বিশ্বকাপ ২০১০-ফুটবলের জাদুকরী শক্তি by অ্যারিয়েল বি কয়া
যাঁরা রুবেন দ্বীপে পা রেখেছেন তাঁরা বলেন, এর দেয়ালঘেরা কারাগার আর তার মধ্যে জমানো স্মৃতির মতোই দ্বীপটির মাটিও যেন ধূসর। এই ধূসরতা যেন এর ইতিহাসেরই রং। কেপটাউনের মুখোমুখি এই দ্বীপে আটকে রাখা হতো সে দেশের একসময়কার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামীদের।
এখানেই নেলসন ম্যান্ডেলাকে ১৮ বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বন্দীদের বেশির ভাগই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ; আর বলাই বাহুল্য প্রায় সব প্রহরীই ছিল শ্বেতাঙ্গ।
যাঁরা সেখানে গিয়েছেন, তাঁরা এও বলেন, ফুটবল খেলা ঘিরেই বন্দী বিদ্রোহীরা নিজেদের ফিরে পেতো। বন্দীত্বের হতাশার মধ্যে সেটাই ছিল একমাত্র মুক্ত জিনিস। শ্বেতাঙ্গ জেলারদের খেলা রাগবি ও ক্রিকেটের বিরুদ্ধে তারা বেছে নিয়েছিল ফুটবল। ষাটের দশকে একদল কারাবন্দী সেখানে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এ খেলা চালানোর জন্য তৈরি হলো ‘দ্য মাকানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের খসড়া তৈরিতে অংশ নেওয়া টোকিও সেক্সওয়ালে ছিলেন সেই কারা ফুটবল দলের সদস্য। তাঁর কথায়, ‘সত্যিকারভাবে বললে সেই খেলায় নিয়মকানুনের বালাই ছিল না। তবুও সেই ফুটবল খেলাই আমাদের উদ্দীপ্ত ও আশাবাদী রাখত। আমরা যে বেঁচে আছি, তা এভাবেই টের পেতাম এবং ভেঙে পড়তাম না।’ দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তি সংগ্রামের আরেক নেতা টনি সুজেও অনেক বছর রুবেন দ্বীপের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাঁর মনে পড়ে, ‘জেলারদের হাতে ছিল অস্ত্র, সব সময় তারা হুঁশিয়ার। খেলার মাঠ বলেও কিছু ছিল না। কিন্তু জেলের মধ্যকার এক চারকোনা মাঠটাতেই আমরা নিজেদের মুক্ত মনে করতাম। কারণ আমাদের খেলার নিয়ম আমরাই ঠিক করেছিলাম এবং ওই মাঠে নামলে আমরা ভুলে যেতাম যে আমরা বন্দী, ভুলে যেতাম ওই সাদা প্রহরীদের।’
এই রুবেন দ্বীপের ৪৬৬ নম্বর কুঠরির দুই বর্গমিটার জায়গায় থাকতেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। কোনো সহযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলা কিংবা শ্বেতাঙ্গ শক্তির নিপীড়নের বিরুদ্ধে আয়োজিত ফুটবল লিগে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগও তাঁর ছিল না। আসলে তাঁর সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও তিনি সেই একচিলতে কুঠরি থেকে খেলার খবরাখবর রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু প্রহরীরা তাঁকে সেটা করতে দিত না। তাঁর দৃষ্টি যাতে মাঠের দিকে না যায় সে জন্য তারা তাঁর কুঠরির সামনে একটি ধূসর দেয়াল তুলে দিল। রুবেন দ্বীপের সবকিছুই ছিল এমন ধূসর।
তারা ভেবেছিল, এভাবেই তারা কালো মানুষের নেতাকে শেষ করে দিতে পারবে। কিন্তু তারা ছিল ভুল; তারা মানুষটি কিংবা তাঁর মনোবল কিছুকেই ধ্বংস করতে পারল না। সেই কারাগার থেকে ম্যান্ডেলা বেরিয়ে এলেন আরও শক্তিমান হয়ে। তিনি কেবল বর্ণবাদী শোষণের বিরুদ্ধেই তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন না বরং শ্বেতাঙ্গ নির্যাতকদের ক্ষমার মাধ্যমে বঞ্চনা থেকে তৈরি হওয়া গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে দিলেন। বন্দিশালার সেই কুঠরিতে থাকতেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহুপক্ষীয় গণতন্ত্রের দেশে পরিণত করার সংকল্প করেন। সেই ছোট্ট ঘরটিতে থাকা অবস্থাতেই তিনি বুঝলেন, খেলাধুলা জীবনবিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়; বরং সেরা মানবিক মূল্যবোধগুলোকে বিকশিত করার সামর্থ্য খেলার রয়েছে।
