বিশ্বকাপ ফুটবল-পুরো আফ্রিকা মহাদেশ প্রস্তুত by কফি আনান

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান অত্যন্ত ফুটবল-অনুরাগী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আয়োজন আফ্রিকাতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে গোল ডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তাঁর ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে কোন দল জিতবে, আফ্রিকার দলগুলো কেমন করবে,


আফ্রিকা মহাদেশের জন্য এই খেলার কী তাত্পর্য ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ

বিশ্বকাপ নিয়ে আপনার মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে কি?
আমি বিশ্বকাপের অপেক্ষায় আছি। আমি ফুটবল ভালোবাসি। যখনই সুযোগ পাই খেলা দেখি। বিশ্বকাপ তো সবার সেরা—সারা দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়েরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু টুর্নামেন্টের চমত্কারিত্বের পাশাপাশি বিশ্বকাপ আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। কেননা, ফুটবল বিশ্বকাপ নানা দেশের মানুষকে দেশের ভেতর ও দেশের সীমা ছাড়িয়ে এমনভাবে একত্র করে, যা অন্য কোনো উপলক্ষ করে না।
এবারের বিশ্বকাপের একটি বিশেষত্ব আছে। এটি আফ্রিকা মহাদেশে প্রথমবারের মতো সত্যিকারের কোনো বৈশ্বিক ক্রীড়া আয়োজন।
এবার সারা দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টি আফ্রিকার ওপর নিবদ্ধ থাকবে। আমার বিশ্বাস, এটি এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠবে, যেখানে সবাই দেখতে পাবে খেলাধুলা কেমন করে সেতুবন্ধ রচনা করে এবং রাষ্ট্র, এমনকি মহাদেশের মধ্যকার বিভেদ অতিক্রম করতে সহায়তা করে। গতবার জার্মানিতে আমার দেশ ঘানার খেলা আমি উপভোগ করেছি। এবার আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতে ঘানার খেলা দেখার আশা রাখি।
তাহলে এই বিশ্বকাপকে আফ্রিকাবাসী কোনো একক দেশের আয়োজন হিসেবে না দেখে সবাই নিজেদের টুর্নামেন্ট হিসেবে দেখছে?
অনেকটা তাই। বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারায় আফ্রিকা গর্বিত। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে স্থান পাওয়া দেশগুলোতে গেলে আপনার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ঘানার মতো দেশগুলোর যখন খেলা থাকবে তখন তো পুরো দেশবাসী সব কাজ ফেলে খেলা নিয়ে মেতে উঠবে। এমনকি আফ্রিকার যে দেশগুলো চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, সেসব দেশেও আফ্রিকার দলগুলোর বড় সমর্থক গোষ্ঠী শেকড় গেড়ে আছে।
আফ্রিকার দলগুলো কেমন করবে?
ভালো ফল করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। অনেক দিন হলো আফ্রিকা বিশ্বসেরা বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় তৈরি করে চলেছে। কিন্তু এখন পার্থক্যটা হলো, আফ্রিকার দলগুলোর শুধু দু-একজন তারকা খেলোয়াড় নন, সব পজিশনেই বিশ্বমানের খেলোয়াড় আছেন।
আইভরিকোস্টের কথাই ধরুন। এ দলে শুধু দিদিয়ের দ্রগবাই নন, দলটির আক্রমণভাগ, রক্ষণভাগ ও মধ্যমাঠের খেলোয়াড়েরাও মানসম্পন্ন। তারা হয়তো সবচেয়ে কঠিন গ্রুপগুলোর একটিতে পড়েছে, কিন্তু তাদের সম্ভাবনা এখনই খারিজ করে দেবেন না। ঘানা যদি সামর্থ্য অনুযায়ী খেলে, তাহলে পরের পর্বে আমাদের যাওয়াই উচিত।
ফুটবলের এই সাফল্য থেকে বৃহৎ পরিসরে শিক্ষা নেওয়ার কিছু কি আছে?
হ্যাঁ। বিশ্বের সেরা লিগগুলোতে খেলে চলা এসিয়েন, দ্রগবা, ইতো এবং আরও একঝাঁক তারকা খেলোয়াড়ের উত্থান আফ্রিকার ভেতর লুকিয়ে থাকা সমৃদ্ধ প্রতিভার আভাস দেয়। এটা শুধু ফুটবলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সব ক্ষেত্রেই খাটে। ফুটবল দেখাল যে কেউ যদি সফল হওয়ার এবং নিজের সামর্থ্য পূরণের সুযোগ পায়, তারা স্কোর করে, তারা জ্বলে ওঠে। এতে উপকার অনেক। শুধু ব্যক্তিগত নয়, সাধারণভাবে তরুণেরা এবং অবশ্যই সমাজও উপকৃত হয়।
আফ্রিকার তরুণদের সহায়তার জন্য আরও অনেক উপায় বের করা দরকার, যাতে তারা তাদের অভিলাষ পূরণ ও দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে। আমরা পারলে তাতে জয় হয় সবার।
অন্য শিক্ষাটি হয়তো মুক্ত মন ও বিনিময়ের মূল্য প্রসঙ্গে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার তারকারা ইউরোপে খেলার মাধ্যমে নিজেদের বিকশিত করেছেন, আর অন্যদিকে তাঁদের দ্বারা ইউরোপের খেলা সমৃদ্ধ হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো বিদেশি কোচ আনার মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি ঘটিয়েছে।
