অর্জন-বাংলাদেশের নারী আমিরাকে অভিনন্দন by রাশিদা সুলতানা

দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর তাউর মাতন রাউক পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা, যিনি ২০০৬ থেকে ২০১২-এর নির্বাচন পর্যন্ত পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি পরাজিত হয়েও মন্তব্য করেন, এটি এমনই একটি নির্বাচন হয়েছে, যা নিয়ে তিমুরিজরা গর্ব করতে পারে।


পূর্ব তিমুরের সুষুম ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নারী উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ব তিমুরের মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে জাতিসংঘের যে মিশনটি, ২০০৯ সাল থেকে এই মিশনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশের নারী আমিরা হক।
জাতিসংঘের পূর্ব তিমুর মিশনে আমিরা হক যখনই মিটিংয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন, তিমুরিজ, চীনা, ভারতীয়, পাকিস্তানি, আরব, আফ্রিকান, ইউরোপীয় তথা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত শান্তিরক্ষীরা মুগ্ধনেত্রে আমিরাকে দেখেন। কারণ, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি শান্তিরক্ষা মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন নারী, এ ঘটনা জাতিসংঘেও বিরল। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই নারী নেতৃত্বের ইতিহাস তো খুব বেশি দিনের নয়।
এক বছর আমিরা হকের নেতৃত্বে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অসামান্য পেশাদারি ছাড়াও তাঁর একটি বড় গুণ হলো, উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি অফিস সহকারী, গাড়িচালকসহ যেকোনো মানুষকে যথার্থ সম্মান দেখান। স্বল্প সময়েই তিনি তিমুরিজ সরকার, নাগরিক সমাজ, বিরোধী দল ও জাতিসংঘের তিমুরিজ এবং অন্য দেশের সহকর্মীদের মধ্যে শ্রদ্ধাভাজন ও জনপ্রিয় একজন নেতা হয়ে ওঠেন। তিমুরের প্রেসিডেন্ট রামোস হোর্তা তাঁর শেষ কর্মদিবসে আমিরা হককে মেডেল অব অর্ডার পদকে ভূষিত করেন।
স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ১০ বছরের মাথায় তিমুরিজ পুলিশে নারী সদস্যের অংশগ্রহণ ১৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার চার দশক পরেও নারী নেতৃত্ব, নারী আন্দোলন, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম থাকা সত্ত্বেও পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ ৪ শতাংশও অতিক্রম করেনি। ইউনিফর্ম সার্ভিসে নারীর অধিক অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা এবং ভিকটিম সাপোর্টের প্রতিটি পর্যায়ে বিচারক, আইনজীবী, তদন্ত কর্মকর্তা, ভিকটিম সাপোর্ট তদারকি—সবকিছুতে নারীর যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীকে মূলধারায় আনয়ন যাবতীয় উন্নয়নচিন্তার কেন্দ্রে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে এবং সরকারি অফিসে নারীর অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশে পৌঁছানো এখনো বহু দূরের পথ। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ছাড়া নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রধান শর্ত নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি।
নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সরকারি, বেসরকারি অফিসে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে কীভাবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, এটাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সরকারি-বেসরকারি খাতে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়িয়ে এবং নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীকে সম্পৃক্ত না করে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে এবং সর্বত্রই প্রায় প্রতিটি নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুরুষতান্ত্রিকতার চাপের মুখে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশে খুব অল্পসংখ্যক অফিসে কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। অথচ সরকারি-বেসরকারি অফিসে, করপোরেট অথবা তৈরি পোশাকশিল্প কারখানায় সামান্য উদ্যোগ নিলে কি কর্মজীবী নারীদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চালু রাখা সম্ভব নয়? যাঁরা নীতিনির্ধারণ, উৎপাদন, রপ্তানি, বিপণন, গ্রাহক সেবা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা—এত কিছু পারেন, তাঁদের জন্য কি একটি এক-দুই রুমের ডে-কেয়ার সেন্টার চালু রাখা খুব কঠিন?
নির্বাচনী আইন সংস্কারের মাধ্যমে আগামী জুলাইয়ে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে এখানে এক-তৃতীয়াংশ নারী সাংসদ থাকবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চসংখ্যক নারী সাংসদ হবে পূর্ব তিমুরে। তিমুরের নারী উন্নয়ন, গণতন্ত্রে উত্তরণে, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার এবং নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিমুরিজ নারী-পুরুষদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলায় আমিরা হক সবিশেষ মনোযোগী ছিলেন। পূর্ব তিমুরের নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিসংঘের পূর্ব তিমুরে সাফল্যের কারণে। পূর্ব তিমুর হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব আমিরা হককে জাতিসংঘের ফিল্ড সাপোর্ট ডিভিশনের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি পৃথিবীর সব শান্তিরক্ষা মিশন এবং রাজনৈতিক মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। আমিরা যেদিন সুসংবাদটির ঘোষণা দেন, সেদিন তাঁর সহকর্মীরা আনন্দে মেতে ওঠেন। নানা দেশের নারী কর্মকর্তারা উচ্ছ্বাসে আপ্লুত। তাঁরা বলেন, তুমি আমাদের রোল মডেল। তুমি জাতিসংঘের পলিসি লেভেল থেকে সারা পৃথিবীর নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার সংগ্রামে রত। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তুমি আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারবে। আমিরা, তুমি আমাদের নায়ক।
আমিরা হক জাতিসংঘের সব শান্তিরক্ষা এবং রাজনৈতিক মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল—তাঁর এই অর্জন বাংলাদেশের বহু নারীকে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখাবে। কন্যাসন্তানদের মা-বাবাকে অনুপ্রাণিত করবে তাঁদের মেয়েকে আত্মবিশ্বাসী ও সুশিক্ষিত করে তুলতে; যেন তারা পৃথিবীর সব বাধা তুচ্ছ করে, কখনোই হাল ছেড়ে না দিয়ে, তাদের লক্ষ্যের দিকে, স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
রাশিদা সুলতানা: আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, পূর্ব তিমুর। গল্প লেখক।

No comments

Powered by Blogger.