তো বললেন, ‘অন্য সব বাদ। এখন শুধু বিশ্বকাপ ফুটবল। ফুটবলের এই উত্তাল আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছে। প্রতিদিনই টিভির সামনে বসছি, বিভিন্ন চ্যানেল পুরোনো খেলাগুলো আবার দেখাচ্ছে, দেখছি। ভালোই তো কেটে যাচ্ছে সময়। আমি ব্রাজিলের সমর্থক।’
দল সমর্থনের বিষয়ে অন্য দশজনের মতো লেখকদের অধিকাংশই আর্জেন্টিনা অথবা ব্রাজিলের মধ্যে বিভক্ত। আর্জেন্টিনাকে সমর্থনের পেছনে ‘ম্যারাডোনার সেই কীর্তি’ আর ব্রাজিলের পক্ষে আছে ‘ছন্দময় ফুটবল’—দুই শিবিরের সমর্থকদের অনেকটা এ রকমই যুক্তি। ফুটবল নিয়ে বকবক-এর লেখক আবদুশ শাকুর যেমন বলেন, ‘ব্রাজিল আমার সারা জীবনের দুর্বলতা। ফুটবলকে এরা যেন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এটি অবশ্যই শারীরিক খেলা, কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরা ছন্দময় ফুটবলের মাধ্যমে একে মানসিক খেলার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’
অন্যদিকে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আকাশি-সাদা পতাকার আর্জেন্টিনার পক্ষেই কথা বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ম্যারাডোনা আছে না? আমি ওর দারুণ ভক্ত। ওর জন্যই এই দলকে সমর্থন করি।’ এভাবে কথা বলতে বলতে আগুন পাখি উপন্যাসের রচয়িতা ফিরে যান বর্ধমানে, তাঁর স্মৃতির শৈশবে। বলেন, ‘কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে আমি ছিলাম হায়ারের খেলোয়াড়। খেলতাম রাইটআউট পজিশনে। আশপাশের গ্রাম থেকে আমাকে হায়ার করে নিয়ে যাওয়া হতো ফুটবল খেলার জন্য। বিশ্বকাপ ফুটবলেরই এই ক্ষণে কত কিছুই না মনে পড়ছে আজ।’
ফুটবল প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক লেখকই হূদয় খুঁড়ে বের করেছেন বেদনা নয়, স্মৃতির সুধা। হয়তো তখন তাঁদের মন চলে গেছে গহিন গ্রামে, যেখানে আছে বিস্তীর্ণ এক মাঠ। ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রতি আকৃষ্ট কবি রফিক আজাদের কথায়ও ভেসে ওঠে সেই স্মৃতির প্রভা—‘তেমনভাবে ফুটবল খেলতে কখনোই পারতাম না, তবে একবার খেলতে গিয়ে শরীরে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম—এইটুকু মনে আছে।’
কবি-লেখকদের মনের গোপন কুঠরিতে গোলের খেলা ফুটবল এভাবেই জয়যুক্ত হচ্ছে এখন। কখনো স্মৃতি হাতড়ে ফেরা, কখনো বা ‘গোল’—এই উচ্ছ্বাসময় শব্দটির জন্য অধীর প্রতীক্ষা। এসবের বাইরে দাঁড়িয়ে রাবেয়া খাতুন ও সেলিনা হোসেন—দুই ঔপন্যাসিক বললেন ভিন্ন আরেক কথা, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে দিকে দিকে উড়ছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। সবার মধ্যেই সাজসাজ রব। সবাই মিলে একসঙ্গে প্রিয় দলের খেলা উপভোগের ব্যাকুলতা—এই আনন্দ কি কম!’
যদিও সমর্থনের দিক দিয়ে তাঁদের দুজনেরই প্রথম পছন্দ ব্রাজিলের হলুদ জার্সি; তার পরও সেলিনা হোসেনের কথায় স্পষ্ট হয় অন্য দ্যোতনা, ‘নান্দনিক খেলার জন্য তো বটেই, তবে এটিই একমাত্র নয়, পেলের ব্রাজিলের প্রতি সহমর্মী এই জন্যও যে লাতিন আমেরিকার এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসনের নিগড়ে নিষ্পেষিত ছিল।’
‘রংধনু’ জাতির দেশ হিসেবে খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বের ৩২টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে যে ফুটবল মেলা, তা নিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে, বাড়বে। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিকন্দ্র—কোথায় নেই সাদা-কালো ফুটবলের তেজ। তবু সব তেজের রেখা যেন মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায়, যখন লেখকেরা বলতে শুরু করেন এক দীর্ঘশ্বাসের গল্প। হাসান আজিজুল হক তো খেদ নিয়েই বললেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় সুবিশাল খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় ফুটবল খেলা...এখন সেই মাঠ কই? যেদিকে তাকাই কেবল ইট-পাথরের দালান।’
লেখকের দীর্ঘশ্বাসটি টের পাওয়া যায় বোধ হয়। আবার প্রাবন্ধিক-গল্পকার আবদুশ শাকুরের বক্তব্যে আরেক রকম দীর্ঘশ্বাস জেগে ওঠে, ‘ফুটবল আনন্দের খেলা। তবে এই খেলায়ও দিনে দিনে হিংস্রতা ও হিংসা ঢুকে পড়ছে। কিন্তু খেলায় আনন্দই তো মূল কথা, তাই না?’
ফ্রি-কিক, অফসাইড আর ট্রাইব্রেকারের হাতছানিতে এখন খেলার সেই প্রকৃত আনন্দ-জোয়ারে ভাসতে চাইছে সবাই। বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০ যেন আসলেই শুরু হয়েছে আমাদের বাড়ির পাশের কোনো এক মাঠে। এই তো, এখনই প্রিয় দলের গোল করার আনন্দে উল্লসিত হব আমরা!
No comments