মুক্ত মন ও হূদয় থাকলে আমরা সবাই লাভবান হই। এটা শুধু ফুটবলের ক্ষেত্রেই নয়। বৃহৎ পরিসরে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে কোনো কিছু দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বাণিজ্যের মতো দুরূহ বিষয়গুলো মোকাবিলার জন্য সহায়তা করতে পারে।
আর একটি ব্যাপার। এক মাস ধরে সারা দুনিয়ার দৃষ্টি ফুটবলের ওপর নিবদ্ধ থাকবে। আসলে ফিফার সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা তো জাতিসংঘের থেকেও বেশি। একবার ভেবে দেখুন, যদি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই এবং সমাজে নারীর পূর্ণ ভূমিকা রাখার নিশ্চয়তার মতো কাজ আমরা সহযোগিতার এই চেতনা ধারণ করি, তাহলে একতাবদ্ধ হয়ে কত কী অর্জন করতে পারি।
বিশ্বকাপ নিয়ে আপনার বড় প্রত্যাশাগুলো কী?
অবশ্যই চমত্কার ফুটবল দেখা। আমার ধারণা, এটি অত্যন্ত সফল টুর্নামেন্ট হবে। আমি জানি, সবকিছু ঠিকঠাকমতো সম্পন্ন করার জন্য আর সবার সময় যাতে ভালোই কাটে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী কতটা কঠিন পরিশ্রম করছে।
আফ্রিকা সম্পর্কে যাঁদের নানা পূর্বানুমান আছে, তাঁরা চমত্কৃত হবেন বলে আমার ধারণা। আফ্রিকা মহাদেশে যেভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে, তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেনি সংবাদপত্রের শিরোনামে। ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ সম্পর্কে ধারণার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আমার ধারণা, ২০১০ সালের বিশ্বকাপ আফ্রিকার জন্যও একই রকম ফল বয়ে আনবে।
আশা করি, আফ্রিকার বৈচিত্র্য, বৈভব, প্রতিভা ও সামর্থ্য বিশ্ববাসীকে দেখাতে এই বিশ্বকাপ সহায়ক হবে। পাশাপাশি বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলোও আড়ালে থাকবে না। ফুটবলের পেছনে যে শক্তি ব্যয় করা হচ্ছে, তার কিছু অংশ যদি জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রে কাজ করার চেষ্টাতে, বিশেষত আফ্রিকাকে সহায়তায় প্রবাহিত করা যায়, তাহলে তা হবে চমকপ্রদ।
দিদিয়ের দ্রগবার সঙ্গে মিলে আপনি স্কোরিং ফর আফ্রিকা প্রকাশ করেছেন। এর উদ্দেশ্য কী?
স্কোরিং ফর আফ্রিকা একটি বিকল্প বিশ্বকাপ নির্দেশিকা। আফ্রিকা প্রগ্রেস প্যানেল এটি প্রস্তুত করেছে। আমি এই প্যানেলের সভাপতি। আমাদের ভাবনাটা ছিল উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত-সংবলিত এমন একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা, যেটি বিশ্বকাপের চেতনাকে ফুটবলের বাইরে নিয়ে যাবে এবং কতগুলো বিষয়কে তুলে আনবে, যেগুলো বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোকে একত্র ও আলাদা করে। উন্নয়নের প্রতি দ্রগবা অঙ্গীকারবদ্ধ। সুতরাং তাঁর সঙ্গে এই কাজ করা ছিল খুব আনন্দের ব্যাপার।
অনেকগুলো দলই জিততে পারে। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার শক্তিশালী দলগুলো এবারও ফেভারিট তো থাকবেই। কিন্তু প্রচুর অঘটন ঘটবে। ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি ও আর্জেন্টিনার মতো দলগুলো একের পর এক টুর্নামেন্টে ভালো করে। তাদের ও অন্যদের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন কমছে। স্পেনকে খুব শক্তিশালী মনে হচ্ছে। আর আফ্রিকার দলগুলোকে খারিজ করে দিতে চাইলে যেকোনো দলকেই বিরাট ঝুঁকি নিতে হবে।
আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?
একজনের নাম বলা মনে হয় ঠিক হবে না। কিন্তু আমার দেশ তো ঘানা। মাইকেল এসিয়েনকেই আমি বেছে নিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি খেলতে পারছেন না। বিকল্প নির্দেশিকা তৈরিতে দ্রগবা আমার সঙ্গী ছিলেন। আর তিনি তো বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। আমাকে কারও নাম বলতে বললে তাঁর নামই বলব।
কোন দেশ জিতবে বলে মনে করেন?
অনেকগুলো দলই জিততে পারে। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার শক্তিশালী দলগুলো এবারও ফেবারিট। কিন্তু অনেক অঘটনও ঘটবে। ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি ও আর্জেন্টিনার মতো দলগুলো একের পর এক টুর্নামেন্টে ভালো করে। তাদের ও অন্যদের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন কমছে। স্পেনকে খুব শক্তিশালী মনে হচ্ছে। আর কোনো দল যদি আফ্রিকার দলগুলোকে বাতিল গণ্য করে তাহলে তাকে বিরাট ঝুঁকি নিতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।

No comments

Powered by Blogger.