ধূমপানজনিত ক্যান্সার রোধে সচেতনতাই একমাত্র পথ by মো. ফজলুল হক

আদিকাল থেকে হুঁকো ও বাঁশের চোঙার মাধ্যমে ধূমপানের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বিড়ি ও সিগারেট হিসেবে এর প্রচলন রয়েছে। পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়া আরো মারাত্মক, যা সরাসরি লিভার, ফুসফুস ও কিডনিকে আক্রান্ত করে। জর্দা বা তামাকের পাতা সেবনের অর্থ হচ্ছে_ভেজালমুক্ত বিষপান।


বাংলাদেশে মোট জিডিপির ১ শতাংশ খরচ হয় ধূমপানের পেছনে। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিবছর ২০ লাখের অধিক লোক মারা যায় ধূমপানজনিত ক্যান্সারে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় বছরে ৫৭ হাজার। এক গবেষণায় জানা যায়, ধূমপান বন্ধ হলে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধূমপানজনিত ক্যান্সারের হাত থেকে রেহাই পাবে। উল্লেখ্য, বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার ১২ গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধূমপানের কারণে। ঋরহধহপরধষ ঊীঢ়ৎবংং জবঢ়ড়ৎঃ (ঋঊজ) ২০০৬ অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে এক কোটি লোক ধূমপানজনিত রোগে মারা যাবে। আর ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে লিটলবয় এবং ফ্যাটম্যান নামের অ্যাটম বোমায় মারা যায় প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার লোক (১৯৭৬ সালের তথ্য মতে)। আমাদের দেশে গরিব, অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত লোকের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, একজন ছাত্র যতক্ষণ মা-বাবার দৃষ্টির আওতায় থাকে, ততক্ষণ ভালোই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর হাতছাড়া হয়ে যায় নজরদারির বিষয়টি। ওই সময় ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগে অনেক ধূমপায়ী বন্ধুর আড্ডায় জড়িয়ে পড়ে। সাধারণত ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সে বেশির ভাগ যুবক যেকোনো উপায়ে ধূমপানে আসক্ত হতে পারে_এ বয়সটাই মারাত্মক। এ বয়সটা ধূমপানমুক্ত অবস্থায় অতিক্রম করতে পারলে বাকি জীবন মুক্ত থাকা সম্ভব। বর্তমানে সমাজের মধ্যে সচেতন নাগরিকরা ধূমপায়ীদের এড়িয়ে চলেন। এমনকি পাত্র খুঁজতে গিয়েও কনের পক্ষ বলে, বরের কোনো খারাপ অভ্যাস আছে কি না? অর্থাৎ ধূমপান করে কি না? কারণ যার ধূমপানের অভ্যাস থাকে, তার অন্য অভ্যাসও থাকতে পারে_এটাই অনেকের ধারণা। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০টি জেলায় ১১৭টি বিড়ি ফ্যাক্টরি রয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি বিড়ি উৎপাদিত হয়। প্রতিটি ফ্যাক্টরির চারপাশে অর্ধকিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত তামাকের গুঁড়ো বাতাসের মাধ্যমে বাহিত হয়ে এলাকার লোকজনের ক্ষতি করে, যা অনেকের ধারণারও বাইরে। বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ। তাদের সঙ্গে চার-পাঁচ বছরের ছেলেমেয়েরাও ফ্যাক্টরির মধ্যে ঘোরাফেরা করে, যেটি ফুসফুস ক্যান্সারের বড় কারণ। বিড়ি শ্রমিকের প্রায় শত ভাগই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ করায় তাঁরা বলেন, 'আমরা জানি আমাদের পরিণতি ভালো নয়। পেটের দায়ে কাজ করি। তবে এলাকায় যদি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বা অন্য কিছু হতো, সেখানে কাজ করতাম।' পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হলেও এ আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উল্লেখ্য, আইনি কাঠামো যতই কঠিন হোক না কেন, বাস্তবায়িত না হলে তাতে কোনো লাভ হয় না। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে দৈনিক ১৫০ কোটি পিস সিগারেট বিক্রি হয়ে থাকে এবং ধূমপায়ীদের প্রতি ১০ জনে একজন (১০ শতাংশ) মৃত্যুবরণ করে ক্যান্সারে। অনুন্নত দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, সিনেমা-নাটকে সিগারেট বিষয়ক অভিনয়ের দৃশ্য দুঃখজনক, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধূমপানের বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণের অনুরূপ। সিনেমা বা টেলিভিশনে এ ধরনের দৃশ্য যুবসমাজকে উৎসাহী করছে, যা বন্ধ রাখা একান্ত প্রয়োজন। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজনে একজন মারা যায় ধূমপানজনিত কারণে। কম্বোডিয়া, চীন, জাপান ও মালয়েশিয়ায় একইভাবে ধূমপায়ীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বহন করছে। সুতরাং ধূমপানে বিষ পান_এটিই সত্য। ধর্মীয় আঙ্গিকেও ধূমপান নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি দেশে তামাক চাষ বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। তামাক চাষে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। ওই জমিতে ধানসহ অর্থকরী ফসলের আবাদে সবাইকে উৎসাহী করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে ওই সব এলাকায় কৃষকদের ভর্তুকিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। দেশের বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিকদের দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে ওই শ্রমিকদের নতুনভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন ও মানবিক দাবি। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ওইসব এলাকায় বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কলকারখানা স্থাপন করে কর্মচারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। এটি সবার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশেই বিড়ি-সিগারেটের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় ধূমপায়ীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ হারে করারোপ একান্ত প্রয়োজন। অনেক সময় সিগারেটের টাকা সংগ্রহ করতে ছিনতাই, মা-বাবাকে ছুরিকাঘাত করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে, যা মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায়। সব শেষে বলতে হয়, সিগারেটের গায়ে লেখা আছে, 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর'_এ ধরনের সতর্কবাণীই যথেষ্ট নয়। আসুন, দলমত-নির্বিশেষে সবাই মিলে এটিকে না বলি, ঘৃণার চোখে দেখি, ফুসফুস ক্যান্সারের হাত থেকে নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতে সহযোগিতা করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

No comments

Powered by Blogger.