গোধূলির ছায়াপথে-চেনা-অচেনা চীন by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

চিকনমাটি গ্রামের ধলা মিয়া চিনাবাদাম ছাড়া চীনের কতটুকুই বা চেনেন। ৩০ বছর পরে মহাচীনে সাত দিনে যেন জেনে ফেলেছি অনেক। জেনেছি অল্পই। ধলা মিয়া আর আমি একই দলে। সুন্দরের আছে আশ্রয়। সে জানে অন্ধকার যখন লুটায় দৃষ্টিপথে, আপনা থেকে সৃষ্টি হয় নতুন আলোপথের।


অচেনা চীনকে দেখতে প্রয়োজন গভীর দৃষ্টির, যাতে হাজার বছরের প্রাচীন বিকশিত নতুন প্রভায়। যা দেখিনি তাও যেন দেখা, যা চাইনি, তাও পাওয়ার পরিধিতে। এত বড় একটি দেশ দেখতেও অনেক সময়, পরিশ্রম, আয়োজনের প্রয়োজন। অথচ এয়ারপোর্টে নেমেই তিন মাসের একটি শিশুকে কাছে পেয়ে ইচ্ছে হলো তাকে আদরে-সোহাগে কোলে নিতে। মহাচীনের মানুষদের যেন সহজেই স্পর্শ করতে পারলাম। ভাবনাটাই আসল, বাকি সঙ্গের সারথি।
ভালো লেগেছে, লাগেনি। এ কেমন অনুভূতি?
প্রকৃতি ডাক দিয়ে যায়। প্রকৃতি আমার মা, আমার পিতা। তার আলিঙ্গন বাতাসের তীব্রতায় গাছের পাতার শিরশিরিতে বয়ে যায়। এর স্পর্শ আনে শিহরণ, ব্যাকুলতা। ‘গ্রেট ওয়ালে’ এসেছেন হাজার হাজার, লাখ লাখ পর্যটক। আমি হেঁটেছি কয়েক কদম। কেউ শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। ৩০ বছর আগে তিন কিলোমিটার হেঁটেছিলাম, এখন তিন কদম। আজকের অনুভূতি কত আলাদা। আমার মা, আমার পিতা যেন লুকিয়ে আছেন ওই পাতাগুলোর আড়ালে। বিরাট চীনের প্রাচীরের অন্তরালে, যেখানে সবুজ গাছ উঠে গেছে আরেক পাহাড়ের মতো। আর ওই পাথরগুলো যেন আমার লাখো বছর আগের হারানো পিতা। ওরা কথা বলতে পারে না। তবু আজ বলল:
‘তুই এসেছিস? কেমন করে খুঁজে পেলি আমার ধন? এই প্রাচীরের মায়াপুরীতে, আর কুনমিনের পাথুরে বনেই হোক, আমি আজ পাষাণ।’
হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীর, দেখা যায় মহাকাশ থেকে চার হাজার মাইল চলে গেছে সমুদ্র পর্যন্ত। হাজার বছরের গাছগুলোই পাথর হয়ে যাবে? আমরা জ্যান্ত মানুষেরাই যে হয়ে পড়েছি হূদয়হীন প্রস্তরসম। ওই গাছ, চীনের প্রাচীরের মতো আমি নিজেই। প্রস্তরসম হূদয়হীন মানবতা।
এশিয়া মিডিয়া সামিটে সমাগত সাত শ ডেলিগেট। তিন দিন ধরে বক্তৃতা। কীভাবে টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ব্লগ ও নতুন মিডিয়া এশিয়ার দেশগুলোকে আরও কাছে এনে দেবে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বক্তৃতা, আলোচনা ও সর্বশেষ করণীয়। এই নিয়ে সাতটি সামিটে এসেছি, কতজনের সঙ্গে পরিচয়, যেন আত্মীয়ের মতো। আমার সহযাত্রী আসমার সুন্দর শাড়ি ও সুন্দর বক্তব্য সিসিটিভির ক্যামেরাম্যানদের নজর এড়ায়নি। চীনাদের আয়োজন মনকাড়া। সবকিছু হতে হবে পারফেক্ট। রাতে ইনস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টসে চীনাদের সিম্ফনিক অর্কেস্ট্রার নিবেদন। ১২টি আইটেম যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এসে দোলা দেয় শ্রোতার মননে। এ রকম রাজকীয় আয়োজন চীনাদের পক্ষেই সম্ভব।
বেইজিং হোটেলে ৩০ বছর পর। পুরোনো সঙ্গীরা নিষ্ক্রান্ত অনেকেই, সেদিনের সাংস্কৃতিক দলের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী, পাঠক মুজিবুর রহমান, সংগীত পরিচালক সমর দাশ, নৃত্য পরিচালক গওহর জামিল, নৃত্য পরিচালক আলতামাশ আহমেদ, আবদুল মান্নান, ফিরোজ শাঁই। তিনটি প্রধান শহরে গান গেয়ে ফিরেছি ফিরোজা বেগম, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী, ফেরদৌস ওয়াহিদ, খুরশীদ আলাম, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, কাদেরী কিবরিয়া, রওশন আরা মুস্তাফিজ, আকরামুল ইসলাম। সে স্মৃতি মুখর হলো আজ। আজকের বেইজিং সেজেছে নতুন সাজে। পথঘাট, বিল্ডিং ইমারত, বাস গাড়ি—সব নতুন। পুরোনোর অবশিষ্ট নেই কিছুই। ৩০ বসন্ত আগে ছিল পথে পথে ফুল। আমাদের সেদিনকার নতুন চীন দেখার স্বপ্ন রাঙানো দিনগুলো। কিছুই ভুলিনি।