তাই ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ম্যান্ডেলা ঘোষণা করেন, ‘জাতিগত বৈষম্যের আগল ভাঙায় রাজনীতির থেকে খেলা কম শক্তিশালী নয়।’ সেই প্রথম সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী একসঙ্গে ভোট দেয় এবং গোটা দেশই মেতে ওঠে খেলাধুলায়। প্রথম আবির্ভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল দল স্প্রিংবকস ১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপ জেতে। যদিও সেই দলে মাত্র একজন ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। আবার ১৯৯৬ সালেও তারা আফ্রিকান ন্যাশনস কাপে জয়ী হয়। এর মধ্যে বিশ্ব ফুটবল সম্প্রদায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার তাদের সমাজের মধ্যে গ্রহণ করে। (এর আগে বর্ণবাদী শাসনের প্রতিবাদ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক অনেক ক্ষেত্রে বর্জন করা হয়েছিল) খেলার আতিশয্য এমন মাত্রায় পৌঁছে যে ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন নেইল টোভেই শ্বেতাঙ্গ হয়েও হয়ে উঠেছিলেন কালো জনগোষ্ঠীর নায়ক।
এতসব কিছুর পরও, অন্য সবকিছুর মতো দক্ষিণ আফ্রিকারও সবই ভালো, তা নয়। অন্য অনেক দেশের মতো সেখানে এখনো বর্ণবাদের প্রভাব রয়ে গেছে। ফুটবলের বেলাতেও তার লক্ষণ দেখা যাবে। খেলার মাঠ থেকে দর্শকের গ্যালারি পর্যন্ত হয়তো শোনা যাবে চিত্কার-গালাগালি-হইচই। তার পরও এ ধরনের মন্তব্য খেলার নিজস্ব গুণ বা এর সঙ্গে জড়িত আশাবাদের ক্ষতি করতে পারবে না। বিশেষত ফুটবলের বেলায়, অনেক জায়গাতেই যা গরিবের পছন্দের খেলা; বড় বড় শহরের ঘিঞ্জি বস্তির ধুলো-কাদায় ঘরে বানানো বল নিয়ে ছোটাছুটি করা কিশোরেরা তার পরও তাদের প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটাবে। আফ্রিকার কোনো দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপে এমন দৃশ্যই আমরা দেখতে যাচ্ছি।
জ্ঞানী কৌমসর্দার ম্যান্ডেলা রুবেন দ্বীপের ধূসর পরিপার্শ্ব থেকে এক ‘রংধনু জাতি’র স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কালো-সাদায় মেশানো দক্ষিণ আফ্রিকানদের দেশে এবার খেলবে বিভিন্ন বর্ণের ও রঙের জাতির খেলোয়াড়েরা। এর থেকে আর কী আছে, যা ম্যান্ডেলার স্বপ্নের কাছাকাছি?
গ্রানমা ইন্টারন্যাশনাল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
অ্যারিয়েল বি কয়া: কিউবার ক্রীড়াবিষয়ক লেখক।
যাঁরা সেখানে গিয়েছেন, তাঁরা এও বলেন, ফুটবল খেলা ঘিরেই বন্দী বিদ্রোহীরা নিজেদের ফিরে পেতো। বন্দীত্বের হতাশার মধ্যে সেটাই ছিল একমাত্র মুক্ত জিনিস। শ্বেতাঙ্গ জেলারদের খেলা রাগবি ও ক্রিকেটের বিরুদ্ধে তারা বেছে নিয়েছিল ফুটবল। ষাটের দশকে একদল কারাবন্দী সেখানে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এ খেলা চালানোর জন্য তৈরি হলো ‘দ্য মাকানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের খসড়া তৈরিতে অংশ নেওয়া টোকিও সেক্সওয়ালে ছিলেন সেই কারা ফুটবল দলের সদস্য। তাঁর কথায়, ‘সত্যিকারভাবে বললে সেই খেলায় নিয়মকানুনের বালাই ছিল না। তবুও সেই ফুটবল খেলাই আমাদের উদ্দীপ্ত ও আশাবাদী রাখত। আমরা যে বেঁচে আছি, তা এভাবেই টের পেতাম এবং ভেঙে পড়তাম না।’ দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের মুক্তি সংগ্রামের আরেক নেতা টনি সুজেও অনেক বছর রুবেন দ্বীপের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাঁর মনে পড়ে, ‘জেলারদের হাতে ছিল অস্ত্র, সব সময় তারা হুঁশিয়ার। খেলার মাঠ বলেও কিছু ছিল না। কিন্তু জেলের মধ্যকার এক চারকোনা মাঠটাতেই আমরা নিজেদের মুক্ত মনে করতাম। কারণ আমাদের খেলার নিয়ম আমরাই ঠিক করেছিলাম এবং ওই মাঠে নামলে আমরা ভুলে যেতাম যে আমরা বন্দী, ভুলে যেতাম ওই সাদা প্রহরীদের।’
