সিসিসি নির্বাচন-দুই প্রার্থীর পথের কাঁটা... by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

জামায়াত যতদিন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মন্জুর আলমকে সমর্থন দেয়নি, ততদিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) নির্বাচন এখানকার ভোটারদের কাছে পুরোপুরি দলীয় রাজনীতির চেহারা পায়নি, কিন্তু তাদের সমর্থন ও প্রার্থী প্রত্যাহার রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট করে তুলেছে। মন্জুর আলম ছিলেন আওয়ামী ঘরানার মানুষ।


গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন চৌধুরী জেলে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। মন্জুর এর আগেও ১৬ বার ভারপ্রাপ্ত মেয়র ছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ছিলেন বলে বারবার এ দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনের সময় থেকে মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের শুরু। গত সংসদ নির্বাচনে প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে হেরে যান মন্জুর। এবার নানা জল্পনার পর মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে মন্জুর আলমের একটা ভাবমূর্তি আছে। প্রার্থিতার জন্য দলবদলের ব্যাপারটি নিয়ে কিছু কথা উঠলেও, এ ধরনের নির্বাচনে বড় দলের সমর্থনটা জরুরি—এ যুক্তিও মেনে নিয়েছিলেন অনেকে। তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে দলের ভেতর বিরোধ ছিল, ওপরের নির্দেশে সেই বিরোধ আপাতত চাপা দিতে বাধ্য হয়েছেন অসন্তুষ্ট নেতা-কর্মীরা। তাঁর পক্ষে প্রচারণায় আবদুল্লাহ আল নোমান, এম মোরশেদ খান বা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মাঠে নামতে দেখে অনেকের ‘বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খাওয়ার’ প্রবাদটি মনে পড়ে যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এর নাম রাজনীতি।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তিটা বাধল বিএনপির জোট রাজনীতির মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে। জামায়াত এবারও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী দিয়েছিল দলের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মকাণ্ড, সর্বোপরি জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি জনসমক্ষে আসার পর খুবই বেকায়দায় পড়েছে দলটি। সভা-সমাবেশ-মিছিল করতে গেলেই প্রশাসনের বাধার মুখে পড়ছেন তারা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সূত্রে দলকে চাঙা করা যাবে, সংগঠিত করা যাবে কর্মীদের— এমনই পরিকল্পনা ছিল তাদের।
কিন্তু হঠাৎ করে বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা সংসদ নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনেও জোটবদ্ধ হয়ে লড়বার সিদ্ধান্ত নিলে মেয়র পদ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন জামায়াতের চট্টগ্রাম জেলার নায়েবে আমির আফসার উদ্দিন চৌধুরী।
শোনা যায়, বিএনপির চট্টগ্রাম জেলার নেতারা এ সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। পত্র-পত্রিকায় এই নেতাদের বক্তব্য থেকে সেটা বোঝা যায়। তাঁরা সরাসরি হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও অসন্তোষ চাপা রাখতে পারেননি।
জামায়াত মন্জুরকে সমর্থন দেওয়ায় যে সমস্যাগুলো হতে পারে—
১. সুশীল সমাজ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের যে নেতৃবৃন্দ মহিউদ্দিনের ওপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন, তাঁদের জন্য আর বিকল্প থাকল না। তাঁরা জামায়াতের পক্ষে যায়, এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ২. চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এবার নতুন ভোটার হয়েছেন পাঁচ লাখ। এ নবীনেরা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটির পক্ষে রায় দিতে চাইবেন না। ৩. সর্বোপরি বিএনপির তরুণ কর্মী, বিশেষত ছাত্রদলের একটি অংশের মধ্যেও জামায়াত বিরোধিতা প্রবল। তাঁরা অন্তত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন আঁতাত পছন্দ করছেন না। পত্র-পত্রিকায় ছাত্রদলের কোনো কোনো নেতা অপছন্দের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে মহিউদ্দিনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছেন তাঁর একসময়কার ঘনিষ্ঠজনেরা। মহিউদ্দিনের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? এ প্রশ্নে এককথার জবাব, তাঁর জিহ্বা। তিনি দুর্মুখ বলে পরিচিত, রাখ্ঢাক্ করে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। সেটা কখনো কখনো প্রায় অশ্লীলতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। কিছুদিন আগে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী জনান্তিকে এক সাংবাদিককে বলেছেন, ‘মহিউদ্দিনের অন্য তেমন সমস্যা নেই, সমস্যা তাঁর মুখ।’ নিয়তির কী পরিহাস। চটুল ও অশ্লীল কথাবার্তা বলার জন্য যিনি বহুল পরিচিত, তিনিই সমালোচনা করছেন মহিউদ্দিনের।
গত সংসদ নির্বাচনের সময় নগর এলাকার আওয়ামী লীগ মনোনীত তিন সাংসদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল মহিউদ্দিনের। সেই দূরত্ব এখনো ঘোচেনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বা কেন্দ্রীয় নেতাদের চট্টগ্রাম সফর ক্ষতের ওপর মলমের প্রলেপ দিয়েছে বটে, ঘা সম্পূর্ণ সারেনি। এঁদের সমর্থকেরা যদি উল্টোগীত গাইতে থাকেন, তবে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
এ কথা আগের লেখায় উল্লেখ করেছি, প্রায় সাড়ে ১৬ বছর মেয়র পদে আসীন ছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অভিযোগের সুযোগও বেশি। নির্বাচন সামনে রেখে সাধারণত নেতিবাচক দিকগুলোই প্রচার পায় বেশি। ফলে প্রবর্তকের মোড়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্য যত সমালোচিত হয়েছেন মেয়র, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য উন্নতমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করার কৃতিত্বটা তত আলোচিত হয়নি। তেমনি নগরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে তাঁর ব্যাপক কর্মকাণ্ড প্রচার পায়নি খুব বেশি।
তিনি নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে নানা সময়ে নানা ধরনের স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে এসব বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠক করে, তাঁদের মতামত শুনে তাঁর উদ্যোগ স্থগিত বা বাতিলও করেছেন। নাগরিকদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁর এ পশ্চাদাপসরণ যথাযথভাবে প্রচারিত হয়নি। প্রচারিত যে হয়নি তাঁর প্রধান কারণও ওই ‘জিহ্বা’। তাঁর দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনেরাও নানা সময় তাঁর কটুকাটব্যের শিকার হয়েছেন, সেই অভিমান এখনো দূরে সরিয়ে রেখেছে অনেককে।
দেখা যাচ্ছে, দুই প্রার্থীরই মূল সমস্যা ঘরে। সেটা তাঁরাও জানেন। সে কারণে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার বা কাদা ছোড়াছুড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। ঘরের সমস্যাই পথের কাঁটা হয়ে আছে তাঁদের। কাঁটা সরিয়ে পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করার দায়িত্ব এখন তাঁদের হাতেই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.