সেদিন ছিল হাজার হাজার সাইকেল আরোহী, আজ শুধু গাড়ি আর পাতালরেল। বেইজিং হোটেল ও ৫০টি নতুন হোটেল সম্পূর্ণ নতুন সাজে ইউরোপীয় সজ্জা, পেইন্টিং থেকে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার ইন্টারনেট ডিসকো টিভি নিয়ে প্রস্তুত। প্রতি কামরা আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে আগত শত ব্যবসায়ী ও কর্মচারী দিয়ে ‘ফুললি বুকড’। মনোরঞ্জনের জন্য ব্যস্ত চৌ এন লাই-পরবর্তী প্রজন্মের নেতা-কর্মচারী সবাই। কত তাড়াতাড়ি বদলানো যায় সবকিছু, সেদিকেই নজর। মরালিটির প্রশ্ন পরে। কর্মটি হাসিল করতে হবে। এটাই অভীষ্ট। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে, ওপরে ওঠার পথ একটিই: টেকনোলজি। ওটি আমেরিকার করায়ত্ত। যেমন করেই হোক, এটি সংগ্রহ করতে হবে। শত শত আমেরিকান কোম্পানি ব্যবসার শাখা বিস্তার করে আছে চীনের প্রতিটি বড় শহরে। সেটি চ্যাংলে, ফুডিং, ফুজু, গুডট্রাং, গানছু, হেবি, হুবি, হুনান, জিলং, সাংহাই, টিয়ানজিং যেখানেই হোক। ছুটে এসেছেন জার্মানি, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, আরব দেশ, রাশিয়া, জাপানিসহ সব দেশের বিদেশিরা। হোটেলগুলো ব্যস্ত কীভাবে ব্যবসায়ীদের খুশি করা যায়, তাদের খাবার-দাবার ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে। ৩০ বছরে এগিয়ে গেছে তিন শ বছর।
ভালো লাগেনি যা, তাও বলি। শহর সেজেছে, গ্রাম নয়। চীনারা ‘মার্কেট ইকোনমিতে’ কনজুমার বস্তুর মোহে প্রবেশ করেছে। এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে তারা যে এর ফলাফল শুভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মার্কেট চিরদিনের নয়, এটি স্থান পরিবর্তন করে। সংস্কৃতি ভুলে গেলে চীনের আর রইল কী? পুরোনো জামা, পুরোনো জুতা, পুরোনো ছাতা, অল্প একটু পুঁইশাকের সুপ দিয়ে আঠালো ভাত খাওয়া, যেমনটি দেখেছি ছোটবেলায় কলকাতার চীনা পল্লিতে। ওদের চিনতাম, দেখেই চিনতে পেরেছি। হাজার বছরের সামন্ত প্রভুদের পরে কার্ডহোল্ডাররা শাসন করেছে ৫০ বছর। স্মার্ট বংশধরেরা মার্কিন মার্কেটের পেছনে ধাবমান।
বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে অনেক মিল। উচ্চ-নিচের বিরাট ব্যবধান। গরমিল শুধু এক জায়গায় তা হলো, ৫০ বছরে চীনারা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা পেয়েছে শহরে উন্নত শিক্ষার সন্ধান। কমিউন সিস্টেমের প্লাস পয়েন্ট। তাই বড় রকমের বিপ্লবের আর অবকাশ নেই। আমাদের ১০ হাজার মানুষের কাছে দেশের সম্পদের সিংহভাগ করায়ত্ত। মাঝামাঝিতে মেতে আছে রবি-নজরুল অনুরাগী মধ্যবিত্ত। ৮০ জন দুঃসহ দারিদ্র্যে প্রবেশ করছে প্রতিদিন। বিপ্লবের নিশান উড়ছে আকাশে।
আমরা পারব না? পারব। প্রয়োজন প্রতিজ্ঞার। একাত্তরে এক হয়েছিলাম। যেমন করে সম্ভব, এক হতে হবে, প্রতিজ্ঞা নিতে হবে, দেশমাতৃকাকে স্পর্শ করে। আত্মাকে পবিত্র করে, মাত্র এক শ জন সম্পূর্ণ সমর্পিত ব্যক্তির প্রয়োজন। তাহলে চীনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারব। ওদের বিশ্বাস টেকনোলজি, যা পৃথিবীর সাফল্যপ্রত্যাশী। আমাদের বিশ্বাস পৃথিবী ছাড়িয়ে।
কুনমিনে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি প্রস্তর বন দেখার জন্য পর্যটকেরা ভেঙে পড়েছে। যাদের সঙ্গে দেখা হলো তারা এসেছে চীনের নানা প্রদেশ থেকে দল বেঁধে। দেখা হলো অস্ট্রেলিয়ান ও ফ্রান্স থেকে আগত পর্যটকদের সঙ্গে। লাঞ্চের টেবিলে বললাম:
তোমরা যে খাবার ভক্ষণ করলে না, টেবিলের কোনায় পড়ে রইল, তার কথা ভেবেছ কি? ঘাড় নেড়ে বললেন একজন, কেন ক্ষুধার্তরা খাবে? বললাম: তা নয়। তোমাদের ফেলে দেওয়া খাবার চীনারা খাবে না। ওগুলো ফেলে দেওয়া হবে।
এবার ফরাসি নারী বেদনার্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন: তোমার মনোবেদনা বুঝেছি, হে শিল্পী-লেখক। ছবি তুলেছি অনেক। চেনা-অচেনার স্পর্শ নিয়ে ছবিগুলো হয়তো কোনো দিন দল মেলবে। গ্রন্থের নাম হবে: চেনা-অচেনা চীন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.