এই রুবেন দ্বীপের ৪৬৬ নম্বর কুঠরির দুই বর্গমিটার জায়গায় থাকতেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। কোনো সহযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলা কিংবা শ্বেতাঙ্গ শক্তির নিপীড়নের বিরুদ্ধে আয়োজিত ফুটবল লিগে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগও তাঁর ছিল না। আসলে তাঁর সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও তিনি সেই একচিলতে কুঠরি থেকে খেলার খবরাখবর রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু প্রহরীরা তাঁকে সেটা করতে দিত না। তাঁর দৃষ্টি যাতে মাঠের দিকে না যায় সে জন্য তারা তাঁর কুঠরির সামনে একটি ধূসর দেয়াল তুলে দিল। রুবেন দ্বীপের সবকিছুই ছিল এমন ধূসর।
তারা ভেবেছিল, এভাবেই তারা কালো মানুষের নেতাকে শেষ করে দিতে পারবে। কিন্তু তারা ছিল ভুল; তারা মানুষটি কিংবা তাঁর মনোবল কিছুকেই ধ্বংস করতে পারল না। সেই কারাগার থেকে ম্যান্ডেলা বেরিয়ে এলেন আরও শক্তিমান হয়ে। তিনি কেবল বর্ণবাদী শোষণের বিরুদ্ধেই তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন না বরং শ্বেতাঙ্গ নির্যাতকদের ক্ষমার মাধ্যমে বঞ্চনা থেকে তৈরি হওয়া গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে দিলেন। বন্দিশালার সেই কুঠরিতে থাকতেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহুপক্ষীয় গণতন্ত্রের দেশে পরিণত করার সংকল্প করেন। সেই ছোট্ট ঘরটিতে থাকা অবস্থাতেই তিনি বুঝলেন, খেলাধুলা জীবনবিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়; বরং সেরা মানবিক মূল্যবোধগুলোকে বিকশিত করার সামর্থ্য খেলার রয়েছে।
তাই ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ম্যান্ডেলা ঘোষণা করেন, ‘জাতিগত বৈষম্যের আগল ভাঙায় রাজনীতির থেকে খেলা কম শক্তিশালী নয়।’ সেই প্রথম সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী একসঙ্গে ভোট দেয় এবং গোটা দেশই মেতে ওঠে খেলাধুলায়। প্রথম আবির্ভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল দল স্প্রিংবকস ১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপ জেতে। যদিও সেই দলে মাত্র একজন ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। আবার ১৯৯৬ সালেও তারা আফ্রিকান ন্যাশনস কাপে জয়ী হয়। এর মধ্যে বিশ্ব ফুটবল সম্প্রদায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার তাদের সমাজের মধ্যে গ্রহণ করে। (এর আগে বর্ণবাদী শাসনের প্রতিবাদ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক অনেক ক্ষেত্রে বর্জন করা হয়েছিল) খেলার আতিশয্য এমন মাত্রায় পৌঁছে যে ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন নেইল টোভেই শ্বেতাঙ্গ হয়েও হয়ে উঠেছিলেন কালো জনগোষ্ঠীর নায়ক।
এতসব কিছুর পরও, অন্য সবকিছুর মতো দক্ষিণ আফ্রিকারও সবই ভালো, তা নয়। অন্য অনেক দেশের মতো সেখানে এখনো বর্ণবাদের প্রভাব রয়ে গেছে। ফুটবলের বেলাতেও তার লক্ষণ দেখা যাবে। খেলার মাঠ থেকে দর্শকের গ্যালারি পর্যন্ত হয়তো শোনা যাবে চিত্কার-গালাগালি-হইচই। তার পরও এ ধরনের মন্তব্য খেলার নিজস্ব গুণ বা এর সঙ্গে জড়িত আশাবাদের ক্ষতি করতে পারবে না। বিশেষত ফুটবলের বেলায়, অনেক জায়গাতেই যা গরিবের পছন্দের খেলা; বড় বড় শহরের ঘিঞ্জি বস্তির ধুলো-কাদায় ঘরে বানানো বল নিয়ে ছোটাছুটি করা কিশোরেরা তার পরও তাদের প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটাবে। আফ্রিকার কোনো দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপে এমন দৃশ্যই আমরা দেখতে যাচ্ছি।
জ্ঞানী কৌমসর্দার ম্যান্ডেলা রুবেন দ্বীপের ধূসর পরিপার্শ্ব থেকে এক ‘রংধনু জাতি’র স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কালো-সাদায় মেশানো দক্ষিণ আফ্রিকানদের দেশে এবার খেলবে বিভিন্ন বর্ণের ও রঙের জাতির খেলোয়াড়েরা। এর থেকে আর কী আছে, যা ম্যান্ডেলার স্বপ্নের কাছাকাছি?
গ্রানমা ইন্টারন্যাশনাল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
অ্যারিয়েল বি কয়া: কিউবার ক্রীড়াবিষয়ক লেখক।
No comments