স্মরণ-শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন by জাহাঙ্গীর হোসেন

বিকেলের সোনা রোদে গগন গঙ্গায় চিত্রবিচিত্র মেঘের সমারোহে স্রষ্টা ছবি আঁকেন। আবার একই আকাশ ঘন বিষাদের হয়ে যায় আষাঢ়ের কালো মেঘে। স্রষ্টার সৃষ্টিকে ধরে রাখার প্রয়াসেই হয়তো চিত্রশিল্পীরও ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে। এ যেন বিশ্বকর্মার কর্মের ছাপ ক্যানভাসে ধারণ করা। যাঁরা এই সৌন্দর্যকে ক্যানভাসে ধারণ করেন, তাঁরা শিল্পী।


আর এই গণ্ডি পেরিয়ে যাঁরা চোখের সামনে পাওয়া সব বাস্তবতাকে ক্যানভাসে ধরে রাখেন, তাঁদের ভালোবেসে এর চেয়েও বড় উপাধি দিতে হয়। আমরা তা দিয়েছি। তাঁকে আমরা বলি শিল্পাচার্য। অর্থাৎ শিল্পের শিক্ষক। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রহ্মপুত্রের তীরেই কেটেছে তাঁর শৈশব। এই ব্রহ্মপুত্রই তাঁর আঁকা চিত্রে বহুবার প্রাণ পেয়েছে নব নব আঙ্গিকে। আর ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত প্রদর্শনীতে তিনি জলরঙের অনেক ছবি আঁকেন ব্রহ্মপুত্রের ওপর এবং পান গভর্নরের স্বর্ণপদক। কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজে তিনি ভর্তি হন ১৯৩৩ সালে। এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন এবং এ কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সেই একই ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ স্টাইলে ছবি দেখে দেখে তিনি এই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিরক্ত হয়ে গেলেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর কিছু সহকর্মী নিয়ে তিনি ঢাকায় গড়ে তোলেন একটি আর্ট ইনস্টিটিউট এবং তিনিই নির্বাচিত হন এর প্রথম অধ্যক্ষ। দুই বছরের জন্য তিনি যান লন্ডনে এবং ফিরে এসেই শুরু করেন বাংলার নিজস্ব একটি শিল্পধারা। বাংলায় আধুনিক শিল্পের যে প্রসার, তার বীজ বপন করে গেছেন আমাদের শিল্পের এই মহান শিক্ষক। শিল্পকে আধুনিকতার ছাপ দিতে গিয়ে তিনি হঠাৎ করেই লক্ষ করলেন তাঁর শিল্পে আবহমান বাংলার সুরের বড্ড অভাব। তাই তিনি ফিরে গেলেন নাড়ির টানে। তাঁর শিল্পে উঠে আসতে শুরু করল বাংলার মুখ, গ্রামের মুখ এবং প্রাত্যহিক জীবনযুদ্ধ। আর এসব শিল্পকে তিনি আধুনিকতার পরশ লাগিয়ে গড়ে তোলেন নতুন এক শিল্পধারা। ১৯৭০ সালে তিনি ৬৫ ফুটের একটি চিত্র আঁকেন গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে। এর নাম দেন নবান্ন। পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে তাঁর আঁকা কিছু ছবি যেন ঠিক ছবি নয়, এ যেন ক্ষুধার কষ্টকে বাস্তবতার ফ্রেমে তিনি বন্দি করেছেন। শূন্য থালার পাশে না খেতে পেয়ে কঙ্কাল হওয়া অর্ধনগ্ন মানুষের মুখে বসে আছে কাক। মানুষের যেখানে খাদ্য নেই, সেখানে কুকুরের খাদ্যের যেন অভাব নেই। পাশেই চলছে কুকুরের খাওয়া। কে জানে হয়তো না খেতে পাওয়া মানুষগুলোই মরে গিয়ে কুকুরের পেট ভরাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের এঁকেবেঁকে চলা ছোট নদী যেমন শিশুমন থেকে শুরু করে বড়দের মনেও বড় একটি জায়গা করে নিয়েছে, তেমনি করে সামান্য পাখি কাক অসামান্য হয়ে আছে শিল্পাচার্যের তুলির আঁচড়ে। তুলির মাত্র একটি আঁচড়ে আঁকা কাককে তিনি এতটাই প্রাণবন্ত করেছেন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকলেও যেন মনে হয় এই বুঝি একটু শব্দ হলেই কাকটা ওড়ে যাবে। ওড়বে কি ওড়বে না এই সিদ্ধান্ত এখনই নিতে গিয়েও নিচ্ছে না এমন পাখির ছবি নিষ্প্রাণ তুলিতে কিভাবে তিন প্রাণবন্ত করলেন, তা কেবল এই মহান কারিগরই জানেন। ১৯৭৫ সালে তিনি গ্রামীণ শিল্প নিয়ে একটি জাদুঘর করেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এবং জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা নামে তাঁর নিজের আঁকা ছবি নিয়ে একটি গ্যালারি করেন ময়মনসিংহে সেই তাঁর চেনা ব্রহ্মপুত্রের তীরে। এই মহান শিল্পী ১৯৭৬ সালের ২৮ মে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.